পর্ব – নয়: উত্তর নেই
গ্যালাক্সির ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে বাইরের দিকে ছুটে আসতে থাকা অবিশ্রান্ত কণা রেডিয়েশনের উত্তাল প্রবাহের মতোই, রংধনুর সাতরং প্রবল বেগে ছুটে এসে ডুবে যেতে লাগল উত্তাল জলরাশির মধ্যে। চন্দন সুভাসিত স্রোতের মধ্য দিয়ে পথ কেটে সাগরতলে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থান নেওয়ার পর কণাস্রোত ধারণ করল মানবমূর্তি। অপূর্ব! পুরো দেহকাঠামো আর মনঃসত্তা বুকে ধারণ করে নতুনত্বের চোখ মেলে চোখ খুলল অর্ণব। জলের গর্জনের সঙ্গে মিশে গেল মানব গর্জন। সাগরের উল্লসিত হুংকারের পাশাপাশি সুললিত কণ্ঠের নজরুল সুরও ভেসে এলো তার কানে- ‘খেলিছ এ বিশ্ব ল’য়ে; বিরাট শিশু আনমনে’… গানে মগ্ন হলো অর্ণব।
কে খেলছে? বিরাট শিশুটা কে? নানা প্রশ্নের ফাঁক দিয়ে অর্ণবের নস্টালজিক মনে হানা দিল উর্বশীর কণ্ঠে শোনা রবীন্দ্রসুর- ‘আজি শুভ দিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চলো যাই’… শুভ দিন কোনটি, অমৃত সদন কোথায়?
সমুদ্রের তলদেশে বসেও উল্লসিত জলরাশির মধ্যে ও নীরবতার নতুন আবহ টের পেতে লাগল। এক ফাঁকে কানে ভেসে এলো মাকে বলা উর্বশীর উত্তাল আবেগের সুর-লয়- ‘রংধনু হয়ে অর্ণব সাগর থেকে উঠে আসে, জড়িয়ে রাখে আমাকে। তোমাদের মধ্যে থাকলে ওর সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হব। আশা করি, আমার ইচ্ছার প্রতিকূল কোনো কাজ করবে না।’
স্বরবিতানের আনুষ্ঠানিক সংগীতের স্বরলিপি নয়, গীতিকারের অন্তর্মুখী জাগরণের নিঃসংশয়ী লয় ঝংকৃত হয়ে উঠল জীবনতারের নতুন গিটারে। এই গিটার স্পর্শ পায় কোত্থেকে? জাগতিক জগতের বাইরে এসে পড়লেও নিজের অবস্থান কি নয় কোনো কল্পজগতের অলীক সাম্রাজ্যে। বাস্তবতা আর কল্পনার ফারাক এখানে নেই। তাহলে কি বাস্তবতার কণাস্রোতেই ঘুরপাক খাচ্ছে কল্পজগতের হিগ্স বোসন কণা? হকিং রেডিয়েশনের কণার স্রোতও কি বিরাজমান পুরো গ্যালাক্সির সর্বত্রই? বিভাজন রেখা কোথায়? আদৌ আছে কি বিভাজনের কোনো জটিল সূত্র? এই মুহূর্তে কোনো বিভাজন রেখা খুঁজে পাচ্ছে না অর্ণব। তাই মনে মনে বলে উঠল, ‘উর্বশী! নিঃশব্দের দূরত্ব অতিক্রম করে থাকো। শব্দময় জগতে তোমার শব্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার সত্তা। আমার সত্তাও কি স্পর্শ করছে তোমায়?’
বর্ণছটা রঙিন কণায় বদলে যেতে লাগল। অর্ণবের অপ্রকাশিত চিন্তা আর উচ্চারিত শব্দ ও বাক্যের ভেতর থেকে ছুটে বেরোনো বর্ণমালারা রং-বেরংয়ের ঢেউ তুলে জলরাশির মধ্যে জাগিয়ে তুলল অন্তহীন এক তাণ্ডব। এ তাণ্ডবে ধুয়ে যেতে লাগল নতুন রূপে জেগে ওঠা অর্ণবের দেহ-মন। নতুন রূপে ভর করছে নতুন উপলব্ধি। ভাবছে, কণাস্রোতে কীভাবে বদলে যাই নিজে? কীভাবে সাগরগর্ভ থেকে উঠে যাই পাহাড়চূড়ায়? কীভাবে বিপণ্ন উর্বশীর পাশে দাঁড়ালাম? অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে কীভাবে আক্রমণ করলাম ভয়ঙ্কর শত্রুর ওপর? আপন ভাবনায় ভর করে অর্ণব বুঝতে পারল কাঁকড়ার কামড়ে পায়ের ত্বকের উন্মুক্ত কোষের গ্রাহকযন্ত্র, রিসেপ্টরের মধ্যে দিয়ে ওয়েব পোর্টালের মতো সংযোগ ঘটে যাচ্ছে উভয়ের মাঝে। ঘটতে থাকা অবিশ্বাস্য ঘটনা আর সব প্রশ্নের খেলামেলা উত্তর না মিললেও প্রশ্নের শান থেকে চন্দন আলোর বিকিরণ ঘটতে লাগল মস্তিষ্কে! অথই সাগরতলে আলোই বা এলো কীভাবে? এত অতলে তো আলো থাকার কথা না, আলো ঢোকার কথা না। ও শুনেছিল সাগরতলে যতই নিচে নামা যায় প্রতি দশ মিটার গভীরতার জন্য বাড়তে থাকে এক অ্যাটমোসফিয়ার হাইড্রোস্টাটিক প্রেসার। কত গভীরে আছে ও? কল্পরথ চেপে ধরে জানান দিল প্রায় ছয়শ অ্যাটমোসফিয়ার চাপের মধ্যে আছে ও। সঙ্গে সঙ্গে পরিমাপ করে ফেলল নিজের অবস্থান- স্পষ্টই কণাস্রোতের ঢেউ খেলে গেল। চোখের সামনে প্রথমে ভেসে উঠল ৬ সংখ্যাটি। তারপর তুষারপাতের মতো ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরতে লাগল মেরিন স্রোত। মাইক্রোস্কোপিক তুলার কণা রূপ নিল বাংলা বর্ণের- বদলে যাওয়া বর্ণরূপ থেকে জ্বলজ্বল করে ফুটে বেরুল একটি শব্দ- ‘মাইল’।
চমকে উঠল অর্ণব। তাহলে কি সাগরতলে ছয় মাইল বা ৬০০ কিলোমিটার তলে বাস গেড়েছে ও?
বিস্ময়ের ঘোর থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগল এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। এ এক ভাগ কি স্থির সময়, স্থির বিন্দু, কণাস্রোতের মৌলিক কণার অস্তিত্ব। এটাই সময়ের প্রতীকী বিন্দু! বিন্দুর অস্তিত্বও তো বিন্দুহীন! কী করে সম্ভব- এসব ভাবনা আসতে লাগল ওর মাথায়।
সম্ভব-অসম্ভবের দ্বার খুলে গেল না। তবে অর্ণব অনুভব করল ‘মেরিন স্রোত’ পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেহে শক্তিসঞ্চার হচ্ছে। তারুণ্য আর সতেজ অনুভব ছড়িয়ে যেতে লাগল দেহকোষে; আবেগের প্লাবন এলো মনে। সেই সজীবতা! সেই আবেগ! বিয়ের রাতে যেমন অনুভবে ঋদ্ধ হয়েছিল, একই অনুভবের চাপ বাড়তে লাগল দেহের কোষে, নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঘটে গেল বিপ্লব। অ্যানার্জির আধার দেহকোষের অভ্যন্তরের মাইটোকনডিয়াতে তুফান উঠল, শক্তির তুফান। জলের গভীর তলের বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যেমন জলজ প্রাণির অভ্যন্তরীণ প্রেসার আর বাইরের প্রেসারের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হয়ে যায় তেমনি সমন্বিত চাপ তৈরি হলো নিজের ভেতর-বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের পিচ্ছিল অনুভবও কমে যেতে লাগল, ত্বক যেন সংকুচিত হয়ে কমিয়ে ফেলল দেহের সাইজ, আকার-আকৃতিও। কোষগুলোও সংকুচিত হয়ে বাইরের চাপ সামলে টিকে থাকার অভ্যন্তরীণ রসদ বা শক্তির উৎস পেয়ে গেল। অন্তরের অদৃশ্য আঁধার থেকে নতুন আলোর বিকিরণ ঘটতে লাগল- হকিং রেডিয়েশন কণার মতো এ কণাস্রোত জানান দিতে লাগল টিকে থাকবে ও, এ বিরূপ পরিবেশেও ধ্বংস হবে না। তাহলে কি কারও ধ্বংস নেই? এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে চলে আসে জীবিত কিংবা জড়, সব অস্তিত্বই কি বেঁচে থাকে আলোর কণারূপে?
উত্তর নেই। শূন্য হাতে ও ফিরে আসে প্রশ্নের ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে। ব্ল্যাকহোল কেন্দ্রের শক্তির মাধ্যমে সৌরজগতের সবকিছু টেনে নিলেও বের করে দিতে বাধ্য হয় হকিং রেডিয়েশন কণা। সব কিছুই তো হজম করতে পারে না নির্দয় আর নির্মম কালোগর্ত। ভাবতে ভাবতে হো হো করে হেসে উঠল অর্ণব। হাসতে হাসতে আবার ভাবল, কিছুই বিলীন হয় না। মানুষও বিলীন হবে না। দেহত্যাগ করলেও কণার অস্তিত্ব নিয়ে ভেসে বেড়াবে গ্যালাক্সিতে। যেভাবে সে আবার পেয়েছে মানবরূপ সেভাবে না হোক, অন্য কোনো প্রক্রিয়ায়, যা কারও জানা নেই, একমাত্র কণার একক অস্তিত্বের মধ্যে আত্মার গোপন অবস্থান থেকে জেগে উঠবে। হাশরের ময়দানে হাজির হওয়ার মতো? পুনর্জন্মে বিশ্বাসীদের হাত ধরে?
কিন্তু এখানে একাকী থাকবে কীভাবে? সাগর তলে কি আছে কোনো মানব জগৎ? সে জগতের উঁচু দেয়ালের বাইরে কি আসন পেয়েছে ও? নতুন কোনো শক্তির উড়ালস্রোতে কি টপকাতে পারবে সে অচেনা দেয়াল? সেই দেয়ালের ওপারে কি তবে ফিরে আসবে উর্বশী?
না। উর্বশীকে সাগরতলে এনে কষ্ট দিতে চায় না ও। আলো-বাতাসের জগতে সংগ্রাম করে টিকে থাকুক। মায়া-মমতার সংসারে মায়ার ঘোরে ডুবে থাকুক। নিজের স্বার্থের জন্য তাকে এখানে নিয়ে আসার কথা ভাবা অন্যায়।
ওপরের দিকে তাকাল অর্ণব। আঁধার রাজ্যেও আছে তার চোখের আলো। এ আলোর উৎস নিয়ে এখন আর ভাবছে না ও। তবে দেখছে সাগরজলের ওপরের দিকে রয়েছে সূর্যের আলোকময় বহিরাবরণ; বহির্তল। এ আলোকময় জলস্তরের নাম জানা নেই ওর।
আচমকা কিউ জেগে উঠল। কণাস্রোতের ঘূর্ণি উঠল চোখের সামনে। সেই ঘূর্ণি থেকে ফুটে উঠল একটি শব্দ ‘ফোটিক জোন’। এই স্তর থেকে ঝুর ঝুর করে পরতে পরতে ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে তুষারের হালকা রাশি রাশি টুকরো। ঝরতে থাকা তুষারস্রোত আবার নৈরাশ্য হটিয়ে দিল, তাড়িয়ে দিল মনের দ্বিধা। উর্বশীর জন্য গেয়ে উঠল- ‘দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়… তোমার আপন হাতের দোলে।’
নিজের সত্তার ভেতর থেকে আবেগ মুছে যায়নি। ভেবে খুশি হলো। স্থির বিন্দু থেকে ছলকে বেরুল একই সঙ্গে বেদনার কণাস্রোত- উর্বশীকে ছাড়া আবেগ পুষে লাভ কি? কেন বা রইল আবেগের আলোকময় সূর্য! ঝুরঝুর করে আবারও নেমে এলো তুষারকণা। তুষারকণা শুষে নিয়ে এসেছে আলোর কণা। একই আলোককণার স্রোত একই সময়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে উর্বশীকেও। ভাবতে গিয়ে আনন্দে ভরে উঠল মন। কালো গর্ত রঙিন হয়ে উঠল। যে-আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে তার চোখ, সে-আলোই তো ঢুকছে উর্বশীর চোখেও। একই বিন্দু থেকেই তো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সব। দূরত্ব কোথায়? না। দূরত্ব নেই। স্থির বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলল অর্ণব। পরানের গহিন ভেতর থেকে কণাস্রোতে ভর করে বেরিয়ে এল দুর্বিনীত এক চিৎকার… উ..র্ব..শী…
উত্তর ফিরে এলো না। উত্তরের হৃদয়ও এ মুহূর্তে খুঁজে পেল না অর্ণব। কেবল দেখতে লাগল কোটি কোটি সফেন কণারাজির ফল্গুধারা- উদ্দাম আর দুরন্ত গতিতে উড়ে যাচ্ছে ওপরের দিকে…
চলবে…