দ্বিজেন শর্মার থাকা ও না–থাকা

মশিউল আলম
মশিউল আলম
23 মিনিটে পড়ুন
দ্বিজেন শর্মা, ছবিটি তুলেছেন নাসির আলী মামুন

১৫ সেপ্টেম্বর ভোরে দ্বিজেন শর্মা চোখ বুজলেন, আর খুললেন না। তার ফলে কী ঘটল আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পাইনি। মৃত্যু মানে যে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ তা ওই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি। তার পরেও পারিনি। এখনও, তিন-তিনটা বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, ওই ব্যাপারটা যেন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ, এখনো আমার ফোনবুকে তার নাম্বারটা আছে, এবং আমার ভ্রম হয়, যেকোন সময় আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠবে, ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাব: Kaka. ফোনটা কানে ধরার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাব তার উচ্চকিত কণ্ঠ: ‘কী রে ববি, আসিস না কেন?’ কিংবা, ‘কী পড়ছিস ইদানীং?’

আচ্ছা, ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভোররাতে ওই ঘটনা ঘটল। ১৭ তারিখে আমরা তাকে নিয়ে গেলাম পুরান ঢাকার সবুজবাগ শ্মশানে। সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে আমাদের চোখের সামনে কী ঘটল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আগুন, ধোঁয়া আর ধূপের গন্ধ। আগুনের শব্দ। তারপর কালো রঙের ছোট্ট একটা মাটির কলস। তার মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। কেউ কি কিছু বলল? ওই কলসের ভিতরে কী? ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা কুলাউড়ার বড়লেখার শিমুলিয়া গ্রামে গেলাম। পাথারিয়া পাহাড়ের কোলের সেই গ্রাম। [১৯৩১ সালের ২৯ মে ওই গ্রামে তার আবির্ভাব ঘটেছিল।] নিকড়ি নামের নদীটা কোন দিক দিয়ে বয়ে গেছে কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি। ওটা আমার মনের মধ্যে আছে, তাই থাক। কাকার দেহভস্ম গাছতলায় সমাহিত হলো। এক টুকরো রোদ এসে পড়ল তার ওপর: লাল টকটকে চারটা গোলাপ। কাকার দুই প্রবাসী ছেলেমেয়ে বক্তৃতা করল। আমার মনে পড়ল কাকার মায়ের বাণী: ‘সুখী সেই জন, যে অঋণী ও অপ্রবাসী।’

কাকার দুই ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই সুখী নয়, আমি জানি। তারা প্রবাসে কাঁদে। কিন্তু ফিরে আসতে পারে না। তাদের দেশ নাই। কাকার দেশটাও ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেছে। সাতচল্লিশে দুই টুকরো, একাত্তরে তিন টুকরো। সাতচল্লিশে গোটা শিমুলিয়া গ্রামের অর্ধেক মানুষ রাতারাতি দেশান্তরিত হয়েছে। কাকার মা মগ্নময়ী দেবী যাননি। তিনি শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। একাত্তরে মিলিটারি এসে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিল। গোটা গ্রাম পুড়ে ছাড়খার। সব মানুষ দৌড়ে পালিয়ে গেল ইন্ডিয়া। কিন্তু মগ্নময়ী দেবী শ্বশুরের ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে রইলেন। তিনি যাবেন না। সেই মায়ের ছেলে প্রবাসী হলো। কিন্তু অসুখী হলো কি? না। মগ্নময়ীর খোকা বড় হয়ে একটা দেশকে স্বপ্নের দেশ বলে জেনেছিল। সেই দেশের নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরিণত বয়সে সে সেই দেশে গেল। সেই দেশের গাছ ফুল পাখি ও মানুষকে ভালোবাসল। তারপর সেই দেশটা হঠাৎ একদিন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেল। এইবার খোকা দুঃখ পেল। সে স্বদেশে ফিরে এল। এবার সে অপ্রবাসী ও অবশ্যই অঋণী। এইবার সে পরিপূর্ণ সুখী।

খোকা লেখাপড়া করে গাছ চিনেছিল। তারপর অন্যদের গাছ চেনানোর জন্য উদ্যানে উদ্যানে ঘুরে বেড়াল, পত্র-পত্রিকায় অনেক লিখল। তার ভক্ত আর শিষ্যে ভরে গেল দেশ। আমিও তার ভক্ত। কিন্তু আমার গাছ চেনা হলো না, আমি মানুষটাকে চিনলাম। দ্বিজেন শর্মাকে আমি চিনি। তার অন্তর জুড়ে শুধু ভালোবাসা, শুধু স্নেহ, শুধু বাৎসল্য। তার সান্নিধ্য পেয়েছে কিন্তু ভালোবাসা পায় নি এমন হতভাগা কেউ ত্রিভুবনে নাই।

- বিজ্ঞাপন -

২.

সিদ্ধেশ্বরীর ক্রিস্টাল গার্ডেন নামের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের আট তলার ভাড়া বাসায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিনটা ২৩ জুলাই, ২০১৭ সাল, রোববার। সকালের দিকে ভালোই ছিলেন, হকার পত্রিকা দিয়ে গেলে পড়লেন। সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে বামপন্থি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। তিনি সেটা মন দিয়ে পড়লেন। বিকেলের দিকে অসুস্থ বোধ করলেন। শ্বাস নিতে কষ্ট। তাকে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলো। সেখান থেকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে। পরদিন করোনারি কেয়ার ইউনিটে। সেখানকার চিকিৎসকেরা বললেন তার হার্ট ফেইলিওর হয়েছে, ফুসফুসে পানি জমেছে। হৃৎরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মহিবুল্লাহর তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা শুরু হলো।

২৫ জুলাই মঙ্গলবার সকাল ৯টার কিছু পরে আমি করোনারি কেয়ার ইউনিটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে দেখতে পেলেন। আমি দেখতে পেলাম, তিনি চিত হয়ে শুয়ে আছেন, নাকে দুটো চিকন নল। চেহারা খুব অসুস্থ নয়, মুখে স্নেহভরা হাসি। দূর থেকেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই এসেছিস, কাছে আয়।’ আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বললেন, ‘তোর নেওয়া বদরুদ্দীন উমরের ইন্টারভিউটা আমি পড়েছি। এ বিষয়ে আমার অনেক কথা বলার আছে। আমি এখান থেকে বের হয়ে আসি, তারপর তোকে বলব।’

আমি হেসে বললাম, ‘নিশ্চয়ই বলবেন, আমরা আপনারও একটা ইন্টারভিউ নেব।’

তারপর তিনি তার লেখা আত্মজীবনীর প্রসঙ্গ তুললেন, সেটা তিনি এক বছর আগেই লিখে শেষ করেছেন, কম্পোজ করা হয়েছে এবং বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই ওটা ভালো করে দেখে দিবি। তোর দেখাটাই ফাইনাল।’

- বিজ্ঞাপন -

আমি বললাম, ‘বইটার একটা ভূমিকা থাকলে ভালো হতো। কাকে ভূমিকা লিখতে বলব?’

তিনি বললেন, ‘দেবী [শর্মা], হায়াৎ [মামুদ] কিংবা হাসান [আজিজুল হক] লিখলে ভালো হয়।’ তারপর বললেন, ‘দেবীর না লেখাই ভালো, আর হায়াতের তো ডিমেনশিয়া, হায়াৎ লিখতে পারবে না। তুই হাসানকেই বল। হাসান খুব ভালো লিখবে।’

আমারও তা-ই মনে হলো। আমি জানি, দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের খুব অন্তরঙ্গ স্মৃতি আছে।

- বিজ্ঞাপন -

এই কয়েকটি কথা বলার পরেই তিনি বললেন, ‘তোকে তো এখানে বেশিক্ষণ থাকতে দেবে না। তুই এখন যা।’ খুব পরিষ্কার চোখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন। আমার মনে হলো না যে তিনি গুরুতর অসুস্থ। তবে চিকিৎসকরা যখন বলছেন, তার হার্ট ফেইলিওর হয়েছে এবং ফুসফুসে ফ্লুয়িড জমেছে, তখন বিষয়টা নিশ্চয়ই সামান্য নয়। পরদিন সকালে আবার তাকে দেখতে গেলাম। আজ তার মুখমণ্ডল একটু ফোলা, চোখে একটা ঘুম ঘুম ভাব, চোখের সাদা অংশটা একটু ঘোলাটে। কিন্তু কথা বললেন স্বাভাবিকভাবেই: ‘পাণ্ডুলিপিটা আনিয়ে নিস। ভালো করে দেখে দিস। হাসানকে বলিস, আমার ইচ্ছা ও-ই ভূমিকাটা লিখে দিক। আর হ্যাঁ, বদরুদ্দীন উমরের ইন্টারভিউটার কথা কিন্তু মনে রাখিস। আমি বেরিয়ে এসেই তোকে সব বলব।’ বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকারটার বিষয় ছিল ভারত উপমহাদেশে বামপন্থি রাজনীতির অতীত ও বর্তমান। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে দ্বিজেন শর্মার গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি দীর্ঘ দুই দশক সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলেন। সমাজতন্ত্রে বসবাসের বিশদ অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। চোখের সামনেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া দেখেছেন। সমাজতন্ত্র নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার পড়ে তার নিশ্চয়ই অনেক কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল।

করোনারি কেয়ার ইউনিটে ডা. মহিবুল্লার তত্ত্বাবধানে দ্বিজেন শর্মার শুধু হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসের চিকিৎসা চলছিল। অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। ডাক্তাররা বলছিলেন, তার ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাচ্ছে। আমার সাধারণ ধারণা, রক্তে ইউরিয়া আর ক্রিয়েটিনের মাত্রা বেড়ে যায় কিডনির সমস্যার কারণে। কিন্তু তার কিডনির দিকে যে নজর দেওয়া হচ্ছে না, এটা তখনো পর্যন্ত জানতে পারি নি। ফুসফুসের ফ্লুইডের জন্য মনে করা হচ্ছিল ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে, পালমোনারি হাইপারটেনশন হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী ইনফেকশন হয়েছে তা শনাক্ত করা হয় নি। সে জন্য ফুসফুসের ফ্লুয়িডের নমুনা পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা করা সম্ভব হচ্ছিল না। নিউমোনিয়া ধরে নিয়ে ব্রড স্পেকট্রামের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হচ্ছিল। কিন্তু তার ফলে তার কিডনি যে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছিল না। রক্তে ইউরিয়া আর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, তবু কোনো নেফ্রোলজিস্টকে ডাকা হয় নি।

পরদিন আমি তার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। মুখমণ্ডল বেশ ফুলে গেছে, হাত দুটিও বেশ ফুলেছে, পা ফুলেছে। অর্থাৎ তার কিডনি দ্রুত গতিতে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছিল। এই দিন তিনি আমাকে আধবোজা চোখে বললেন, ‘তোকে এখানে থাকতে দিবে না। তুই এখন যা। কাল আসিস।’

উভয় কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে, রোগী অচেতন হয়ে পড়ছেন, এমন সময়, ২৯ জুলাই, অর্থাৎ ভর্তি হওয়ার ৫ দিন পর, বারডেমের নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞ সরোয়ার ইকবালকে ডাকা হলো। তিনি এসে রোগীর রিপোর্ট দেখে বললেন, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিতে হবে। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হবে। এই সময় বারডেমেরই আরেকজন চিকিৎসক, আমার আপনজন, সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করার সুবাদে দ্বিজেন শর্মার স্নেহধন্য, তিনি তাকে দেখতে এলেন। দেখার পরে করোনারি কেয়ার ইউনিট থেকে বেরিয়ে আমাকে বললেন, ‘আহা, অবস্থা তো ভালো না। মাল্টি সিস্টেম ইনভলব হয়ে গেছে।’

অর্থাৎ, করোনারি কেয়ার ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় হার্ট ফেইলিওর ও ফুসফুসে ফ্লুয়িড নিয়ে একজন রোগী ৫ দিন ধরে মাল্টি অর্গান ফেইলিওরের দিকে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেখানে কোনো কমপ্রিহেনসিভ বিশেষজ্ঞ কনসালটেশনের ব্যবস্থা করা হয় নি। ফুসফুসের ইনফেকশন আশঙ্কা করে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলো যে উচ্চমাত্রায় নেফ্রোটক্সিক বা কিডনির জন্য ক্ষতিকর ছিল, সেটা পরে আবিষ্কার করবেন দেবী শর্মার কলকাতা নিবাসী বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. দেব রঞ্জন চক্রবর্তী। ৩০ জুলাই ভোর ছটায় আমি বারডেম হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের মাইকের ডাকে ছুটে যাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি রোগীর কে। এই প্রশ্নের মুখোমুখি জীবনে আর কোনোদিন হই নি। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রথমে বলি আমি দ্বিজেন শর্মার ছাত্র, তার পরে বলি, আমি তার সন্তানের মতো। কিন্তু ডাক্তার বলেন, ‘আপনাকে দিয়ে হবে না, ফ্যামিলির কাউকে ডাকেন তাড়াতাড়ি।’

আমি দেবী কাকিকে ফোন করলাম। তিনি দ্রুত চলে এলেন। ডাক্তার বললেন, ‘রোগীর কিডনি ডায়ালাইসিস করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তার রক্তচাপ খুব কম, তা ছাড়া একটা ইনফেকশন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকম অবস্থায় ডায়ালাইসিস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু ডায়ালাইসিস করতেই হবে। এখন আপনাদের অনুমতি প্রয়োজন।’

দেবী শর্মা বললেন, ‘ডায়ালাইসিস ছাড়া অন্য কোনো উপায় না থাকলে ডায়ালাইসিস করুন। আমার আপত্তি নাই।’

‘তাহলে আপনাকে একটা সিগনেচার করতে হবে।’ দেবী শর্মা মুচলেকা স্বাক্ষর করলেন: ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে দ্বিজেন শর্মার মৃত্যু ঘটলে চিকিৎসকরা কিংবা বারডেম কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন না।

ডায়ালাইসিস শুরু হলো। দ্বিজেন শর্মা লড়াই চালিয়ে গেলেন। চিকিৎসকরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, রোগীর উন্নতি হচ্ছে। বিরতি দিয়ে দিয়ে বেশ কয়েকবার ডায়ালাইসিস হলো। যে ইনফেকশন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বলা হয়েছিল সে-প্রসঙ্গে আর কিছুই বলা হলো না। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে লাইফ সাপোর্ট ছাড়াই দ্বিজেন শর্মার অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। এইভাবে ৯ আগস্ট বলা হলো, রোগী এখন ঝুঁকিমুক্ত। সচেতন অবস্থায় দ্বিজেন শর্মাকে ভিআইপি কেবিনে নেওয়া হলো। কিন্তু বারডেমের ভিআইপি কেবিনে বড় চিকিৎসকেরা আকাশের চাঁদ। সেখানে রোগীকে দেখেন অল্পবয়সী চিকিৎসকেরা। সম্ভবত শিক্ষানবিস। সেরকম এক ডাক্তার বললেন, সব ঠিক আছে, ‘পেশেন্ট সাইর‌্যা উটতেছে।’ ইতিমধ্যে মস্কো থেকে ছেলে সুমিত্র শর্মা টুটুল আর লন্ডন থেকে মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা মুন্নী চলে এসেছেন। তারা খুব যত্ন করছেন। তারা তাদের কলকাতার ডাক্তার মামাকে চিকিৎসার আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন। কেবিনে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার সেবা-শুশ্রূষায় দ্বিজেন শর্মা প্রথম দুদিন ভালো ছিলেন। কথা বলছিলেন অনেক। তখন আমি তার সঙ্গে অনেক কথা বললাম। অতীতের অনেক কথা। বর্তমানের কথা। গাছের কথা, ফুলের কথা। রমনা উদ্যানে বেড়ানোর কথা। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার কী হয়েছিল?’ আমি বললাম, ‘আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।’

আইসিইউতে থাকার দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে পারছিলেন না। আমরা তাকে সব বললাম। তিনি তারপর বললেন, ‘আমি বাসায় যাব না? রমনায় হাঁটতে যাব না?’ আমরা তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, অবশ্যই, অবশ্যই।

লন্ডনপ্রবাসী মেয়ের ছুটি শেষ হয়ে এল। তাকে ফিরে যেতে হবে। সে চলে গেল। দুদিন পর ছেলেকেও মস্কো ফিরে যেতে হলো। তারপর রোগীর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। বড় ডাক্তারেরা আসেন কালে-ভদ্রে, কিন্তু রোগীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার সময় তাদের হয় না। ছোট ডাক্তারেরা বলেন, সব ঠিক আছে।

ভিআইপি কেবিনে দ্বিজেন শর্মা চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রাপ্য মনোযোগ ও চিকিৎসা পেলেন না, নার্সদের শুশ্রূষা পেলেন না। তার রক্তে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে গেল। কারণ, তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল কিন্তু কার্বন-ডাই অক্সাইড ফুসফুস থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ব্রেথ আউট করানোর প্রয়োজন ছিল, সেটার নির্দেশনা নার্সদের দেওয়া হয়নি বলে নার্সরা সেটা করেননি। ফলে রোগী প্রায় অচেতন হয়ে পড়ার অবস্থা হলে তাকে আবার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হলো ১৮ আগস্ট। এবার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তার লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হলো।

এবার আইসিইউতে নেওয়ার পর তিনি আর ভালো চিকিৎসা পান নি বলে আমার ধারণা। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, রোগীর বয়স ৮৮ বছর, তার মাল্টি সিস্টেম ইনভলবড হয়ে গেছে, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা বৃথা। এইভাবে শেষ প্রায় দুই সপ্তাহ তাকে স্রেফ ফেলে রাখা হলো। এর মধ্যে একবার বলা হলো, রোগীর ডান ফুসফুস সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেছে। তারপর বলা হলো, রোগীর মেনিনজাইটিস হয়েছে। এইভাবে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বারডেমের আইসিইউতে দ্বিজেন শর্মা ছিলেন। সেখানকার চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না, তাদের আর কিছু করার নেই। তখন দেবী শর্মার বড় ভাই ডা. দেব চক্রবর্তী [ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে ঢাকা চলে এসেছেন] বারডেমের চিকিৎসকদের একটা পরামর্শ দিলেন: ‘আপনারা এখন রোগীকে স্রেফ পেনিসিলিন দিন।’ বারডেমের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বারডেমে পেনিসিলিন ব্যবহার করা হয় না। ওটা ১৭ বছর আগেই ডিসকন্টিনিউ করা হয়েছে।’

ডা. দেব চক্রবর্তী বললেন, ‘তবু আপনারা দিন। আমি বলছি কাজ হবে।’

বারডেমের চিকিৎসকেরা বললেন, ‘আমরা এটা করতে পারি না। কারণ এটা আমাদের প্রটোকলে নাই।’

তখন দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী ও পুত্র [মস্কো থেকে আবার ফিরে এসেছেন] মরিয়া হয়ে এগিয়ে এলেন। তারা বললেন, ‘রোগীকে পেনিসিলিন দিলে কী হবে? আমাদের আর কী হারনোর আছে? আপনারা রোগীকে পেনিসিলিন দিন।’

হাসপাতালের বাইরের দোকান থেকে মাত্র ৩০ টাকা দামের পেনিসিলিন কিনে এনে রোগীকে প্রয়োগ করা হলো। সম্পূর্ণ অচেতন রোগী ১৮ ঘণ্টার মাথায় চোখ মেলে তাকালেন। তখন রোগীর স্বজনেরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁকে বারডেম থেকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করবেন। বারডেম কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলো রোগীর অবস্থা স্থানান্তরযোগ্য কি না। তারা বললেন স্থানান্তরযোগ্য।

১৩ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় দ্বিজেন শর্মাকে চোখ মেলে তাকানো অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলো। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকেরা তার সার্বিক অবস্থা দেখে বললেন, বড্ড দেরি করে এবং বেশ খারাপ অবস্থায় তারা তাকে পেয়েছেন, তবে প্রাণপণে চেষ্টা করবেন। স্কয়ার হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসকরা দ্বিজেন শর্মার শরীরে গুরুতর বেড সোর দেখতে পেলেন। ডা. দেব চক্রবর্তীও সেই বেড সোর দেখলেন এবং বললেন, গুরুতর সেফটিসেমিয়া হয়ে গেছে। এই সেফটিসেমিয়াই রোগীর জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।

একদিন পর, ১৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৪ টা ৪৫ মিনিটে স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বললেন, দ্বিজেন শর্মা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর চূড়ান্ত মেডিকেল কারণ শক [ফল অব ব্লাড প্রেশার] এবং সেফটিসেমিয়া।

৩.

দ্বিজেন শর্মা, দেবী শর্মা, সুমিত্র শর্মা, শ্রেয়সী শর্মা, দেব রঞ্জন চক্রবর্তী, মনীষা চক্রবর্তী, সাহানা চৌধুরী মমি, মোকারম হোসেন, তুঘলোগ আজাদ মিঠুসহ আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই দীর্ঘ প্রাণান্তকর যাত্রায় আমিও ছিলাম। এ এক বিরল কষ্টকর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেন এক অতীন্দ্রিয় জগতে পৌঁছে যাওয়া যায়, যেখানে অবিরাম তুষারপাতের মধ্যে সবুজ পাতা সমেত দাঁড়িয়ে থাকে ফার ও পাইন গাছ; যেখানে গ্রীষ্ম আসে বনে বনে বার্চ, মেপল, অ্যাশ, ওক, পাইন আর উইলোর সবুজ পাতার উচ্ছ্রয় ঘটিয়ে, শরৎ আসে বনে বনে লাল-হলুদের সমারোহ নিয়ে, আর তখন মনে হয়, আগুন লেগেছে বনে বনে।

তারপরে পাথারিয়া পাহাড়ে চলে যাওয়া যায়, খরস্রোতা নিকড়ি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ভেসে যাচ্ছে মুলি বাঁশের ভেলা। দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে আমি লিখেছিলাম: পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে বিস্ময়ের কুয়াশায় জেগে উঠেছিল এক খোকা, যখন নিকড়ি নদীটি খুব চঞ্চল ছিল। সে খোকার মুখ দর্শন করতে এসে বুড়ো-বুড়িরা উপহার দিয়েছিল রুমাল: লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি, কমলা—বিচিত্র সব রং। স্বপ্নের মতো রঙিন সেইসব রুমাল সুতায় বেঁধে খোকার দোলনায় ঝুলিয়ে রেখেছিল তার সবচেয়ে বড় দিদি। খোকা একটু বড় হয়ে দিদির কাছে শুনবে, দোলনা দুলত আর হাওয়ায় দোল খেত নানা রঙের রুমালগুলো, তাই দেখে শূন্যে হাত-পা নাচাত খোকা। তার কচি মুখখানা সব সময় অনাবিল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত।

পরে দিদি আরও বলবে, জন্মের সময় খোকা কাঁদেনি। পৃথিবীতে তার প্রথম চিৎকার ছিল আনন্দ ধ্বনি। এসব কথা শুনে খোকা শুধু আপন মনে হাসবে, কিছু বলবে না। তার দিদি আরও পরে বলবে, খোকা স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে বেড়াত। শীতের এক পূর্ণিমা রাতে স্বপ্নের ঘোরে সে হেঁটে হেঁটে গিয়েছিল নদী দেখতে। খোকা ভেবে দেখবে, দিদির ভুল হয়েছে; স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল বড় দাদা প্রভাতের। খোকার এই ভাইটি নিকড়ি নদীটিকে খুব ভালোবাসত। শীতকালের নিকড়ি ছিল তার বিশেষ প্রিয়। রাতের এক প্রহর ঘুমিয়ে সে উঠে পড়ত, তারপর ভূতগ্রস্তের মতো ছুটে যেত নদীকে দেখতে।

বাবা বলতেন, ‘প্রভাত, রাতের বেলা ঘোরাঘুরি করিও না। সাপে কাটিবে।’ বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ, অখ্যাত কবি। চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিল তার নাম, লম্বা দাড়ি ছিল মুখে। নিজেকে নিয়ে তিনি এই রকম পদ্য রচনা করেছিলেন:

চন্দ্রকান্ত কবিরাজ মুখে লম্বা দাড়ি

ঔষধের ডিবি লৈয়া বেড়াইন বাড়ি বাড়ি।

পান-তামাক দিলে তিনি কিছু নাহি খাইন

সুন্দরী রমণী দেখলে আড় নয়ানে চাইন॥

বাবার ছিল ছটি ছেলেমেয়ে আর ছিল অনেক ফুলগাছ, আম-কাঁঠালের গাছ আর বনৌষধি। লোকে বলত কবিরাজ ঠাকুর। পৌষ-মাঘের শীতে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতেন; খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের ডাকতেন, ‘এই উঠো উঠো, গাছে জল দাও।’

গাছগুলো ছিল নবীন, গরু-ছাগলের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের ঘিরে রাখা হতো ‘হুপি’ দিয়ে; চিকন চোঙের মতো হুপিগুলো ছিল খোকার চেয়ে লম্বা, খোকা বদনা ভরে জল নিয়ে জলচৌকির উপর দাঁড়িয়ে তাদের গায়ে জল ঢেলে দিত। গাছের চারাদের গায়ে জল ঢেলে দিতে দিতে খোকা বড় হবে, পাঠশালায় যাবে; কিন্তু বশোই খোকার মতো পাঠশালা যাবার বয়সী হয়েও পাঠশালা যাবে না, সে চুরি করে আনবে মরিচ মার্কা সিগারেট। খড়ের গাদার আড়ালে বসে বসে তারা মরিচ মার্কা সিগারেটে আগুন ধরাবে, খোকা দুই টান দিয়ে বেদম কাশবে আর বলবে, বশোই, এটা ভালো না, সিগারেট খেতে নেই। কিন্তু বশোই জাম গাছে উঠে মরিচ মার্কা সিগারেট খেতে খেতে বড় হয়ে যাবে, তারপর শিমুলগাছে চড়ে পাখির বাচ্চা ধরে নিয়ে আসবে, সেই পাখির বাচ্চার গায়ে সাদরে হাত বোলাতে বোলাতে খোকা বলবে, ‘তুই বড় হ, ওই আকাশে উড়ে চলে যা…।’

স্থবির গাছেদের দেখে খোকার মনে বিস্ময় জাগেনি, প্রথম জেগেছিল পাখি দেখে। পাখি নিয়ে তার মা এই ছড়াটি বলতেন:

কাঁঠালগাছে দেখছি দুটো হলদে পাখির ছানা

মায়ের মুখে খাচ্ছে আধার নাড়িয়ে দুটি দানা।

সেই থেকে খোকা হলদে পাখির ছানা খুঁজে খুঁজে হয়রান। সঙ্গে বশোই, যে বশোই খুব দুষ্টু, যে মরিচ মার্কা সিগারেট চুরি করে এনেছিল। তারপর কখন ছেলেবেলার সেই খেলার সাথি কখন অজান্তে হারিয়ে গেছে, কিন্তু অশীতিপর বয়সেও সেই হারিয়ে যাওয়া কৈশোর মাঝে মাঝেই ফিরে আসত।

তিনি আমাকে সেইসব গল্প বলতেন, ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর খন্দকারের গলির ভাড়া বাসায়। গত শতকের ষাট দশক থেকে তার কেটেছে এই খন্দকারের গলিতেই, প্রথমে খন্দকার মঞ্জিল নামের এক দোতলা বাড়িতে, তারপর ক্রিস্টাল গার্ডেন নামের বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ভাড়া বাসায়।

ওই বাসার ড্রয়িংরুমে চওড়া একটা ডিভানে আধ-শোয়া হয়ে তিনি টিভি দেখতেন। বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে তাকে দেখা যেত। তাদের বাসার দরজা কখনো লক করা থাকত না; সব সময়ই কেউ না কেউ আসছে, যাচ্ছে। বেশির ভাগই দ্বিজেন শর্মার ভক্ত-শিষ্য, বন্ধু-বান্ধব। আমি তার বাসায় গিয়ে কখনো কলিং বেল বাজাই না। দরজার হাতলে হাত রেখে মোচড় দিলেই প্রায় নিশঃব্দে দরজা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ভেতরে দ্বিজেন শর্মা টিভি দেখছেন তার ডিভানে শুয়ে, কিংবা কেউ এসেছে, তার সঙ্গে গল্প করছেন, কিংবা কাকা আর কাকি গল্প করছেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ২৮ সেপ্টেম্বর তাদের ছেলে ও মেয়ে দুজনেই চলে গেলেন। একজন মস্কো, অন্যজন লন্ডন। কাকির ছোট ভাই হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তী তার মেয়ে মনীষা চক্রবর্তীর সঙ্গে বরিশালের বাড়িতে গেছেন কদিন আগে।

কলকাতার মামা-মামিও কলকাতা ফিরে গেছেন। বাড়িটাতে রয়ে গেছেন দেবী শর্মা একা, সঙ্গে শুধু গৃহ সহযোগী এক মহিলা যার নাম টগর। কাকি একা আছেন, এই ভেবে ৩০ সেপ্টেম্বর আমি তাঁর কাছে গেলাম। বরাবরের মতো দরজা নিজের হাতে খুলে ভেতরে ঢুকতেই জানালা দিয়ে চোখ গেল ড্রয়িংরুমের সেই ডিভানের দিকে, যেখানে আধাশোয়া হয়ে টিভি দেখতেন দ্বিজেন শর্মা। আজ দেখলাম, সেখানে একইভাবে শুয়ে টিভি দেখছেন দেবী শর্মা। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল, এমন এক অনুভূতি হলো যা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। আমার মনে হলো, নিঃশব্দে বাসা থেকে বেরিয়ে ফিরে চলে যাই। কাকি তো এখনও জানতে পারেননি যে আমি এসেছি, এসেছিলাম যে তাও বুঝতে পারবেন না।

কিন্তু ফিরে আসার জন্য আমার পা উঠল না। আমি নিঃশব্দে ড্রয়িংরুমে গিয়ে ঢুকলাম, আমার মুখ দিয়ে কোনো সম্ভাষণ বের হলো না, শুধু কাকির মুখের দিকে তাকালাম। কাকি উঠে বসতে বসতে সস্নেহ হেসে বললেন, ‘আসছিস, বস।’ আমি পাশের সোফায় বসলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। কাকিও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর টগরকে ডেকে আমাকে কিছু খেতে দিতে বললেন। একটু পরে কাকিকে বললাম, ‘একা এখানে আপনার খারাপ লাগবে কাকি, বরিশাল গিয়ে কদিন থাকলে ভালো হতো না? কিংবা লন্ডনে মুন্নীর কাছে?’

কাকি বললেন, ‘না রে, আমার এখন এখানেই থাকা দরকার। তোর কাকার গাছগুলা আছে, বইপত্র আছে, আমি এইসবের মধ্যে আছি। আমার খারাপ লাগছে না।’

‘আমার তো খারাপ লাগছে, কাকি।’

‘তোর কাকা তো আছে, কোথাও যায় নি তো। বুক শেলফে হাত দিলে আমি তাকে পাচ্ছি, গাছে পানি দিতে গিয়ে আমি তাকে পাচ্ছি, এই সোফায়, এই ডিভানে… সে তো সবখানে আছে…।’

আমি চুপ করে রইলাম। আমার মনে হতে লাগল আমি দ্বিজেন কাকার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। কারণ আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি না। আমি তার হাসি দেখতে পাচ্ছি না। তাকে আমার স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে ফেলা কোনো স্মৃতি বলে মনে হচ্ছে। তিনি যে বাস্তবেই ছিলেন এটাকেও একটা স্মৃতির স্মৃতি বলে মনে হচ্ছে…।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৬৮ সালে, বাংলাদেশের জয়পুরহাটে। পড়াশোনা সাংবাদিকতায়, মস্কোর গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় থাকেন, সাংবাদিকতা করেন; গল্প–উপন্যাস লেখেন, রুশ ও ইংরেজি থেকে ফিকশন ও নন–ফিকশন অনুবাদ করেন। সাতটি গল্পগ্রন্থ ও ১২টি উপন্যাসসহ তাঁর প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ৩৩। তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত, মাংসের কারবার, ঘোড়ামাসুদ ও জুবোফস্কি বুলভার তাঁর আলোচিত বই। দুধ নামে একটি গল্প শবনম নাদিয়ার অনুবাদে ২০১৯ সালে হিমাল সাউথ এশিয়ান শর্ট স্টোরি কম্পিটিশনে শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কার পায়। তাঁর মিট মার্কেট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ নামে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের অনুবাদের জন্য শবনম নাদিয়া ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পেন/হাইম ট্রান্সলেশন গ্রান্টস’ লাভ করেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!