আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। নাটোরে অনেক পর্যটনকেন্দ্র থাকলেও পর্যটকদের জন্য কোন সুব্যবস্থা নেই! অথচ নাটোর হতে পারে পর্যটন শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবার কথা বলা হলেও কার্যত আজ স্থবিরতা বিরাজ করছে এ সমস্ত উন্নয়ন কার্যক্রমে।
আর বিভিন্ন সময়ে বাধা হয়েছে, তথাকথিত নাটোরের সচেতন নাগরিকরাই। নাটোর উত্তরা গণভবন নিয়ে শুরু হয়েছিল পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের বেশ কিছু কর্মকান্ড। একটি মামলায় তা স্থবির হয়ে পড়ে আছে। মামলাটির তদবির করার কেউ নেই!
নাটোরের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটগুলোতে দর্শনার্থীরা আসলেও নাটোরে পর্যটকদের থাকবার ভালো পরিবেশ ও জায়গা না থাকার কারণে পর্যটকরা আসতে চান না নাটোরে। পর্যটকদের অনীহার একটি অন্যতম কারণ এটি।
আমরা জানি না কবে এই সমস্যা গুলোর সমাধান হবে। নাটোরের হালতির বিল এলাকায় একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে তার বাস্তবায়ন কবে হবে তা নিয়েও আমরা শঙ্কিত।
আমরা চাই সকল বাধা কাটিয়ে নাটোরের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট মহল, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সকল পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে নাটোর সারাদেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হবে পর্যটন নগরী হিসাবে এমন প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
আসুন আমরা জেনে নিই নাটোরের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য…..
নাটোর রাজবাড়ি: রাজা রাম জীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ সালে, মতান্তরে ১৭১০ সালে। ১৭৩৪ সালে তিনি মারা যান। ১৭৩০ সালে রাণী ভবানীর সাথে রাজা রাম জীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের বিয়ে হয়। রাজা রাম জীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের রাজা হ
১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বিশাল জমিদারির রাজধানী নিজ জন্মভূমিতে স্থাপনের নিমিত্তে রঘুনন্দন, রাম জীবন ও পণ্ডিতবর্গ তৎকালীন ভাতঝাড়ার বিলকে নির্বাচন করেন। ভাতঝাড়ার বিল ছিল পুঠিয়া রাজা দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। এজন্য রঘুনন্দন ও রামজীবন রাজা দর্পনারায়ণের নিকটে বিলটি রায়তী স্বত্বে পত্তনীর আবেদন করেন।
নতুন রাজাকে রাজা দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তোর দান করেন। রামজীবন বিলে দীঘি, পুকুর ও চৌকি খনন করে সমতল করেন এবং রাজবাড়ি স্থাপন করেন। এলাকাটির নামকরণ করেন নাট্যপুর।
রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। ছোট-বড় ৮টি ভবন আছে। ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। রাজবাড়ি বেষ্টন করে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। পুরো এলাকা ২টি অংশে বিভক্ত – ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হল শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির।
উত্তরা গণভবন: নাটোরের সবচেয়ে নজরকাড়া নিদর্শন দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ি। এই বাড়ির ঘড়িতে বাঁধা নাটোরের তিনশত বছরের ইতিহাস। এর অবস্থান নাটোর শহরের উত্তরে লস্করপুর পরগনায়। ১৮ শতকের শুরুতে নাটোর শহরের পত্তন ঘটেছে দীঘাপাতিয়ার এই রাজবাড়িকে ঘিরেই।
১৭৩৪ সালে রাজা দয়ারাম রায় শহরের অদূরে দীঘপাতিয়া এলাকায় ৪১ একর জমিতে নির্মাণ করেন এই রাজবাড়ি।এই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে সাধারণ এক রাজ কর্মচারীর জমিদার হয়ে ওঠার কাহিনী। দয়ারাম রায় ছিলেন রাম জীবনের বিশ্বস্ত কর্মী।
দয়ারামের কর্মে তুষ্ট হয়ে রাম জীবন তাকে দান করেছিলেন অনেকগুলো পরগনা। নিলামে আরও কয়েকটি কিনে দয়ারামের জমিদারি শুরু। রাজবাড়ির অন্দরমহল এখনও আগের মতোই সাজানো-গোছানো। দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণজুড়ে কাচারিবাড়ী, বসতবাড়ি, বাগানবাড়ি, পোর্টেটসহ চোখ জুড়ানো সব স্থাপনা।
উত্তরা গণভবনের প্রবেশ পথের বিশাল ফটকটিতে আছে বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি। ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন। প্রাসাদের ভেতরে ও বাহিরে আছে শোভা বর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির দূর্লোভ গাছের সমাবেশ আর সমারোহ।
প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ গোলাপ বাগান। দ্বিতল হলুদ ভবন কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। নিচতলা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান পরিলক্ষিত হয়।
কামানগুলোর স্থাপনকাল ১৭৯৯ সাল। বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতি। ইতালিয়ান গার্ডেন উত্তরা গণভবনের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম ইতালি থেকে আনিয়েছিলেন।
ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি উপভোগ্য। বেঞ্চগুলো কোলকাতা থেকে আনানো হয়েছিলো। পাহাড়ি কন্যা পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙ্গা। হাতের কব্জিটির স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করা ছিল। সে সময় পাকিস্তানী সেনারা হাতটি ভেঙে স্বর্ণ লুট করে নিয়ে যায়।
১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নামকরণ করেন উত্তরা গণভবন। একটি নগর জনপদের পত্তন ঘটানো আকর্ষণীয় এই বাড়ী শুধু কাব্যশৈলীই নয়, বুকে ধরে আছে ইতিহাসের কাব্যগাঁথা।
নাটোর হালতিবিল: নাটোর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হালতি বিলের অবস্থান।প্রায় ৪০ হাজার একর জুড়ে বিস্তৃত এক জলাশয়। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল এটি। নাটোর, নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে এই জলাভূমি।
এই বিল বছরের ৬ মাস পানিতে পূর্ণ আর বাকি ৬ মাস থাকে শুকনো। বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ থাকে পানিতে, তখন এটি মাছের অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত হয়। আর শুকনো মৌসুমে পুরো বিল জুড়ে চলে ফসলের চাষ। তবে বর্ষাকালই হালতিবিল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে অথই জলরাশি। ঢেউ আর ঢেউ। সেই ঢেউ ভেঙে ছুটে চলে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা। মাঝেমধ্যে দিগন্তরেখায় সবুজের কারুকাজ। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একেকটি গ্রাম।
প্রতিটি গ্রামের ওপারে আবার দিগন্তজোড়া জলরাশি। আর এই বিলের ভিতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি দ্বীপ খোলাবাড়িয়া, দিঘীরপাড়, একডালা, কুচকুড়ি, নুরিয়াগাছা। যেন সাগরের বুকে একগুচ্ছ দ্বীপ।
নাটোরের চলন বিল: চলন বিল, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমিগুলির একটি। দেশের সর্ববৃহৎ এই বিলটি বিভিন্ন খাল বা জলখাত দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলি ছোট ছোট বিলের সমষ্টি।বর্ষাকালে এগুলি সব একসঙ্গে একাকার হয়ে প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার একটি জলরাশিতে পরিণত হয়।
বিলটি সংলগ্ন তিনটি জেলা নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এর বিশাল অংশ জুড়ে অবস্থান করছে।চলন বিলের উত্তর সীমানা হচ্ছে নাটোরের সিংড়ার উপজেলার পূর্ব প্রান্ত থেকে ভদাই নদী পর্যন্ত টানা রেখাটি যা নাটোর, পাবনা ও বগুড়া জেলার মধ্যবর্তী সীমানা নির্দেশ করে।
লুর্দের রাণী মা মারিয়ার ধর্মপল্লী: নাটোর জেলার দক্ষিণে বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার ৫টি ১ নং জোয়াড়ী ৫ নং মাঝগ্রাম ইউনিয়নের ২টি সহ মোট ৭টি গ্রাম নিয়ে এই ধর্ম পল্লী প্রতিষ্ঠিত। এই ধর্মপল্লীকে বলা হয় লুর্দের রাণী মা মারীয়া ধর্মপল্লী তথা বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন। খ্রিস্টধর্ম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে বলা হয় খ্রিস্টমন্ডলী বা সংক্ষিপ্তাকারে শুধু মণ্ডলী।
স্থানীয়ভাবে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী জনসাধারণকে পরিচালনা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা বা সেবা দানের উদ্দেশ্যে গঠিত অথবা পরিচালিত একটি সাংগঠনিক কর্ম এলাকাকে ধর্মপল্লী বলা হয়। ‘লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী’ ঈশ্বর পুত্র যীশু খ্রিস্টের জাগতিক জননী মারীয়া বা মরিয়ম-এর পুণ্য নামের স্মৃতিতে উৎসর্গিত।
এখানে ১৯৪০ সালের দিকে প্রথম স্বর্গীয় ফাদার থমাস কাত্তানের(পিমে), একজন ইতালীয় ধর্মযাজক সর্ব প্রথম আসেন এবং এখানকার গীর্জাঘরটি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে।এই ধর্মপল্লীর পুরো এলাকাটি দারুণ স্নিগ্ধ শোভায় পরিপূর্ণ। দৃষ্টিনন্দন গির্জাসহ মা মারিয়ার চমৎকার মূর্তি, ফুলের বাগান সবকিছুই মুগ্ধকর।
এছাড়াও নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় রয়েছে চিনিডাঙ্গা পদ্মবিল, প্রমথনাথ বিশীর জন্মভিটা। সদর উপজেলায় রয়েছে ধড়াইল জমিদার বাড়ি। গুরুদাসপুর উপজেলায় রয়েছে চলনবিল জাদুঘর। লালপুর উপজেলা রয়েছে গোঁসাই আশ্রম এবং নবনির্মিত গ্রীন ভ্যালি পার্ক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।