বরিশালের প্রত্যন্ত এলাকার আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত এক পরিবারের একমান কন্যা তামান্না জাহান (২০) বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী একজন অটিষ্টিক তরুনী এবং চিত্রশিল্পী। নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রম থাকলে যেকোনো কাজেই যে সফলতা পাওয়া যায়, তামান্না তারই উদাহরণ হয়ে উঠেছেন।
তামান্নার বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামে। জন্ম ১৯৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি। স্থানীয় হাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওবায়দুল কবির ও আফরোজা বেগমের একমাত্র মেয়ে তামান্না।
তার বয়স যখন ২ বছর, তখন অপ-চিকিৎসায় তিনি বাক্ ও শ্রবণশক্তি হারান। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর শারীরিক অসুস্থতায় তার লেখাপড়া আর এগোয়নি।
তবে ছোটবেলা থেকে আঁকি আঁকির অভ্যাস। নিজে নিজে আপন মনে আর খেয়াল খুশী নিয়ে তিনি বসে যান তুলি আর রং নিয়ে। তখন তাঁর ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে ওঠে নানারকম ছবি। তিনি তার প্রতিবন্ধী জীবনের প্রতিবন্ধকতা জয় করে হয়ে উঠেন চিত্রশিল্পী।
তামান্না বছর দুয়েক চারুকলা বরিশাল-এ ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। চারুকলা বরিশাল-এর সংগঠক সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘তামান্না অনন্য প্রতিভাধর। দুই বছর আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নিলেও, তিনি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ায়, সেটা তার এবং আমাদের জন্য ছিল খুব দুরূহ। আমরা ওর মাকে বোঝাতাম। ওর মা আমাদের কথাগুলো তামান্নাকে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি কিছুটা শিখেছেন। কিন্তু ওর প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য তার আরও পরিচর্যা দরকার।’
প্রতিবন্ধী হলেও রং-তুলি হাতে তামান্না অনন্য। নিরলস চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছেন চিত্রশিল্পী। তাঁর আঁকা ছবিগুলো প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, স্বাধীনতা, সমাজের অবহেলিত মানুষের ছবি আর প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার।
এক সময় দীর্ঘ এক যুগের জন্য ওমান-প্রবাসী ছিলেন তামান্নার বাবা ওবায়দুল কবির। অসুস্থতার জন্য সেখান থেকে দেশে ফিরে দেখেন আত্মীয়স্বজনের হাতে পাঠানো প্রবাসে অর্জিত রক্তে নিঙরানো আয় ও সঞ্চয় সব খোয়া গেছে।
প্রতিবন্ধী কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে শুরু করেন বাড়ীর কাছের হাটে ক্ষুদ্র ব্যবসা। কিন্তু নিজের শারীরিক অসুস্থতায় এ ব্যবসার দায়-দায়িত¦ও বর্তায় স্ত্রীর কাঁধে। প্রতিবন্ধী কন্যা আর অসুস্থ স্বামীকে দিনে কাটতে থাকে তাদের সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।
তামান্নার বাবা কয়েক বছর ধরে অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী। মা রূপালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গুঠিয়া বন্দরে কাঁচামাল, সবজী বিক্রি করে জীবন ও সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন।
আফরোজা বেগম বললেন, ‘মাত্র দুই বছর বয়সে হামে আক্রাšত হয়ে “ভুল চিকিৎসায়” বাক্ ও শ্রবণশক্তি হারায় তামান্না। এরপর চিকিৎসা দিয়েও কাজ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই অন্য শিশুদের চেয়ে একটু আলাদা ছিল। মেধা তাকলেও পঞ্চম শ্রেণি পর আর পড়াশুনা এগোয়নি। তার বাবাও এখন অসুস্থ।’
কিন্তু সংসারের এ টানাপোড়েনের মধ্যেও তামান্নার শিল্প-চর্চা থেমে থাকেনি। তিনি অব্যাহত রাখেন ছবি আঁকার জগতে তার পদচারণা । বিভিন্ন সময়ে বরিশালের অশ্বিনীকুমার টাউন হল, শিল্পকলা একাডেমী, সার্কিট হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও স্থানে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন তামান্না।
এ ছাড়াও সমাজকল্যান বিভাগের অনুদান পেয়ে মার কিনে দেয়া সেলাই মেশিনে তৈরি করেন নানা রকম পোশাক। এলাকার ছোট ছেলে-মেয়েদের শেখান ছবি আঁকা ।
একই এলাকার বাসিন্দা তামান্নার মামা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কারও ওপর নির্ভরশীল না-হয়ে ছবি আঁকার পাশাপাশি হাতের কাজ শিখছেন তামান্না। চেষ্টা করছেন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার।’
তবে তামান্নার পরিবারের আর্থিক অনটন তাঁর এই প্রতিভা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা এবং উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে তিনি এই প্রতিভাকে আরও শাণিত করতে পারতেন।
উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণতি বিশ্বাস বলেন, ‘তামান্না খুব সুন্দর ছবি আঁকেন। কিন্তু করোনার কারণে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাঁকে আমরা সেইভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। অবশ্যই তাঁর প্রতিভা বিকাশে আমরা পাশে থাকব।’