সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গল্পকথার নাটোর। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানীর রাজবাড়ী, উত্তরা গণভবন আর চলন বিলের ইতিকথা পাওয়া যায় ইতিহাসে। তবে নাটোরের প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার কোন ইতিহাস পাওয়া যায়না।
নাটোরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক জমিদারের যেমন ইতিহাস নেই! তেমনি সংরক্ষন করা হয়নি জমিদার বাড়িগুলো। সেই কারণেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দর্শন থেকে বঞ্চিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আর জমিদারদের সেই জমিদারবাড়ি ও জমিজমাগুলো প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে।
জমিদারবাড়ি উদ্ধারে প্রশাসনের কোনো ভূমিকাই দেখা যায়না। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলেও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোন ভূমিকা পাওয়া যাচ্ছে না এই সমস্ত ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করার। প্রত্যেক জাতিরই তার নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে।
১৩১১ বঙ্গাব্দে সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ধরাইল গ্রামে জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরী নির্মাণ করেন ধরাইল জমিদার বাড়ি।রুপকথার এই জমিদার বাড়ি নাটোর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে।
এছাড়া ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে জমিদার বিনোদ বিহারী চৌধুরী দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির আদলে ১২ বছর সময় ব্যয় করে প্রাসাদ নির্মাণ করেন।তিনি একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ছিলেন।তাই প্রাসাদের নকশা নিজেই প্রণয়ন করেছিলেন।
নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, পাবনা, পাঁচবিবিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধরাইল জমিদারদের তালুক ছিল।নওগাঁয় লীলা সুন্দরী ৩০০ বিঘা জমির খাজনা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন।সেখানে গড়ে উঠেছিল ধরাইল জমিদারের কাচারিবাড়ি। বহরমপুরে এক জমিদারের সঙ্গে নীলা সুন্দরীর বিয়ে হওয়ার কারণে ধরাইল জমিদার জমিদারি ছেড়ে আসেন।
৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জমিদাররা আর ধরাইল গ্রামে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের আগাম ধারণা থেকে তারা অনেক সম্পদ কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।কালের বির্বতন ও সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ না থাকায় দখল হয়ে গেছে জমিদারদের সিংহভাগ স্থাপনা। অযত্ন ও অবহেলায় জীর্নদশায় পতিত হয়েছে রাধা-বল্লভ জিউ মন্দির।
বড় তরফের জমিদার ছিলেন শশাঙ্ক চৌধুরী, পুত্র বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী এবং স্ত্রী শ্রীমতি পারুল রানী।মধ্যম তরফের জমিদার ছিলেন, যোগেন্দ্র নাথ চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রনাথ চৌধুরী ও যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী।ছোট তরফের জমিদার ছিলেন, গোবিন্দ দাস চৌধুরী এবং তার স্ত্রী শ্রীমতি বাসন্তী রানী।
পাঁচআনী জমিদার ছিলেন, গোকুলধাম চৌধুরী, পুত্র বিনোদবিহারী চৌধুরী এবং শ্রীশ বাবু চৌধুরী। অন্যান্য জমিদারের মধ্যে ছিলেন হরেন্দ্র নাথ চৌধুরী। জমি-জমা এবং সম্পদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনুযায়ী জমিদারি এভাবে ভাগ করে দেওয়া হতো।
কথিত আছে ধরাইল জমিদাররা খুবই সম্পদশালী ছিলেন।নাটোর রাজা অনেক সময় নবাবের কর পরিশোধে অর্থসংকট হলে কর্জ নিতেন ধরাইল জমিদারের কাছ থেকে। খাজনা আদায়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জমিদারি পরিচালনায় খুবই সুদক্ষ ছিলেন এই ধরাইল জমিদাররা।
ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতেন কলিকাতার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। যেসকল কাঁচামাল আমদানি করা হতো তার মূল্য বাবদ বেতের তৈরি ধরা অর্থাৎ পাঁচ কেজি পরিমাণ অর্থ বা মুদ্রা প্রদান করতে হতো।ধরা শব্দ থেকে ধরাইল শব্দের উৎপত্তি হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে বাদ্যকরদের একটি বসতি অতি প্রাচীনকাল থেকেই এখানে ছিল যা পরবর্তীতে ঢুলিপাড়া নামে পরিচিত হয়।ঢাকঢোলের সাথে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ধরাইল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
ধরাইল জমিদারের শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে বহু পূর্বে। এখানে আলী সরদার নামে একজন ধনী গৃহস্থ বাস করতেন। কলিকাতা থেকে ব্যবসার জন্য বিভিন্ন বণিক আলী সরদারের সাথে ব্যবসা করার অনুমতি পার্থনা করেন।ব্যবসার স্বার্থে বসতি স্থাপন করেন এবং ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বিস্তার করেন।
আলী সরদারের স্ত্রীর জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরীর সঙ্গে পরকীয়া ছিল বলে অনেকেই মনে করতেন এবং সেই পরকীয়ার ঘটনা প্রকাশ পেলে কলিকাতার বণিকদের কাছে সমস্ত জমিদারি হারাতে হয়।তবে ঘটনাটি জমিদারি গ্রাস করার জন্য বণিকদের ষড়যন্ত্র ছিল বলে অনেকেই মনে করতেন।
বর্তমানে যেখানে খেলার মাঠ গড়ে উঠেছে, সেখানে জমিদারদের কাচারি ঘর এবং মাস্টার বাড়ির সামনে নাটমন্দির, তার পূর্ব পাশে ছিল বড়তরফের একতলা বিশিষ্ট বৈঠকখানা এবং জমিদারদের দোল মন্দির বর্তমানে মাঠের উত্তর পাশে দক্ষিণমুখে। বর্তমানে নজিবর ডাক্তার যে বাড়ীতে বসত করে, তা জমিদার গোবিন্দ দাসের প্রাসাদ ছিল।
বর্তমানে মনছেরের বাড়ির কাছে ছোট তরফ ও বড় তরফের মন্ডপ ঘর ছিল।ধরাইল আই.এম উচ্চ বিদ্যালয়, ছিল জমিদার বিনোদ বিহারী চৌধুরীর বসতবাড়ি।জমিদার বাড়ি ভেঙ্গে এই স্কুল নির্মাণের নেপথ্যে দেয়ালের ভিতর স্বর্ণের মুদ্রা মাটির হাড়িতে দালানের ভিতর রাখা ছিল।
সম্পদ উদ্ধার করতে গিয়ে জমিদার বিনোদ বিহারী চৌধুরীর বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে স্কুল নির্মাণ করা হয়।সেই স্বর্ণ মুদ্রা কে পেয়েছিলেন এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গ্রামবাসী আঙ্গুল তুলে স্কুল কমিটির দিকে।ওই বসতবাড়িতে লোহার নির্মিত প্রায় ১০ ইঞ্চি চওড়ার ১৫ ফিট উচ্চতার দরজা ছিল।সেই লোহার দরজাটিও হারিয়ে গেছে।
বর্তমান নুরু দর্জির বাড়ির পূর্ব দিকে বড়তফের প্রাসাদ ছিল। ওই প্রাসাদের পাশে জমিদার যতীনের প্রাসাদ ছিল।১৩১১ বঙ্গাব্দে ২৫শে ফাল্গুন বৃহস্পতিবারে জমিদার শশাঙ্কর চৌধুরী রাধা গোবিন্দ জিউ মন্দির নির্মাণ করেন।মন্দিরটি এখনো তার আপন সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তবে স্বাধীনতার পরে এই মন্দিরে প্রদীপ জ্বলেনি।
মন্দিরের সামনে জায়গা দখল করে বাড়ি করেছে একজন প্রভাবশালী।জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরী নির্মিত রাধা গোবিন্দ জিউ মন্দিরে তিন পুরুষ ধরে পূজার্চনা করেছেন, তন্মধ্যে জমিদার শশাঙ্ক দাস তাঁর ছেলে জমিদার শশী মোহন দাস ও তাঁর ছেলে জমিদার গোবিন্দ দাস। মন্দিরে নিয়মিত পূজার জন্য জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরী কুমুদিনী চক্রবর্তী নামে এক পুরোহিতকে মনোনীত করেছিলেন।
জমিদার বাড়ীতে বেশ কয়েটি পুকুর খনন করা হয়েছিল। ১৩৩৭ সালে এই পুকুরগুলো খনন করা হয়েছিল। কথিত আছে জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।তার ফলস্বরুপ ঈশ্বর তাঁর মনোবাসনা পূরণ করেন।মনোবাসনা পূরণ হওয়ার খুশিতে তিনি দুইটা পুকুর খনন করেছিলেন। অন্যান্য পুকুর ও কুপগুলো প্রয়োজনের তাগিদেই জমিদাররা খনন করেছিলেন।
কথিত আছে জমিদারদের মনোরঞ্জনের জন্য পৃথক একটি জায়গায় নর্তকীদের নিত্য প্রদর্শন হত।নর্তকীদের নাচ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জমিদার শ্রীশ বাবু কুলোদা নামে এক সুন্দরী নর্তকীকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন।শ্রীশ বাবুর প্রাসাদের পাশে নর্তকীকে একটি সুরঙ্গ বাসস্থান নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
লালোর গ্রামের জমিদার অধ্যান্ত চৌধুরী নর্তকী নাচাতে গিয়ে কতিপয় ডাকাতের কবলে পড়ে। ডাকাতদল নর্তকীকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এ ঘটনায় জমিদার বিনোদ বিহারীকে জানানো হলে সে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে নর্তকীকে উদ্ধার করেছিলেন।
জনশ্রুতি থেকে জানা যায় ছোট তরফের নায়েব ছিলেন প্রমোদ শাহ। তিনি একদিন ৩৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও প্রচুর নগদ অর্থ জমিদার শ্রীশ বাবুর কাছে রেখে খাজনা আদায়ের জন্য খানসত্তর বাড়ি নামক পরগনায় চলে যান। শ্রীশ বাবু ওই অর্থ আত্মসাতের জন্য ষড়যন্ত্র করেন।
কতিপয় লোকজন নিয়ে তিনি নিজেই তাঁর বন্দুক দিয়ে ফাঁকা গুলি করেন, নিজের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত করে হট্টগোল পাকিয়ে দেন।সবাই জানলো শ্রীশ বাবুর বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। এভাবে প্রমোদ শাহ‘এর সমস্ত অর্থ-সম্পদ শ্রীশ বাবু আত্মসাৎ করে ভোগ দখলে নেয়।
এছাড়া কথিত আছে জমিদার সুবলের সাত পাড়ায় প্রজাদের অনেকদিনের খাজনা বাঁকি পড়ে যায়।অনেক চেষ্টা করেও জমিদার সুবল খাজনা আদায় করতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে জমিদার সুবল সাত পাড়ার সমস্ত জমিদারি, জমিদার বিনোদ বিহারীর নিকট বিক্রি করে দেন।
আজকের বাগরোম এলাকায় পরান প্রামাণিক নামে এক ধনী প্রজা বাস করতেন। সে জমিদারদের কবল থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করার জন্য খাজনা না দেওয়ার জন্য এলাকার জনসাধারণের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।
জমিদার বিনোদ বাবু কচি সর্দার নামে এক লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে পরামানিককে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠান। হুকুম অমান্য করায় জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ঘোড়ার গাড়িতে বেঁধে পরান প্রামানিককে নিয়ে আসে। প্রাসাদের চিলেকোঠায় তুলে নির্মমভাবে শাস্তি প্রদান করেন।এবং পরামানিকের বাড়ি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
তৎকালীন ধরাইল জমিদার বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হতো খুবই ধুমধামের সাথে।জমিদারদের বিয়ের অনুষ্ঠান এতটাই জাঁকজমকপূর্ণ ছিল যে, জমিদার শচীন চৌধুরী হাতির পিঠে চড়ে বর বেশে জমিদার বিনোদ বাবুর মেয়ে কুমারী রেনু রানীকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।
সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রজাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল।নামকরা মালাকার কাগজ দিয়ে কুমির বানিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিয়েছিল। পুকুরের সেই কুমির খেলা প্রজারা অনন্দচিত্তে উপভোগ করেছিলেন। এছাড়া হাওয়াই, তুর্বি, গ্রাটো ইত্যাদি হরেক রকমের বাজি পোড়ানো হয়েছিল।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ধরাইল জমিদারদের ছিল অনস্বীকার্য অবদান। জমিদাররা ধরাইল সবুজসংঘ নামে একটি থিয়েটার হল স্থাপন করেছিলেন। প্রজাদের বিনোদনের জন্য বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় করতেন সেই থিয়েটার হলে।
অনুষ্ঠিত হতো যাত্রাপালা- নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সম্রাট শাহজাহান, সীতারাম, টিপু সুলতান, মহারাজ, নন্দকুমার, বিদ্রোহী বাঙালি, সত্যবান সাবিত্রী, এক মুঠো ভাতদে, মা যখন পতিতা, বাইশ বছর পরে, এই সমস্ত বিখ্যাত ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সেই সময় অভিনয়শিল্পী হিসাবে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন, খোকাবাবু, মনোরঞ্জন শীল, গোপাল পাইন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, গীতা দত্ত, কেকা দত্ত, ভানু সাহা, গোবিন্দ সাহা, উপেন্দ্রনাথ দাস, গোপাল সাহা প্রমুখ।মাস্টার কালিদাস সবুজ সংঘ থিয়েটারে এক যাত্রাপালায় খল তথা শয়তানের চরিত্রে অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
অভিনয় দেখে দর্শক ক্ষিপ্ত হয়ে মঞ্চে কালিদাসকে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। জুতো হাতে নিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘আমার অভিনয় আজ সার্থক, আমি একজন সফল অভিনয়শিল্পী। আজকের পর থেকে অভিনয় করব না।’ পরবর্তীতে আর কখনো কেউ কালিদাসকে অভিনয় করতে দেখেননি।
শ্রীমতি পারুল রানীর স্বামী, জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী ধরাইল জমিদার বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। বিজয় গোবিন্দকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।শ্রীমতি পারুল রানীর কোনএক জমিদারের সাথে পরকীয়া ছিলো। এই ঘটনা বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী জেনে যায়।
পারুল নিজে বাঁচার উপায় না পেয়ে পরকীয়া প্রেমিকের সাথে ষড়যন্ত্র করে জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীকে হত্যা করেছিরেন। তবে স্মৃতিস্তম্ভে লিখিত ছন্দ অনুপাতে শ্রীমতি পারুল রানীর, স্বামীর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ পায় ‘পতির চরণে পতি, চিতা ভস্ম আনি গোপনে দেউরে বাড়ি ঝরিছে পারুল রানী’
এখনও আছে আম্রকানন এখানেই বসত করতেন বাউনি নামে এক বৃদ্ধা। তিনি ভিক্ষা করে চাউল সংগ্রহ করতেন। বহু রাত্রি পর্যন্ত রান্না চলতো। বাউনি হঠাৎ একদিন মারা যায়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় তার ব্যবহারের জিনিসপত্র শ্মশানে বিসর্জন দিতে গিয়ে পিতলের কলস পাওয়া যায়। সেই কলসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ অলংকার ছিল।
বর্তমানে আবুল রিফিউজি যে বাড়িতে বসবাস করছেন তা জমিদার শ্রীশ বাবুর ভূখণ্ড। জমিদার মহেন্দ্র বাবু এবং শ্রীশ বাবু নামে দুই ভ্রাতা ছিল। জমিদার শ্রীশ বাবু নর্তকীদের নৃত্যে অকৃষ্ট ছিলেন। কাম চরিতার্থ করতে গিয়ে তার জীবনের বড় পরিবর্তন ঘটে।
থম গুরুমা নামে একজন তান্ত্রিক অনিন্দ্য সুন্দরী মহিলা জমিদার শ্রীশ বাবুর নজরে পড়ে। থম গুরুমা কাম চরিতার্থ করতেন বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে।গুরুমা বলরাম নামে এক ব্যক্তির বোন ছিলেন। শ্রীশ বাবু ওই মহিলাকে গুরুমা বলে সম্বোধন করতেন।
গুরুমা‘র অপরূপ সৌন্দর্যের লালসায় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে সম্পর্কের বাধা পেরিয়ে কামপ্রবৃত্তির প্রস্তাব দেয় শ্রীশ বাবু , প্রতি উত্তরে গুরুমা বলেছিলেন ‘আমি যে কোন পুরুষের কাছে আমার শরীর মেলে ধরতে পারি এতে আমার কোন সংকোচ নেই।
যেহেতু তুমি আমাকে গুরুমা সম্বোধন করেছো সেহেতু আমার শরীর তোমার ভোগের জন্য দিতে পারি না।’ জমিদার শ্রীশ বাবু সব জ্ঞান উপেক্ষা করে একদিন জ্যোৎস্না রাতে ঘরে প্রবেশ করে গুরুমার শরীর স্পর্শ করে।গুরুমার তান্ত্রিক ক্ষমতা বলে জমিদারের পুরুষত্ব নষ্ট করে দিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করেন।
শ্রীশ বাবু তার ভুল বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে গুরুমা‘র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। গুরুমা বলেন, ‘আজকের পর থেকে তুই কোন মেয়ের সঙ্গে মিলন করতে পারবি না। সে ক্ষমতা আমি ধ্বংস করে দিয়েছি।সকল পাপ মুক্তির জন্য সন্ন্যাস পথ বেছেনে।’ সেই থেকে শ্রীশ বাবু সন্ন্যাস জীবন বেছে নেন।
ভিক্ষাবৃত্তি করে সংগৃহীত চাউল দিয়ে অষ্টপ্রহর পূজার আয়োজন করতেন। বর্তমানে আব্দুর রহমানের বাড়ি একসময় সূর্য বাড়ি নামে খ্যাত ছিল। জঙ্গলের মাঝে শ্রীশ বাবু গাছের নিচে ধ্যানে মগ্ন হতেন। বিভিন্ন জায়গা হতে ভক্তগণ যজ্ঞে সমবেত হতে থাকে। এক সময় সেখানে গড়ে ওঠে শ্রীশ বাবুর আখড়া।
দূর দূরান্ত হতে মানুষ আসতো সেই আখড়ায়।অনেকদিন ধরে মেলা অনুষ্ঠিত হতো। হঠাৎ একদিন জমিদার ওই স্থান থেকে ভারত অভিমুখে রওনা হন। ভারতের পশ্চিমে বুনিয়াদপুরে শ্রীশ বাবু গড়ে তোলেন আশ্রম।সেইখানে এখনো আশ্রম রয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হয়।
ঐতিহ্যের অংশ এই ধরাইল জমিদার বাড়ি এখন অযত্ন-অবহেলায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ইতিমধ্যে স্থাপনার বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু আছে তাও জীর্ণ অবস্থায়। জমিদার বাড়িসহ জমিদারের সম্পদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে সরকারের অধীনে নেয়ার প্রয়োজন।
অবৈধ দখলমুক্ত করে, সঠিক তত্বাবধানের মাধ্যমে ধরাইল জমিদারের ঐতিহ্য তুলে ধরতে, সংশ্লিষ্ট বিভাগ দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।