নাটোরের এককালের খরস্রোতা ‘নারদ নদ’ এখন শুধু নামেই পরিচিত। নেই চলমান পানি প্রবাহের সেই রুপ। চলেনা বাস্পীয় ইঞ্জিন চালিত বড় বড় নৌকা। মানুষের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতায় খরস্রোতা নদটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। অবৈধ দখল, কলকারখানার দূষিত বর্জ্যসহ ভরাটের কারণে নারদ নদ এখন সরু ড্রেন হয়ে গেছে।
স্রোতহীন নদটিতে এখন পানির পরিবর্তে প্রবাহিত হচ্ছে পয়প্রনালী সহ দুষিত বর্জ্য। দখল ও দুষণে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই নদের অস্তিত্ব। লেখক মাহবুব সিদ্দিকীর লেখা ‘নারদ নদ’ বই থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, পদ্মানদীর একটি শাখা হল ‘নারদ নদ।’
রাজশাহী অঞ্চলের পুঠিয়া এবং নাটোর অংশে প্রবাহিত এই নদ অনেকাংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকী অংশটুকু খাল, নালা ইত্যাদির রূপ ধারণ করে কোনমতে টিকে আছে। নারদ বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদের একটি। ১৮২১ সালে পদ্মা নদীতে বন্যায় ব্যাপক জলস্ফীতি হলে উৎসমুখে বালু ও পলি জমে নারদ স্রোতহীন হয়ে পড়ে।
সেবারের বন্যায় দীর্ঘদিন নাটোর জলাবদ্ধ ছিল। এই সময় থেকে নারদ নদের রাজশাহী অঞ্চলের পানিপ্রবাহ মরে যেতে থাকে। তবে নাটোর অঞ্চলের নারদ নদে পদ্মার পানি রাজশাহীর চারঘাট হয়ে ‘বড়াল’ ও ‘মুসাখান’ নদ দিয়ে ঢুকছিল। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদের জন্ম হয়। বড়াল নদ থেকে জন্ম হয় মুসাখান নদ।
নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মুসাখান নদ থেকে নারদ আবার পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। ভাটিতে গুরুদাসপুরের নন্দকুজা নদীতে গিয়ে মিশে নারদ নদ। জনশ্রুতি রয়েছে. এই নারদ নদকে ঘিরে প্রায় ৩০০ বছর আগে নাটোর শহরের গোড়াপত্তন হয়। নাটোরের রাজা রামজীবন ও রঘুনাথ ১৮ শতকের প্রথম দিকে এখানে তাদের রাজধানী স্থাপন করেন।
সেই সময়ে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নাটোরের যোগাযোগ। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল খরস্রোতা এই নারদ নদ। এরপর ধীরে ধীরে নারদ নদের চারপাশের উর্বর ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে বসতি। বাস্পীয় ইঞ্জিনচালিত বড় বড় নৌযান এই নদ দিয়ে চলাচল করতো।
রানী ভবানীসহ অন্য রাজারা এই নদ দিয়ে কলকাতায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু ৮০’র দশকে নারদের উৎসমুখ চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে নারদ মৃত নদে পরিণত হতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদের তীর ভরাট করে শুরু হয় দখলের প্রক্রিয়া। গড়ে তোলা হয় স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠামো। ফলে কমতে থাকে নদের আয়তন।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, নারদ নদের দৈঘ্য ৪৪ কিলোমিটার। নাটোর শহরের মধ্যে এই নদের অবস্থান ৬ কিলোমিটার। যা শহরকে করে সৌন্দয্য মন্ডিত। এই নদের প্রস্থ ছিল ৬০ ফুট থেকে সর্ব্বোচ্চ ১২০ ফুট। কিন্তু কালের বির্বতনে এবং অবৈধ দখল ও দুষণের কবলে পড়ে নারদ তার অস্তিত্ব বিলীন হতে শুরু করে।
নদী তীরবর্তী গড়ে তোলা হয় নাটোর চিনিকল, প্রান এ্যাগ্রো লিমিটেড, যমুনা ডিষ্ট্রিলারিজ, কিষোয়ান কোম্পানীর কারখানা। এছাড়া পানি কমে যাওয়ার সুযোগে প্রভাবশালী অনেকে নদের জায়গা দখল করে স্থায়ী-অস্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। ফলে নদটি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় বাঁধ দিয়ে প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করা হয়েছে।
নদ তীরবর্তী শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদে। এসব কারখানার তরল ও বিষাক্ত বর্জ্য ফেলায় এখন নদের পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নদের দুই পারের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে চলতে মশামাছি ও কীটপতঙ্গ উৎপাদনের আবাসস্থলে পরিণত এই নদ।
স্থানীয় লেখক গবেষক খালিদ বিন জালাল বাচ্চু সাময়িকীকে জানান, ‘নাটোর সুগারমিল, যমুনা ডিস্টিলারিজ, কিষোয়ান ও প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানার দূষিত বর্জ্য নারদ নদে ফেলা হয়। ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নারদ পাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দূষিত স্রোতহীন পানি মশা উৎপাদনের খামারে পরিণত হয়েছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কারো কান অবধি পৌঁছেনা। প্রতিকার চেয়ে দল বেধে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ শেষে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। কারখানার বর্জ্য ছাড়াও শহরের ময়লা আর্বজানা ফেলা হচ্ছে। দেখার কেউ নাই। নাটোরে এখন মুক্ত বাতাস পাওয়া যায়না। যমুনা, প্রান, কিষোয়ান ও চিনিকল এখন নাটোরের মানুষের কাছে দুঃখের কারণ।’
বেসরকারী সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সংস্থা ‘সাথী’ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, পরিবেশকর্মী সিবলী সাদিক সাময়িকীকে বলেন, ‘নারদ নদের উজান থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা যেমন সদর উপজেলার কাফুরিয়া, জালালাবাদ, পাইকপাড়া, সোনার পাড়া, পীরগাছা, হাশেমপুর, দস্তানাবাদ, পীরগঞ্জ, কসবা, লোটাবাড়িয়া প্রভৃতি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এই নারদ নদকে খুঁজে পাওয়া যায়না।
এই সব এলাকায় নারদ নদ ভরাট করে বড় বড় পাকা বাড়ি নির্মান করা হয়েছে। এছাড়া নারদ নদের প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকা প্রান এ্যাগ্রো লিমিটেড কারখানা এলাকায় ঢুকে রয়েছে। সিংগারদহ এলাকায় নদের উত্তর ও দক্ষিন পার্শ্বে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাণের বিভিন্ন পণ্য তৈরি কারখানা।
এক সময় এই নারদ নদ ভরাট করে রাস্তা করেছির প্রাণ কর্তৃপক্ষ। অবশ্য পরে তা ভেঙ্গে অপসারন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই একই এলাকায় নদের ওপর দিকে কারখানার পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রাণের কারখানার অভ্যন্তরে থাকা নদের এই অংশে সাধারন মানুষ যেতে পারেনা বা তা ব্যবহার করতে পারেনা।
নদের এই পথ দিয়েই প্রাণ কোম্পানীর তরল বিষাক্ত বর্জ্য নির্গত হচ্ছে। এছাড়া কিষোয়ান, যমুনা ডিষ্ট্রিলারিজ ও নাটোর চিনিকলের বর্জ্যও ফেলা হয় এই নদে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্যে দুর্গন্ধে নদের দু’পারের মানুষের জীবন দুর্বিসহ ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দুষিত এই পানি ব্যবহার করলে গাছ মরে যায়।
মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগ সহ নানা রোগে। এ অবস্থায় নদ সংস্কার, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং দূষিত বর্জ্য ফেলা বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে নাটোরের মানুষ। বিভিন্ন সংগঠন এই দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। পরিবেশবাদি সংগঠন ‘বেলা’র পক্ষ থেকে আদালতে মামলাও করা হয়।
২০১৪ সালে হাইকোর্ট থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ সহ বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার জন্য জড়িত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে আদেশ দেওযা হয়। রায়ে আদালত সব দখল ও স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দিলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি।
এছাড়া নাটোর পৌরসভার প্রয়াত চেয়ারম্যান আমিনুর হক গেদু ১৯৯০ সালের দিকে নারদ নদে নাটোর চিনিকল ও যমুনা ডিস্ট্রিলারিজসহ বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এনিয়ে আদালতে তিনি একটি মামলাও করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ওই উদ্যোগ থেমে যায়।
সিবলী আরও বলেন, নারদে পানি প্রবেশের পথে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় স্লুইস গেটের মত নারদ নদে আরো ছোট খাটো ৩৮টি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। এসব গেইট নির্মানের ফলে, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে, নারদ নদ ভরাট হতে থাকে।
বিভিন্ন সময় আন্দোলন ও দাবীর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নদী রক্ষা কমিটির একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সব বৈঠকে দুষনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সহ অবৈধ দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে সিদ্ধান্ত কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তবে ২০১৮ সালে নদী রক্ষা কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন ও পরবর্তীতে ২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ, নারদ নদের দুই তীরের কিছু অংশের অবৈধ দখলদারসহ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন এসব অভিযানের পাশাপাশি কিছু এলাকার কচুরী পানা পরিস্কার করেন। এরপর করোনা মহামারি শুরু হলে কার্যক্রম স্থগিত হয়ে, থেমে যায় নাটোরের মানুষের নাড়ীর স্পন্দনও।’
এদিকে ওই বছরে নাটোর সফরে আসেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার বিন কবির। এসময় তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘অচিরেই নারদ নদ খনন কাজ শুরু হবে। কোনো ধরনের বাধা এলে তা গুঁড়িয়ে দখল উচ্ছেদ করে নারদ নদ বাঁচানো হবে।’ তার এই কথার সত্যতা পাওয়া যায় জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদের সময় বাধা দেয়নি কেউ। উপরন্তু অনেকে নিজেদের উদ্যোগেই তাদের স্থাপনা সরিয়ে নেন।
জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ সুত্রে জানা যায়, ওই উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগে নারদ নদের পাড়ে বসবাসকারী দুই শতাধিক দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রথম ধাপে ১১ জনকে নোটিশও দেয়া হয়েছিল। ওই নোটিশ হাতে পাওয়ার পরে নারদ সংলগ্ন বেশ কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা দখলদাররা স্বেচ্ছায় অপসারণ করে নিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্ট একটি সুত্রে জানাযায়, ওই উচ্ছেদ অভিযানের সময় নাটোরের সকল নদ-নদী দখল উচ্ছেদ সহ সংস্কারের জন্য এক হাজার ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। বরাদ্দকৃত অর্থের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্থ ভুমিহীনদের পুনর্বাসনে যোগান দেয়ার জন্য বলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারী সাময়িকীকে জানান, ৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই নারদ নদ এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে টুকু চোখে পরে তাতেও পানি নেই। নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত র্বজ্য সহ ময়লা আবর্জনা। দখলের কারণে নদের আকার হয়েছে পয়ঃপ্রনালী নিস্কাসনের ড্রেনের মত।
এই নদে মানুষের প্রয়োজনে স্লুইস গেইট, কালভার্টসহ প্রায় ৩৮টি স্থাপনা রয়েছে। যা এখন কোন কাজেই আসেনা। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী অবেধভাবে গড়ে তোলা আরো ৪২ টি স্থাপনা রয়েছে। এসবের মধ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এসব স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। তবে জনদাবির প্রেক্ষিতে নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ‘বড়াল বেসিন প্রকল্প’ নামে নারদ নদের খননকাজ শুরু করে। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারদ খননের জোরালো দাবি ওঠে। ওই দাবির ফলে নারদ নদ, মুসাখাঁ নদীর আংশিক এবং চারঘাট স্লুইস গেটের ইনটেক চ্যানেল পুনঃখনন প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পর কিছু কাজ করা হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে আর কোন প্রকল্প অনুমোদিত না হওয়ায় সংস্কার এলাকাগুলো পুর্বের অবস্থায় ফিরে আসলে শুরু হয় দখলের প্রতিযোগীতা। তিন দফায় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে প্রায় ১৩ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।’
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডে সদ্য যোগদানকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মকলেছুর রহমান সাময়িকীকে জানান, তিনি দু’দিন হলো এই কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। এখনও কিছুই জানা হয়নি। বিষয়গুলি জেনে বলতে হবে, বলে বলেন তিনি।
সচেতন নাগরিক কমিটির (টিআইবি)‘র সাবেক সভাপতি ও এম.কে কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক সাময়িকীকে জানান, ‘যেখানেই পানি সেখানেই জীবন, শক্তি ও প্রকৃতির বেঁচে থাকা। নিরাপদ পানি ক্রমেই আমাদের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। একশ্রেনীর মানুষ নিজেদের স্বার্থে নদ-নদীর পানি দুষিত করছে, দখল করছে।
অবৈধ দখলের কারনে নদ-নদী ধুকছে পানি শুন্যতায়। নাটোরের নারদও সেই পথে সামিল হয়েছে অনেক আগেই। একটি কিংবা দুটি নয় একাধিক কলকারখানা স্থাপনের পর থেকে এককালের খরস্রোতা নারদ নদ ধুকছে পানি শুন্যতায়। প্রাণএ্রগ্রো লিমিটেড, কিষোয়ান, যমুনা ডিষ্ট্রিলারিজ ও নাটোর চিনিকলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদে।
ফলে মাছ সহ জলজ প্রাণি মারা যাচ্ছে। নদ তীরের জমিতে ভাল ফসলও হয়না। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। এছাড়া বাঁধ বা রাস্তা নির্মান সহ দখলের কারনে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নারদ। নদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে দখল ও দুষণমুক্ত করা সময়ের দাবী।
দখল মুক্ত করার পর পরিকল্পিতভাবে খননের মাধ্যমে নদের প্রশস্ততা ও গভীরতা বৃদ্ধি করে পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা জরুরী। এজন্য নদ-নদীর পক্ষে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।’
নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মো. রবিউল আওয়াল সাময়িকীকে জানান, নারদ নদের বর্জ্য মিশ্রিত পানি ব্যবহারকারীদের অধিকাংশ চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছেন। তাদের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।’
সিংগারদহ গ্রামের বাসিন্দা আমজাদ, সাবের আলী ও জংলী গ্রামের আবু তাহের সাময়িকীকে জানান, ‘এসব কারখানা স্থাপনের পর থেকে তারা খুব সমস্যায় রয়েছেন। রাতে যখন মিল থেকে বর্জ্য নির্গত করা হয়, তখন মানুষের বিষ্টার মত দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
উৎকট গন্ধে বাড়িতে টেকা দায়। বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ঘরের টিন ঝড়ে পড়ে। আসবাব পত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না। এখন আমাদের প্রানের দুঃখ এই কারখানাগুলো।’
এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রাণ গ্রুপের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গ্রুপের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, প্রাণ গ্রুপের কোনো কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নারদ নদে ফেলা হয় না। কারখানার ভেতরে বর্জ্য শোধন করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। কোম্পানির বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনেরও কোনো অভিযোগ নেই।
যমুনা ডিষ্টিলারিজের জেনারেল ম্যানেজার অশোক ভাদুরি সাময়িকীকে জানান, ‘যমুনা ডিষ্টিলারিজ কারখানায় বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা হিসেবে এটিপি প্লান্ট রয়েছে। মিলের শুরুতে যখন এটিপি প্লান্ট ছিলনা তখনও পরিবেশ যেন দুষিত না হয় সে জন্য একাধিক পুকুর খনন করে সেখানে বর্জ্য রাখা হতো। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র তাদেরও রয়েছে বলে তিনি জানান।’
নাটোর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু বক্কর সাময়িকীকে জানান, ‘নাটোর চিনি কলে অনেক আগে থেকেই বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে। বর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে আখ স্বল্পতার কারনে মৌসুমে খুব অল্প সময় মিল চালু থাকে।
আখ স্বল্পতার কারনে এক থেকে দেড় মাস মিল চালু রাখা সম্ভব হয়। এই স্বল্প সময়ে যে পরিমান আখ মাড়াই হয় তার বর্জ্য নদ-নদীতে ফেলার দরকার হয়না। কেননা এটিপি প্লান্টের মাধ্যমে তা সহজেই শোধন করা হয়।’ এদিকে কিষোয়ান কোম্পানীর সাথে এবিষয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ সাময়িকীকে জানান, ‘তিনি সম্প্রতি নাটোরে যোগদান করেছেন। যতটুকু জানতে পেরেছেন, ইতিপুর্বে নারদ নদের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা স্থগিত রয়েছে। নদী রক্ষা কমিটির পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে তিনি দখল ও দুষণের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার রয়েছেন।’
নাটোর সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাময়িকীকে জানান, ‘করোনা মহামারির আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী নদ-নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়।
সে সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন যারা ভুমিহীন দখলদার, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের বাসস্থানের জন্য ঘর তৈরী করে দেয়া হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে তিনি প্রশাসনকে সহযোগিতা করবেন।