নারীর অবস্থান সমাজ জীবনে- বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান সমাজ
এই প্রবন্ধের বিষয়টি একটি বহু আলোচিত প্রতিপাদ্য। সংবাদপত্রে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ঘরোয়া আলোচনা- প্রায় সব জায়গাতেই এই বিষয়ে অনেক মত আলাপ-আলোচনা শোনা যায়। সংসারের বিভিন্ন সামাজিক আবর্তে, চাকরিস্থলে, ট্রামে-বাসে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই নারী কোন না কোন ভাবে বিপর্যস্ত, অপমানিত হচ্ছে। শোষণ-নিপীড়ন বা বঞ্চনা নারী চরিত্রের একটি চিরস্থায়ী চালচিত্র হয়ে গেছে। এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আমি বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান যুগের নারীদের উপর সামাজিক ব্যবহারের একটি যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছি।
প্রথমে আসি বৈদিক যুগের কথায়। বৈদিক যুগ বলতে- যে যুগে বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল তাই বুঝতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক – এই দেড় হাজার বছরের মধ্যে সমগ্র বেদ উপনিষদ রচিত হয়েছিল। তাই বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান করতে এই সময় রচিত গ্রন্থগুলিতে প্রাপ্ত নারী সম্বন্ধীয় বিভিন্ন শ্লোক ও গাথা।
ঋক্ বেদের যুগে নারী স্বাধীনচারিণী ছিলেন। এই যুগে নারী নিজেই নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতেন। অবৈধ প্রণয় নিয়েও ঋক্ বেদের ঋষির কোন কুণ্ঠা নেই। তাই ‘জারো ন’, উপপতির মত এই উপমাটি বারেবারেই এসেছে। বিবাহে কন্যাপণ এর কথা পাওয়া যায়। পুরুষের বহু পত্নী গ্রহণের কথা কখনো স্পষ্টত, কখনো বা গৌণ ভাবে সপত্নী বিনাশের মন্ত্রগুলি দ্বারা প্রতিপন্ন হয়। কন্যার শরীরে ত্রুটি থাকলে বরপণের কথা আছে একাধিকবার। কুমারী কন্যার কথা ও বেশ কয়েকবার আছে। এদের বলা হতো অমাজু বা অমাজুরা, অর্থাৎ যারা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যায়। কিংবা কুলপা বা বৃদ্ধকুমারী।
পরবর্তীকালে বিবাহ যেমন নারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল ঋক্ বেদের যুগে তা ছিল না। ঋক্ বেদে সহমরণ পরবর্তীকালে যাকে সতীদাহ বলা হয়েছে তার কোন উল্লেখ নেই। বিধবা বেঁচে থাকতো কখনো বা দেওরের সঙ্গে বিয়ে হতো তার অথবা কখনো বিয়ে হতোই না।সে যাই হোক তার বেঁচে থাকার অধিকার টুকু কেড়ে নেয়া হয়নি। পুড়িয়ে মারাও শুরু হয়নি ধর্ম বা সমাজের দোহাই পেড়ে।গৃহকর্ম ভিন্ন কোনো বৃত্তি কুলনারীর ছিল না। আর যে দুটি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় তা হল পশম পাকানো ও বোনা।
ঋক্ বেদে কিছু ব্রহ্মবাদিনী ঋষিকার নাম পাওয়া যায়। বিশ্ববারা, ঘোষা, অপলা। পাণিনিতে আচার্যা, উপাধ্যায়া শব্দের ব্যুৎপত্তিতে অধ্যাপনায় রত নারীর উল্লেখ আছে। কাশিকাভাষ্যে কাশকৃত্স্না ও আপিশলার নাম পাই মীমাংসা ও ব্যাকরণের পণ্ডিত রূপে। অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক, গার্গী, মৈত্রী, শাশ্বতী এই সব ব্রহ্মবাদিনী নারীর কথা জানতে পারি।
বৈদিক যুগের একেবারে প্রথম পর্বের পর শিক্ষাতেও নারীর অধিকার নেই। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া উপনয়নে তার অধিকার নেই। জন্মাবধি তার সম্বন্ধে সমস্ত সংস্কারই অমন্ত্রক। সে নিজে মন্ত্রোচ্চারণের বা হবি দানের অধিকারিণী নয়। সেই যুগে বিদ্যা তো মন্ত্র দিয়েই হত, কাজেই অমন্ত্রক হওয়াতে বিদ্যা অর্জন করার অধিকার রইল না । সামান্য কিছু গান বাজনা, সেলাই, হাতের কাজ এবং যাবতীয় গৃহকর্ম, স্বামী, সন্তানও শ্বশুরকূলের উদয়াস্ত সেবা করাই ছিল তার কাজ।
সন্তানের মুখ্যত পুত্রসন্তানের জননী হওয়াতেই তার চুড়ান্ত চরিতার্থতা। সেই যুগে গণিকারা ছিল শিক্ষিত এবং প্রাচীন ভারতে গনিকারাই ছিল একমাত্র স্বাধীন নারী। কুলবধুকে শিক্ষা থেকে সর্বতোভাবে বঞ্চিত করে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে গণিকাকে সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী করে সমাজ কুলনারীর প্রতি চূড়ান্ত অপমান এর ব্যবস্থা করেছিল।
পুরুষের বহুবিবাহ ঋকবেদের যুগ থেকেই চলে আসছে। বিবাহের সবকটি মন্ত্রেই উচ্চারণ করে বলা হয় স্ত্রী যেন চিন্তা ও কাজে স্বামীর অনুগামিনী হয়, কোথাও বলা নেই স্ত্রীরও চিত্ত বলে একটা কিছু আছে এবং স্বামীকে তার প্রতি অনুকূল হতে হবে। বৈদিক যুগ থেকেই দেখতে পাই নারী এক নিরাপত্তাহীনতার দুঃখ ভোগ করে চলেছে।যেহেতু পুরুষের মধ্যে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল তাই সপত্নী বিনাশের জন্য, স্বামীর একনিষ্ঠ প্রেম পাওয়ার জন্য, স্বামীকে বশীভূত করার জন্য অনেকরকম অভিচার ক্রিয়ার মন্ত্র ঋক্ বেদে ও অথর্ব বেদে আছে। অথর্ববেদে অনেকগুলি ‘প্রতিষ্ঠাপন’ সুক্ত আছে। এগুলি পলাতকা বা পলায়নে উদ্যতা স্ত্রীকে অন্তঃপুরে ধরে রাখার জন্য প্রয়োগ করা হতো। এই সময় থেকেই নারী ক্রমশ অন্তঃপুরে বন্দিনী হয়ে উঠলো।
বৈদিক ভারত নারীকে দেখেছিল প্রধানত অশুচি, স্বভাবত পাপিষ্ঠা এবং অমঙ্গলের হেতুরূপে। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যজ্ঞকালে কুকুর, শূদ্র ও কোন নারীর দিকে তাকাবে না। নারীর প্রধান স্থান সে হচ্ছে পুত্রের জননী এবং ভোগ্যবস্তু। নারী ভোগ্য বস্তু বলেই দক্ষিণার তালিকায় তার স্থান ছিল। বহু যজ্ঞে নারী দক্ষিণারূপে ব্যবহৃত হয়েছে- গাভী, স্বর্ণ, শস্য, রথ, অশ্ব ও গজের সঙ্গে।
স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য হল পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া। বর্তমান সমাজে এর অবিকল প্রতিফলন দেখতে পাই। তাই শত শত কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হচ্ছে নির্বিবাদে। বৈদিক যুগ থেকেই পুত্র সন্তানের জন্ম না দিতে পারলে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার কথা আছে।বৈদিক বিধান অনুসারে নিঃসন্তান বধুকে বিবাহের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়। যে স্ত্রী শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরে, মৃতবৎসাকে পনেরো বছর পরে এবং কলহপরায়ণ স্ত্রীকে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করা যায়। পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে আবার বিবাহ করতে পারেন এই বিধান আছে। নারী সর্বাবস্থাতেই পুরুষের অধীনস্থ থাকবে তাই বশিষ্ট ধর্মসূত্রে পড়ি নারীকে কুমারী অবস্থায় রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনের স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র, নারী স্বাধীনতা লাভের যোগ্য নয়।
‘কন্যা অভিশাপ’ (ঐরতেয় ব্রাহ্মণ) তাই সন্তানসম্ভবা নারীর একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান হল ‘পুংসবন’ যার উদ্দেশ্য হলো যাতে গর্ভস্থ সন্তানটি পুরুষ হয়। নারীকে বলা হয়েছে মিথ্যাচারীণী, দুর্ভাগ্যস্বরূপিনী, সুরা বা পাশাখেলার মত একটি ব্যাসনমাত্র। এছাড়াও বলা হয়েছে স্ত্রী, শূদ্র, কুকুর, কালোপাখি এদের দেখো না। তাহলে শ্রী ও পাপ, জ্যোতি ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যা মিশে যাবে। পরবর্তী যুগে নারীকে যে ভোগ্যবস্তু, পণ্য বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে, নারীর প্রতি অসম্মান করা হয়েছে তাঁর জোরটা কিন্তু বৈদিক সাহিত্যই যুগিয়েছে।