সময়টা ষোড়শ শতক৷ ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার পাটওয়াড়ি গ্রাম৷ এই গ্রামেই পন্ডিত বংশীদাস ভট্টাচার্য বাস করতেন৷ তিনি দ্বিজ বংশীদাস নামেই খ্যাত ছিলেন৷ তাঁর বিখ্যাত রচনা “মনসার ভাসান।” বংশীদাস ভট্টাচার্যর স্ত্রীর নাম সুলোচনা দেবী৷ বংশীদাস ভট্টাচার্য ও সুলোচনা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন চন্দ্রাবতী, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের মধ্যমনি৷ এমন প্রতিভাময়ী কবির জীবনটা কিন্তু বড়ই যন্ত্রণার। পাটোয়ারী গ্রামের অদূরেই সন্ধ্যা গ্রাম, চন্দ্রাবতীর বাল্যসখা সেখানেই থাকেন।
ছেলেবেলা থেকেই তাদের একত্রে বড় হয়ে ওঠা। পড়াশুনো একসঙ্গেই হয়। এভাবেই দুটো কিশলয় বড় হয়ে ওঠে। যৌবনের সন্ধিক্ষণে মনের ভাব বিনিময় হয়। কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে দেখে বংশী ঠাকুর জয়ানন্দের সঙ্গে বিবাহ স্থির করেন। উভয়ের অন্তরের ভালবাসা বংশী ঠাকুরের কাছে গোপন ছিলনা। জয়ানন্দ সুপুরুষ ছিলেন চন্দ্রাবতীও অপরূপ সুন্দরী।
ঋতু শ্রেষ্ঠ বসন্তকালে দুজনের শুভদৃষ্টি বিনিময়ের আয়োজন হল। এমন সময় জয়ানন্দের জীবনে আকস্মিক এক পরিবর্তন ঘটল। এক মুসলমান তরুনীকে দেখে জয়ানন্দ আকৃষ্ট হলেন। চন্দ্রাবতীকে গ্রামের সবাই ভালবাসে। তার বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে তখন আনন্দের বন্যা চলছে। এমন সময় এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ এল। জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন এবং গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এই ঘটনায় চন্দ্রাবতীর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরল। তার সকল স্বপ্ন আশা নিমেষে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। চন্দ্রাবতী পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেলেন। তার চোখের জল শুকিয়ে গেল। মুখের ভাষা নিরব হয়ে গেল। চারিদিকে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। চন্দ্রাবতীর এরকম অবস্থা দেখে স্নেহময় পিতা বড় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। এদিকে নানা জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে লাগলো। কিন্তু চন্দ্রাবতী অনড়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে আর বিয়ে করবেন না। শিবের আরাধনা করেই বাকি জীবনটা কাটাবেন। চন্দ্রাবতীর ইচ্ছানুযায়ী ফুলেশ্বরী নদীর ধারে শিব মন্দির তৈরি হলো। চন্দ্রাবতীও পূজা অর্চনায় মন দিলেন। আর তার সঙ্গে চলল কাব্যচর্চা। এই সময় তিনি রামায়ণ রচনা করলেন। এখানে চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ করা হলো।
“শয়ন মন্দিরে একা গো সীতা ঠাকুরাণী,
সোনার পালঙ্ক পরে গো ফুলের বিছানী৷
চারিদিকে শোভে গো তার সুগন্ধী কমল,
সুবর্ণ ভৃঙ্গার ভরা গো সরযূর জল৷
নানা জাতি ফল আছে সুগন্ধে বসিয়া,
যাহা চায় তাহা দেয় গো সখিরা আনিয়া৷
ঘন ঘন হাই উঠে গো নয়ন চঞ্চল,
অল্প অবশ অঙ্গ গো মুখে উঠে জল,
উপকথা সীতারে শুনায় আলাপিনী,
হেনকালে আসলে তথায় গো কুকুয়া ননদিনী,
কুকুয়া বলিছে বধূ গো মন বাক্য ধর৷
কিরূপে বঞ্চিলা তুমি গো রাবণের ঘর?
দেখি নাই রাক্ষসে গো শুনিতে কাঁপে হিয়া,
দশমুন্ড রাবণ রাজা গো দেখাও আঁকিয়া,
মূর্চ্ছিতা হইলা সীতা গো রাবণ নাম শুনি,
কেহ বা বাতাস দেয় গো কেহ মুখে পাণি৷”
চন্দ্রাবতীর রামায়ণের মৌলিকত্ব তাকে কবি প্রতিভার অমরত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছে। আজও ময়মনসিংহ জেলার ঘরে ঘরে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গীত হয়। কৃত্তিবাসের পর যারা রামায়ণ লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে চন্দ্রাবতী অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করে যেতে পারেননি। সীতার বনবাস পর্যন্ত লিখেই তাকে থেমে যেতে হয়েছিল।
চন্দ্রাবতী “কেনারাম”, “মহুয়া” প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র কাব্যও লিখে গিয়েছেন। বংশীদাসের বিখ্যাত “মনসার ভাসান “এও চন্দ্রাবতীর অনেক রচনাই স্থান পেয়েছে।
বুক ভরা ব্যথা নিয়ে চন্দ্রাবতীর জীবনের অধ্যায় শেষ হয়েছিল। সময়টা তখন বৈশাখ। গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রকৃতি তখন জর্জরিত। চন্দ্রাবতী রামায়ণ রচনায় তখন আত্মমগ্ন হয়ে আছেন। এমন সময় চন্দ্রাবতী একখানি চিঠি পেলেন।
জয়ানন্দ তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে একটি চিঠি লিখেছেন। সে আজ ক্ষমাপ্রার্থী।
চিঠিটা পড়ে চন্দ্রাবতীর দুচোখ জলে ভরে উঠলো। অতীতের স্মৃতিগুলো আবার মানসপটে ভেসে উঠলো। চন্দ্রাবতী বংশীদাসকে সব কথা জানালেন। বংশী দাস মেয়েকে দেবতার কাছে চিত্ত সমর্পণ করতে বললেন।
চন্দ্রাবতীও জয়ানন্দ কে সান্ত্বনা দিয়ে এই মর্মে চিঠি লিখলেন যে, জয়ানন্দ যেন নিজেকে দেবতার পায়ে় সঁপে দেন তাহলে সে তার সকল যন্ত্রনা ভুলবে। জয়ানন্দ চিঠি পেয়ে মন্দির অভিমুখে ছুটলেন। মন্দিরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতী শিব পুজোয় মগ্ন হয়ে আছেন। জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে পাগলের মত ডেকে চললেন। দরজা কিন্তু খুললো না। জয়ানন্দ তখন সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিংড়িয়ে দরজার কপাটে কবিতা লিখলেন।
তারপর সেখান থেকে নদীর দিকে চললেন। পূজা শেষ করে চন্দ্রাবতী দরজা খুলে বাইরে এলেন। যখন দরজা বন্ধ করবেন তখন সেই কবিতা তার চোখে পরলো। কবিতাটা পড়ে তিনি বুঝলেন জয়ানন্দ মন্দিরে এসেছিল এবং তার আসায় মন্দির অপবিত্র হয়েছে। চন্দ্রাবতী তখন জল আনতে নদীর ঘাটে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন অনুতপ্ত জয়ানন্দের নিথর দেহটা পড়ে রয়েছে। এরপরে চন্দ্রাবতী একেবারে ভেঙে পড়লেন। এক গভীর বিষাদের ছায়া তার মনজুড়ে নেমে এলো। এভাবেই একদিন দুঃখ জর্জরিত মন নিয়ে শিব পূজা করতে করতে চন্দ্রাবতী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। পড়ে থাকল তার লেখা রামায়ণের অসম্পূর্ণ পাতা।
কিন্তু চন্দ্রাবতী এখনো হারিয়ে যাননি। মানুষের মনে আজও তিনি বেঁচে আছেন। এখনো কান পাতলে পূর্ব ময়মনসিংহের সর্বত্র তার গান শোনা যায়। এই প্রসঙ্গে চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, “শ্রাবনের মেঘ ভরা আকাশ তলে ভরা নদীতে যখন বাইকগণ, সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান , বিবাহে কুল কামিনীগণ নব বর-বধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে— সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশা খেলা তাহার সঙ্গীত সে কত রকম৷”