২৪ নভেম্বর ১৯৭১। আমেরিকার পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে আকাশে ওড়ে নর্থ ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩০৫। বিজনেস এক্সিকিউটিভ পরিচয় দিয়ে সেই বিমানে ওঠেন ড্যান কুপার নামের এক ভদ্রলোক।
প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই প্লেনের শেষের সারিতে বসে তিনি একটি সিগারেট ধরান এবং একটি বর্বোন এবং সোডা অর্ডার করেন। বিমান সেবিকা ফ্লোরেন্স শেফনার সেগুলো দিতে আসা মাত্রই তিনি তাঁর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেন। তাতে লেখা— ‘আমার ব্রিফকেসে একটি বোমা আছে। আমার কথা না শুনলেই বিস্ফোরণ ঘটাব। টু শব্দটি না করে তুমি চুপচাপ আমার পাশে এসে বসো।’
তাঁর পাশে বসা মাত্রই তিনি তাঁর ব্রিফকেস খুলে সেই বিমান সেবিকাকে একটি ব্যাটারি, কিছু লাল-নীল-হলুদ কাঠি এবং বেশ খানিকটা ইলেকট্রিক তার দেখান। আর সেটা দেখা মাত্রই বিমান সেবিকা বুঝতে পারেন তাঁদের বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানের ৩৬ জন যাত্রীর জীবন এবং এই বিমানটিকে বাঁচাতে চাইলে একমাত্র উপায় এঁর দাবি মেনে নেওয়া।
কুপার বলেন, আমার দুই লক্ষ ডলার (১,৪৯,৭০,০০০,০০ ভারতীয় টাকা) আর তার সঙ্গে চারটে প্যারাশুট চাই। আর আমি যেখানে নামব, সেখানে একটি গাড়ি রেডি রাখতে হবে। আর হ্যাঁ, সেই গাড়িতে যেন ট্যাঙ্ক ভর্তি তেল থাকে। আমি সেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ যেন সেই গাড়িটিকে ফলো না করে। সঙ্গে সঙ্গে সেই বিমান সেবিকার মাধ্যমে এই বার্তা পৌঁছে গেল ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন মারফত খবর পৌঁছল ওপর মহল-সর্বোচ্চ মহলে। এবং তাঁর দাবি মতো মুক্তিপণের সমস্ত ব্যবস্থা হল।
বিমানটি সিয়াটলে অবতরণের পর টাকা এবং প্যারাশুট নিয়ে তিনি সব যাত্রীকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। তার পর বিমান চালককে বিস্ফোরণ ঘটানোর ভয় দেখিয়ে চার জন ক্রু-সহ বিমানটিকে মেক্সিকোর উদ্দেশে উড়িয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করলেন।
খানিকটা যাওয়ার পরে তিনি কিছুটা নিচু দিয়ে বিমান চালানোর নির্দেশ দেন চালককে। তার পর রাতের অন্ধকারে ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে প্যারাশুট নিয়ে তিনি ঝাঁপ দেন।
ততক্ষণে হাইজ্যাক হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। উৎকণ্ঠায় সবাই। জরুরি মিটিঙে বসেছেন রাষ্ট্রনেতারা। তাঁদের নির্দেশেই পাঁচটি আলাদা বিমান থেকে ফ্লাইট ৩০৫-এর গতিবিধির দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছিল, দূরে দূরে রাখা হয়েছিল সাঁজোয়া বাহিনী। কুপার মাটিতে পা রাখা মাত্রই যাতে এরেস্ট করা যায়।
সমস্ত ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো ভাবে করা হলেও, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কুপার সেই যে ভেল্কিবাজের মতো উধাও হল, অনেক তল্লাশি করেও তাঁর আর কোনও হদিস পাওয়া গেল না।
সে সময় এক সাংবাদিকের ভুলবশত কারণে ড্যান কুপার নামটি হয়ে যায় ডি বি কুপার। তখন থেকে এ নামেই গোটা বিশ্ব তাঁকে চেনে।
এই ঘটনাটি এতটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে, ওই ঘটনার পরে পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র, লেখা হচ্ছে বই, মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক, একের পর এক বেরোচ্ছে কমিকস, এমনকী গানেও বারবার ফিরে আসছেন রহস্যময় ডি বি কুপার।
শুধু তাই-ই নয়, তাঁর ওই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে পরবর্তিকালে আরও অনেকেই বিমান হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছে।
ডি বি কুপারের এই ঘটনাটি আমেরিকার ইতিহাসে একমাত্র অমীমাংসিত আকাশ-রহস্য, যা এফবিআইও এখনও পর্যন্ত সমাধান করতে পারেনি। আর কোনও দিন পারবে বলেও মনে হয় না।