ব্যাপ্তিতে মহাসমুদ্র। উচ্চতায় হিমালয়। বিপুল কর্মকাণ্ড আর গভীর তার প্রভাব। অসংখ্য মানুষ তাঁকে বুঝবার, তাঁর কর্মকাণ্ডের নাগাল পেতে চেষ্টা করেছেন। সকলেরই স্বীকারোক্তি, মানুষটি সম্বন্ধে কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা মাত্র। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বাংলা ভাষা সংস্কারক। সমাজের অশিক্ষা কুসংস্কার দূরীকরণে নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু শুধু সমাজ সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার এবং সাহিত্য কীর্তি দিয়ে এই বিশাল মাপের প্রতিভার পরিমাপ সম্ভব নয়। সে কারণেই দীর্ঘ সময়ে পেরিয়ে গেলেও বিদ্যাসাগরকে সম্পূর্ণ জানা গেল না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর- বিজ্ঞান ভাবনা আর কিছু প্রশ্ন
বাঙালি জীবনে তাঁর অবদান প্রতি বছরই শ্রদ্ধায় স্মরণ করি আমরা। তাঁর জন্মের দু’শো এক বছর আজ। শ্রদ্ধায় সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিন। তেমন হওয়াই উচিত।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বিচারে তিনি ‘যথার্থ মানুষ।’ কবি মাইকেল মধুসূদনের কাছে তিনি ‘দয়ার সাগর।’ দেড়শ বছর ধরে অসংখ্য গবেষক তাঁর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। বাঙালি গবেষকগণ বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার পরে নতুন কথা আমার কিছু বলবার নেই।
বলছি না তবে তবে উত্থাপন করছি একটি মাত্র প্রশ্ন। উনি যা দিয়ে গেলেন, তাকে রক্ষা করতে বা সমৃদ্ধ করতে পারলাম কি আমরা?
কোন বিষয় নিয়ে বলছি? বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশ সম্পর্কে বলছি। বাংলা বর্ণের সাথে পরিচয় করিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পীও তিনি। আবার বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনার প্রকরণ ও কৌশলও শেখালেন। অসংখ্য বিজ্ঞান শব্দের বাংলা পরিভাষাও তাঁর আবিষ্কার। ‘Science’ শব্দের বাংলা অর্থ যে ‘বিজ্ঞান’ — সে কথাও জানালেন তিনি। আর বিজ্ঞান বলতে কী বোঝায়, তাও লিখলেন। ‘বিজ্ঞান (science) পদার্থের তত্ত্ব নির্ণায়ক শাস্ত্র। যেমন জ্যোতির্বিদ্যা’। (সুত্রঃ জীবনচরিত)।
একজন মানুষ সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ ও কাব্য লিখছেন, বাংলা ভাষাকে উন্নতির উঁচু শিখরে নিয়ে গেলেন। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার পাঠ্যসূচি (সিলেবাস) রচনা করছেন। সাহেবদের সাথে বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে (বিখ্যাত বিদ্যাসাগর-ব্যালান্টাইন বিতর্ক) নিজের মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোন্ ধরনের দর্শনবিদ্যা অধ্যয়ন করবে সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা, এই নিয়েই বিদ্যাসাগর-ব্যালান্টাইন বিতর্ক। ব্যালান্টাইনের মত ভাববাদী দর্শন আর বিদ্যাসাগর চাইছেন বস্তুবাদী দর্শনের পাঠক্রম। এখানেও প্রকাশ পেয়েছে বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তাধারা।
তাঁর ‘বোধোদয়’ বইটি ধর্মবাদীদের আক্রমণ সহ্য করেছে। মিশনারি জন মার্ডক ‘বোধোদয়’কে আক্রমণ করে বলছেন, বইটিতে ধর্ম বা ঈশ্বরের কথা বলা নেই। ‘বইটি চূড়ান্ত বস্তুবাদের উদাহরণ।’ জন মারডক তখনকার খৃস্টান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির কর্তাব্যক্তি। তাঁর মত, ‘নিরীশ্বরবাদী’ পুস্তক ছোটদের পাঠ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। ‘বর্ণপরিচয়’ বইটিও মারডকের আক্রমনের শিকার। কী কারণে আক্রমণ? ‘বইটিতে (৬৭ পাতার বর্ণপরিচয়) কোথাও ঈশ্বরের কথা লেখা নেই’।
প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের একটি ভাবনা এখনও আদর্শ হিসাবে বিশ্বব্যাপী সমর্থিত। ছাত্রদের ধর্ম যেমনি হোক, শিক্ষক সে-বিষয়ে কখনই হওস্তক্ষেপ করবেন না। ‘The teachers are expressly forbidden to interfere with the religion of the children in any way, directly or indirectly…’
আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দেশ ও সমাজের প্রবল বিরোধিতা সত্বেও বিধবা বিবাহ প্রচলন করেছেন। বাল্যবিবাহ রোধে প্রয়াস নিয়েছেন। এই সব কর্মকাণ্ডের পরও বলছেন বিজ্ঞান শিখতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষা বিনা জাতীর উন্নতির আশা নেই।
বিজ্ঞানী ছিলেন না বিদ্যাসাগর। ছিলেন যথার্থ বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি তিনি। ভাবনা চিন্তা, শিক্ষা বিস্তার, সমাজ সংস্কার যাবতীয় কাজের পেছনে ছিল স্বচ্ছ বিজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারে তিনিই (এবং অক্ষয় কুমার দত্ত) ছিলেন অগ্রদূত।
জীবন চরিত’ (প্রকাশ কাল ১৮৪৭) অনুবাদ গ্রন্থটিতে (মূল গ্রন্থ রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স প্রকাশনা) বিদ্যাসাগর বিজ্ঞানীদের জীবনী অনুবাদ করলেন। বইটিতে নয়টি জীবনীর মধ্যে পাঁচটিই বিজ্ঞানীদের জীবনী। কোন্ কোন্ বিজ্ঞানী? যাঁদের আবিষ্কার দুনিয়াকে আমূল বদলে দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা চরম কষ্টকর এবং প্রতিকূল জীবন বেছে নিয়েছেন। যেমন, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, হারসেল, লিনিয়াস। এখানেই শেষ নয়। এই বইটিতে আছে তাঁর তৈরি ৭৪ টি বিজ্ঞান প্রতিশব্দ।
আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখনীয়।সরকারের শিক্ষা বিভাগ তাঁর মতামত জানতে তিনটি বই পাঠিয়েছেন। পাঠ্য বই হিসাবে সেগুলো বিবেচনা করা যায় কিনা! প্রথম বই (The steam engine and East India Railway) সম্পর্কে বিদ্যাসাগর বললেন, বিশৃঙ্খল লেখার ধরন আর বইটির মূল বিষয় অন্য বিভাগে (পদার্থ বিদ্যা ও প্রাকৃতিক দর্শনে) পড়ান হয়। দ্বিতীয় বইটিও (The Electric Telegraph) বেশ অগোছালো।
আর তৃতীয় বইটি, (the vernacular Scholars Best Cmpanion to Geography) সম্পর্কে তাঁর মতামত আজকের একুশ শতকের দুনিয়াতে আমাদের অবাক করে দেয়। কী ছিল সেই মত? ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম কখনও এক সারিতে বসতে পারে না। বিজ্ঞানের আছে নিজস্ব ধ্যান ধারনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পদ্ধতি। কেমন করে জন্ম নিল মহাবিশ্ব, আমাদের পৃথিবী, তার সাগর পর্বত, ভুমিকম্পের কী কারণ, এ সব তত্ত্ব সম্পর্কে ধর্মের ব্যাখ্যা ভূগোল বইটিতে স্থান পেয়েছে। তাই এই পুস্তক পাঠে ছাত্রদের বিজ্ঞান ভাবনার বিকাশ ঘটবে না। কাজেই এই বই বিদ্যালয়ে পাঠ্য হওয়া কখনই উচিত নয়।
বিজ্ঞান প্রচার আর বিজ্ঞান মনস্কতা শুধু নয়। বৈজ্ঞানিক আবিস্কারও (Technology) করেছিলেন তিনি। নিজস্ব মুদ্রন যন্ত্রে ব্যবহার করা যাবে এমন নতুন অক্ষর (ছাঁচ) তৈরি করিয়েছেন। অক্ষর গুলো ছোট ছোট বিভিন্ন খোপে সাজানো থাকতো। তাঁর আবিস্কারের মধ্য দিয়ে সে কালের বাংলা মুদ্রন ব্যবসারও প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। জনপ্রিয় বিজ্ঞান (Popular Science) বাংলা ভাষায় লেখা হয়। অনেক গুলো পত্রিকা প্রকাশ করে সেই সব রচনা। বহু সাহিত্য পত্রিকাতেও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ স্থান পায়।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা শুরু করলেন বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত। এই দুই মনিষীর দু’শ বছরের জন্ম জয়ন্তী পালানও করছি আমরা। দুশো বছর, সময় নেহাৎ কম নয়। অথচ এখনও বাংলা ভাষায় কোন বিজ্ঞান গবেষণা পত্র লেখা যায় না। তেমন পত্রিকাই যে নেই! যেমন জাপানী ভাষায় আছে GANN, (Japanese journal of cancer research), জার্মান ভাষায় আছে Angewandte Chemie, ইস্রায়েলে আছে হিব্রু ভাষায় Havefuah, ফরাসী ভাষায় আছে La revne di medicine interne ।
দুশো বছরের জন্মদিন! কম তো হল না। প্রতি বছর তাঁর ছবিতে মালা দিলাম। আর সৃষ্টি করলাম নাকি উৎকৃষ্ট মানের বহু আধুনিক শব্দ! অফিস-কাছারি কল কারখানায় বংলা ভাষার প্রচলন তুলে দিলাম। কোন টেকনিক্যাল বিষয় বাংলাতে লিখতে বা বলতে পারি না। এমন কি হওয়ার কথা ছিল?
আচার্য সত্যেন্দ্র নাথ বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। উচ্চ শিক্ষায়, এম এসসি ক্লাশেও সেগুলো ছিল পাঠ্য পুস্তক। তারপর?
বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান রচনার প্রয়াস হারিয়ে গেল। স্মরণে আসে আচার্য সত্যেন বোসের উক্তি, ‘যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।‘
তবুও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় ভাটা পড়ে গেল। বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনা হয়েছে। বিজ্ঞান পরিভাষাও সৃষ্টি হয়েছে অনেক। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণা পত্র (রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে) প্রকাশিত হল না। কারণ কি ভাষার অসম্পূর্ণতা নাকি লেখক গবেষকদের বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা?
বিদ্যাসাগরের দু’শ বছরের জন্ম দিবস পালনের বিস্তৃত মঞ্চে এই প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক নয় কি?