‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’ আশির দশকে এবং নব্বই‘এর দশকে এই গানটি রেডিওতে প্রচারিত ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি‘ এবং ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত এই গানটি অগনিত শ্রোতার হৃদয়ে কারে। রেডিওতে গানটি শোনার জন্য বসে থাকতো অগণিত শ্রোতা।
সত্যিই কি নাটোরবাসী ভুলে গেছে মল্লিকাদির কথা? নাকি মল্লিকাদি ভুলে গেছে নাটোরের কথা? এমন প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে সাময়িকী। বিশ্ববরেণ্য কন্ঠশিল্পী, লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন ১৯৮৭ সালে সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্যে একুশে পদক পান।
বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পীর জম্ম ও বেড়ে ওঠা এককালের সংস্কৃতির শহর হিসেবে পরিচিত নাটোরে। অথচ নাটোরের বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেন না ফরিদা পারভীন সম্পর্কে আর যোগাযোগ না থাকায় অনেকেই ভুলে গেছেন তার কথা।
১৯৬৮ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে রাজশাহী বেতারে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন।‘নিন্দার কাটা যদি না বিঁধিল গায়’ শীর্ষক গানটির জন্য ১৯৯৩ সালে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসাবে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওকা অ্যাওয়াড পান।
অনেকেই মনে করেন নাটোরবাসী হিসাবে এটা আমাদের জন্যে সম্মানের এবং কিছুটা বিব্রতকরও বটে। সম্মানের কারণ হচ্ছে এত বড় গুণী শিল্পীর জন্মস্থান আমাদের নাটোরে। আবার বিব্রত হওয়ার পেছনে রয়েছে নাটোর জেলার পক্ষ থেকে শিল্পীকে দেয়া হয়নি তেমন কোনো সম্মাননা।
আবার কেউ কেউ অভিমানের সুরেই বলেছেন, শিল্পী নিজেও নাটোরের কথা তেমনভাবে কোথাও উল্লেখ করেন না। অথচ তার সংগীত সাধনার র্দীঘ সময় তিনি কাটিয়েছেন নাটোর পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের লালবাজার মহল্লায় অবস্থিত ‘মনোবীণা’ সংঘে।
তিনি সত্তরের দশকে এই ‘মনোবীণা সংঘ‘এর ছাত্রী ছিলেন বলে সাময়িকীকে জানান, প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শঙ্কর দাস। নাটোর শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে সিংড়া উপজেলার সাঐল গ্রামে ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরে মোল্লা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন।
বর্তমানে এই ভিটাবাড়ির তত্তাবধানে রয়েছেন তার চাচাতো ভাই আলহাজ্ব মখলেসুর রহমান মকুল। তিনি সাময়িকীর প্রতিবেদককে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফরিদা পারভীন‘এর দাদা-দাদীর কবর দেখান এবং বলেন তার শৈশবের নানা স্মৃতিবিজরিত কথা।
নাটোরের বিভিন্ন পেশা ও সংস্কৃতি অঙ্গন এবং শিল্পীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ফরিদা পারভীনের জন্মস্থান আর নাটোরের সঙ্গে বিচ্ছেদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় পাওয়া যায় নানা প্রতিক্রিয়া।
ফরিদা পারভীন‘এর চাচাতো ভাই আলহাজ্ব মখলেসুর রহমান মকুল মোল্লা সাময়িকীকে জানান, ‘১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরে মোল্লা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন।এই বাড়িতেই রয়েছে তার দাদা-দাদীর কবর। জীবনের বেশ কয়েক বছর তিনি এই বাড়িতে কাটিয়েছেন।
পিতা-মাতার একমাত্র মেয়ে ফরিদা পারভীন। তার বাবা দেলোয়ার হোসেন মোল্লা পেশায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। কর্মসূত্রেই তিনি বাবার সাথে কুষ্টিয়ায় চলে যান। পরিবারের কেউ সরাসরি সঙ্গীতের সাথে যুক্ত না থাকলেও বলা চলে নিজের প্রচেষ্টাতেই তিনি সঙ্গীত সাধনায় রত হন।’
ফরিদা পারভীন‘এর ভাতিজা লিটন মোল্লা সাময়িকীকে জানান, ‘প্রায় পনেরো বছরের মধ্যে তিনি তার ভিটাবাড়িতে আসেননি। আমরা তার আমানত সংরক্ষণ করে রেখেছি। প্রতিনিয়তই আমরা তার খোঁজখবর রাখি, তিনি সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, মহান আল্লাহ তাকে করোনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
নাটোরের কবি পলাশ সাহা সাময়িকীকে জানান, ‘ফরিদা পারভীনের জন্ম নাটোরে- তা আমার জানা ছিলোনা! আমি তার গানের একজন ভক্ত। তিনি যে নাটোরের মেয়ে আজ জেনে আনন্দিত হলাম এবং গর্বিত বোধ করছি।’
নাটোরের বাউল কুলের শিরোমনি কার্তিক উদাস সাময়িকীকে জানান, তিনি আমাদের সংগীত জগতের জননী। আমরা উনাকে গুরুমা বলে সম্মোধন করে থাকি। নাটোরের সাথে গুরুমার দূরত্ব হওয়ার দায়ভার আমাদেরই। নাটোরের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতিক অঙ্গনের উদ্যোগ এবং প্রশাসনের সহযোগিতা, এই দূরত্ব কমাতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
প্রভাষক প্রদীপ সরকার সাময়িকীকে জানান, নাটোরবাসীর পক্ষ থেকে বিশ্ববরেণ্য এই কন্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীনেরকে সংবর্ধনা দেওয়া এখন সময়ের দাবি।’
এ্যাড. ভাস্কর বাগচি সাময়িকীকে জানান, ফরিদা পারভিনের জন্য নাটোর বাসির যেমন কিছু করা উচিত, তেমনি ফরিদা পারভিনেরও নিজের জন্মভূমির প্রতি কিছুটা হলেও দায়বদ্ধতা রয়েছে যা তিনি কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেননা। তিনি কুষ্টিয়াতে যান নাটোর জেলা দিয়ে কিন্তু নাটোরে আসেন না।
কুষ্টিয়ার লালন সাঁইজীর আশ্রমের ভক্ত রিফাজ উদ্দিন দয়াল সাময়িকীকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি লালন একাডেমরি সাথে জড়িত।প্রতি বছর ১৭ই মে মরহুম মকসেদ আলীর সাঁইয়ের অফাত দিবসে (মৃতুবার্ষিকী) উপস্থিত থাকেন। সাঁইজির ধামে বাৎসরিক অনুষ্ঠানে তিনি প্রতিবছরই উপস্থিত থাকতেন । সম্প্রতি বেশ কয়েক বছর যাবৎ অনুষ্ঠানে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না।
খুলনা বেতারের লালন সঙ্গীতশিল্পী রুশিয়া খানম সাময়িকীকে জানান, ‘আমার পিতা মরহুম মোকসেদ আলী সাঁইয়ের কাছে ফরিদা পারভীন লালন সঙ্গীতের তালিম নিয়েছে। মকসেদ আলী সাঁই হচ্ছেন বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম লালন সঙ্গীতশিল্পী।’
মুঠোফোনে সাময়িকীর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বিশ্ববরেণ্য কন্ঠশিল্পি ফরিদা পারভীন‘এর-
সাময়িকী: অনেক ব্যস্ততার মাঝে জম্মস্থান নাটোরের কথা কতটুকু মনে পড়ে?
ফরিদা পারভীন: যেখানেই থাকি সব সময় জম্মস্থান নাটোরের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সময় করে উঠতে পারি না।তেমনভাবে যেতেও পারিনা।
সাময়িকী: বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়েসীরা জানেনা আপনার জন্মস্থান নাটোর এ-ব্যাপারে আপনি কি মন্তব্য করবেন?
ফরিদা পারভীন: স্যাটেলাইট চ্যানেলে, মঞ্চানুষ্ঠানে, যেকোন পত্রিকার সাক্ষাতকারে আমি গর্বের সাথে বলি আমি নাটোরের মেয়ে। আমি নাটোরের ফরিদা পারভীন। তবে হ্যাঁ, অনেকে মনে করে আমি কুষ্টিয়ার মেয়ে কারণ লালন সাঁইজির গান করি। আমার পিতা একজন চিকিৎিসক ছিলেন। তার চাকরিসূত্রে প্রতি পালিত হয়েছি কুষ্টিয়ায়।
সাময়িকী: নাটোরের সঙ্গে আপনার দূরত্ব অনেক বেশি বলে অনেকে মনে করেন এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
ফরিদা পারভীন: নাটোরের জালালাবাদে লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার সময় জমিদাতা ও সংগঠনের অনেকেই আমার কাছে এসেছিলেন। উপদেষ্টা হিসেবে সেই সংগঠন থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাদের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম। গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। সেখানে জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন উপস্থিত ছিলেন। নাটোরবাসী যে যখন যেভাবে আমাকে ডাকে, আমি সাড়া না দিয়ে থাকতে পারিনা। নাটোর একটি পরিবার, সেই পরিবারেরই আমি একজন সদস্য বলে মনে করি।
সাময়িকী: নাটোর নিয়ে আপনার কোন পরিকল্পনা আছে?
ফরিদা পারভীন: আমি যে কাজগুলোই করি তা নাটোরের মেয়ে হিসেবেই করি। আমার সব থেকে বড় পরিচয় আমার জম্ম নাটোরে বা আমি নাটোরের মেয়ে। নাটোরের কেউ যদি ভাল কোন উদ্দ্যোগ নেয় তবে আমি সেই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকব। ফরিদা পরভীন ফাউন্ডেশনের একটি অঙ্গ ‘অচিন পাখি’র একটি শাখা নাটোরে প্রতিষ্ঠা করব এই পরিকল্পনা আমার মাথায় আছে।
সাময়িকী: নাটোরের বর্তমান সাংস্কৃতিক অবস্থান বেশ নাজুক এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
ফরিদা পারভীন: এটা ঠিক যে নাটোরের সাংস্কৃতিক অবস্থান এখন আর আগের মতন নেই। আমরা যখন কাজ করেছি তখন অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করত। একটা আবহাওয়া ছিল। আগের সেই অবস্থানকে ফিরিয়ে আনতে সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হবে। আমরা যারা বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছি তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান প্রজন্মকে নাটোরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত করতে হবে। এই বিষয়টি বেশ জটিল এই যুগে, তবুও নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করতে হবে আমদেরই। এব্যাপারে সংস্কৃতি অঙ্গন ও জেলা প্রশাসনকে যৌথ ভাবে কাজ করা খুব জরুরী।
সাময়িকী: নাটোরবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলেন।
ফরিদা পারভীন: নাটোর আমার প্রাণের নাটোর। নাটোরবাসী আমার অনেক কাছের। রাজ-রাজার দেশ, উত্তরা গণভবন, সাঐল-কলম গ্রাম, চলনবিল যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। আমি সেই নাটোরের মেয়ে। নাটোরবাসী আপনারা ভালো থাকবেন এবং আমার জন্যে দোয়া করবেন। আগামী দিনগুলোতে নাটোরের সবাইকে নিযে আমার জম্মস্থান নাটোরের জন্য কিছু করতে চাই।
সাময়িকী: ‘সাময়িকী’ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ফরিদা পারভীন: ‘সাময়িকী’ দীর্ঘজীবী হোক এই প্রত্যাশা রইলো।
সাক্ষাতকার গ্রহণ: খন্দকার মাহাবুবুর রহমান
ছবি: নিকুঞ্জ বিহারী দেব।