মাত্র এক ঝলক দেখেই উচ্চ মাধ্যমিকে তিনবারের ‘ফেল্টু’ ইব্রা মনে মনে এক অদ্ভুত টান অনুভব করতে পারল। ধিকিধিকি বেড়ে ওঠা রোদের মতো তার মনের উদ্বেলতা বেড়েই চলেছে। বারবার মনে হতে থাকল, দেখতে তো বেশ। গায়ের রঙে কাঁচা হলুদের স্নিগ্ধতা, হাসির ফোয়ারায় রয়েছে ফোটা গোলাপের বিস্তার। হাঁটার ছন্দে যেন হুবহু কল্পলোকের মনময়ুরী। দেখলে মনে হবে, কোনো নর্তকী হেলতে দুলতে নাচের আসরে ঢুকছে।
সন্ধের সময় রান্নাঘরে খুঁটিনাটি কাজে ব্যস্ত ছিল রুবি। সামু বাড়িতে নেই। বারান্দার অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে উঠোনের মাঝে। রান্নাঘরে জ্বলা আলোয় উঠোনের আরেকটা অংশ ঝিকিমিকি আলোয় আলোকিত। বারান্দায় পা রেখে ইব্রার বার বার মনে হতে থাকল, মেয়েটি পিছনে পিছনে এসে উঠোনের রহস্যময়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে নেই তো? নামটাও বেশ, কুঁড়ি। ইব্রার মনের অনুরাগে বার বার ভেসে উঠছিল কল্পনার রঙতুলিতে আঁকা কুঁড়ির সচিত্র প্রতিভাস। অবচেতন মনে আলতো করে প্রশ্ন করল, তুমি এখানে?
রান্নাঘর থেকে রুবির তাৎক্ষণিক প্রশ্ন, কার সঙ্গে কথা বলছিস্ রে খোকা?
মা যে খুব নরম প্রকৃতির, ইব্রা তা ছোটোবেলাতেই জেনে ফেলেছিল। রুবির মধ্যে প্রশ্ন জাগল, তাহলে কী ছেলের মনের জগতে নতুন কেউ এসে ভর করল? হতেই পারে, বয়স তো নেহাৎ কম হয় নি। বলল, হ্যাঁরে, মেয়েটার সঙ্গে কথা হয়েছে তোর? কোথায় বাড়ি? দেখতে কেমন? গায়ের রঙু ফর্সা তো?
ইব্রা চুপ করে থাকল। একটু পরে তার মুখে সব শুনে রুবি মনে মনে খুব রাজি হলেও তার যত ভয় সামুকে নিয়ে। একবার বিপত্তি করার সিদ্ধান্ত নিলে লোকটার মধ্যে সেই ইচ্ছা পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে ওঠে। ভয়ানক মাথারাগি মানুষ, একটা আস্ত পাষণ্ণ। কখন কী করে বসে, নিজেই তা জানে না। শরীরের জোর দেখিয়ে কতবার যে তার মনের হিসেব তছনছ করে দিয়েছে, সেই হিসেব রুবি আজও মেলাতে পারে না। কিছুটা হতদ্যোম হয়ে পড়ল রুবি। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইব্রাকে বলল, হ্যাঁরে, মেয়েটা দেখতে বেশ, না?
হ্যাঁ মা, ইব্রার আনত স্বরে লজ্জিত উত্তর।
নিজে দেখেছিস?
ইব্রা মাথা নাড়ল।
কথা বলেছিস?
কয়েক মিনিট।
প্রস্তাব দিলে রাজি হবে তো?
তার আগে বাপকে রাজি করাতে পারো কিনা দ্যাখো।
রুবি জানে, সামু সহজে হার মানার লোক নয়। ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে, মাঝে মাঝে শরীরের সব শক্তি দিয়ে পেরেকের মাথায় হাতুড়ি ঠুকতে হয়। সেই ঠোকাঠুকি নিয়ে রুবির যত ভয়। ইব্রার তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞাত হল, মায়ের আন্তরিক অনুরোধ সত্ত্বেও বাপের মনের হাতুড়ির আঘাতে তার মনের সব অনুরাগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে।
কটা দিন পরে ইব্রা বিকেলে পাড়ার পূবধারে দাঁড়িয়ে আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করল। পলাশ ফুল ফুটেছে গাছে গাছে। টকটকে লাল। সূর্যের সাত রঙে গন্ধহীন পলাশফুলগুলোকে গোলাপ বলে মনে হচ্ছে। জোয়ারের জলস্ফীতির মতো একটা নতুন আশা হুড়মুড় করে ঢুকল ইব্রার মনের গলিতে। বুঝল, প্রকৃতির নিয়ম মেনে সময়ের টানে মানুষও পাল্টে যেতে পারে।
ঠিক দু’দিন পরে ইব্রা দেখল, ডাকাবুকো সামু রাত আটটার পরে মায়ের কাছে কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ল। তার কথার ভিতরে অন্য ধরণের কমনীয়তা। —আমাকে ভুল বুঝলা রুবি?
ওই সব ঘ্যানর শুইনা লাভ নাই গো। শরীরে ঝংকার তুলে রুবি রান্নাঘরে চলে যেতে উদ্যত হল। সামু খপ্ করে রুবির ডান হাত চেপে ধরে বলল, তুমি ছেলেডারে লিয়া স্বপ্ন দ্যাখতা পারো, আমি পারুম না ক্যান্?
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এ নাটক দেখে ইব্রা বুঝল, তার মধ্যে ভালোবাসার যে উতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে, কঠোর বাস্তবে নামলে তা কেমন হতে পারে। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আরও কিছু সময় বসে থাকল। বাপের কারণে যে ভাটার স্রোত তার মনের নদীতে বইতে শুরু করেছিল, নতুন করে তা যেন জোয়ারে পরিণত হল। দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝি হলে মনের রঙতুলি দিয়ে তা কীভাবে দূর করতে হবে, সেই মহড়াও পেয়ে গেল ইব্রা। নতুন কল্পনার ছন্দদোল মনের কানায় কানায় দোল খেতে লাগল।
কল্পনার যে নিজস্ব শরীরী আকর্ষণ আছে, ইব্রা তা প্রথম অনুভব করতে পারল। সে যেন ইডেনের ফুল-বাগিচায় এ্যাডাম-ইভের ট্রাডিশনকে তুচ্ছ করে নতুন মনোরম সৃষ্টিতে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। সামুর শেষ বাক্যটা সেই উদ্বেলতাকে আরও অনেকখানি বাড়িয়ে দিল। —শুনো রুবি, ছোঁড়ার মতিগতি ভালো না, অরে আমি বিয়্যা দিবঅ কিন্তু সংসারে রাখতে পারুম নাই।
এ নাটক দেখতে দেখতে ইব্রার কল্নার তুলিতে তার মনের কুঁড়ি রুবি-মায়ের আসনে বসে পড়ল। কিংবা বলা চলে, ইব্রার রঙিন চোখে কুঁড়ি আরও বেশি কিছু হয়ে দেখা দিল। প্রেয়সীর প্রতি পুরুষের দুর্বলতা অনন্তকালের। ইব্রা সেই প্রথম মায়ের অন্ধ স্নেহ কুঁড়ির উপর চাপিয়ে ভালোবাসার অভিনব রকমফের আবিষ্কার করতে পারল। আবেগের চঞ্চলতায় অন্ধকারে ডান হাত বাড়িয়ে অনুভব করতে পার, কুঁড়ির কোমল শরীরে তার ডান হাতের নরম পাঁচ আঙুল ঠেকে গেছে।
কম্পিত ইব্রা শব্দহীন পায়ে প্রথমে বারান্দা থেকে উঠোনে, তারপর উঠোন থেকে রাস্তায় নামল। তার মনের সবটুকু জায়গা তখন কুঁড়ি দখল করে নিয়েছে। সেখানে আর কেউ নেই, কেবলমাত্র কুঁড়ি আর সে। সামুর মতো পাষণ্ড নেই বলেই বার বার কুঁড়ি কুঁড়ি শব্দে মেতে উঠতে পারল। কল্পনার রঙ তুলিতে কুঁড়ি এসে ধরা দিল ইব্রার বাহুডোরে।
।।২।।
সামু মনে মনে হিসেব করে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল, ইব্রার বিয়েতে বেশি খরচ করে লাভ নেই। বরং তাই দিয়ে ওর জন্যে দখিনের পুকুরপাড়ে পাটকাঠির বেড়া আর খড়ের ছাউনি দিয়ে একটা ছোটো ঘর তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে। জন্মদাতা বাপের মন তো, শেষ পর্যন্ত আজন্ম শত্রুর মতো নিষ্ঠুর হতে পারলনা। বিয়ের দিন পাঁচেক পরে থাকার জন্যে একটা তক্তাপোষ, একটা পুরনো বাক্স যাতে সংসারের নানা জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে, রান্নার জন্যে কিছু সরঞ্জাম, খাবার জন্যে এক মন চাল, পাঁচ কেজি ডাল আর কিছু মসলাপাতি ইব্রার হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমি শুরু করে দিলুম যে, পরের সব খরচপাতি তোকে খেটেখুটে মিল করে নিতে হবে। এভাবেই নতুন সংসারযাত্রা শুরু করতে হয়।
জবাবে ইব্রা হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। সেই অবকাশও ছিল না। কুঁড়িকে কাছে পেয়ে বিছানার সংঘর্ষে নিজেকে এত ব্যস্ত রাখার খেলায় মত্ত ছিল যে সংসার চালানোর বাস্তব হিসেবটুকু মাথায় নিতে পারল না।
সুখের দাম্পত্যজীবনে শরীর-মনের খেলায় মজে থাকার কারণে বছর ঘুরতে না ঘুরতে বড়ো অঙ্কের ধারদেনার বোঝা চেপে বসল ইব্রার মাথার উপর। বাস্তবিক অর্থে নিজেকে যতটুকু কুঁড়িতে ডুবিয়ে রাখতে পারল, কেবলমাত্র সেটুকু পাওনা হিসেবে থেকে গেল।
রবিবার, প্রথম বিবাহবার্ষিকীর দিন। ইব্রা শুনল, পাশের গ্রামে বড়োসড়ো গাজন গানের আসর বসবে সন্ধের পরে। দূর থেকে কয়েকটা নামিদামি দল আসছে। যাবার জন্যে ইব্রার মনের দখিনে দোল শুরু হল। কুঁড়ি কিন্তু চাচ্ছিল না সন্ধের পরে ইব্রাকে একা ছেড়ে দিতে। তবুও ইব্রার পীড়াপীড়ি, এ্যাই শোনো না, ভালো দল আসছে, প্লিজ। শেষ পর্যন্ত কুঁড়ি রাজি হলেও যাবার আগে ইব্রার শরীর নিয়ে এত মোড়ামুড়ি শুরু করল যে ইব্রা রাগ করে বলল, এখন ছাড়ো বলছি, ভোররাতে তো ফিরে আসছি।
আরও একটা বছর শেষ হল ইব্রার জীবন থেকে। দিন মাসে পুরো বছরটাই নিকেশ হয়ে গেল। সংসারে আরেকজন লোকও বাড়ল। ইব্রা মনে মনে হিসেব করে দেখল, মাত্র একটা বছর যেতে না যেতেই তার মাথার উপরে ঋণের বোঝা অনেকখানি বেড়ে গেছে। আরেকটা অভিনব অনুভূতি তাকে বার বার ছ্যাকা দিতে লাগল, কুঁড়ির যে শরীর মনের পাওনায় আপ্লুত হয়ে সে সময় পার করেছিল, তা যেন কমতে কমতে ন্যূনতম পাওনার বাইরে চলে গেছে।
আবার দ্বিতীয় বছর ঘুরে নতুন করে বিয়ের দিন ফিরে এল। নিবিড় সন্ধেয় সোহাগি স্বরে কুঁড়িকে শুনিয়ে ইব্রা বলল, এ বছরও পুরনো যাত্রাদলটি এসেছে গো।
তুমি আবার যাবে নাকি?
এখনও ঠিক করি নি, শুধু খবরটুকু তোমাকে দিলুম।
একদম ওই মুখো হবে না।
রাত বাড়লে ইচ্ছা জাগতে পারে।
কুঁড়ি ভাবল, শরীর নিয়ে খেলতে শুরু করলে ইব্রার ভিতরের টান কমতে কমতে ভাটা হয়ে যাবে কিন্তু বাস্তব অর্থে সেই খেলা ঠিকমতো জমল না। পর পর দুটো সন্তান বিইয়ে কুঁড়ির শরীরটা কেমন যেন শক্ত লাঠি হয়ে উঠেছে। নিষ্প্রাণ লাঠিতে ভর করে মানুষের শরীরে স্বপ্নের শিহরণ জাগতে পারে না। ইব্রার হৃদয়ের গভীরে বিরক্তির বোঝা বাড়ছিল এবং তা কুঁড়ির গায়ে চাপিয়ে দিয়ে সময় নষ্ট না করার অজুহাতও খুঁজে পেল। একটাই ঢেউ চলছে তার মধ্যে, বছর বছর বিয়োলে কী শরীর থাকে? সেজন্যে নিজেই যে মূল খলনায়ক, তা কিন্তু একবারও ভাবতে পারল না।
নতুন আরেকটা বছর কেটে গেল ইব্রার জীবন থেকে। কুঁড়ি তখন তিন ছেলের মা। তাকে রাতবিরেতে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয় তাদেরকে দেখভাল করতে। বাকি সময় দুজনে পাশাপাশি শুয়ে থাকলেও কুঁড়ি ভালো করেই বুঝল, তাদের শরীর মনের পুরনো সংলাপ কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকে গেছে। নতুন পরিস্থিতিতে ভিতরের পশুটা একান্তভাবে লাগামছাড়া না হলে ইব্রাও তার শরীরী ডাকে সাড়া দিতে চায় না। সৌন্দর্যভোগের ছন্দ যে তা শরীর ত্যাগ করে অনেক দূরে সরে পড়েছে, কুঁড়ির কাছে তাও অজানা থাকল না। কেমন যেন একটা নেতিভাব তার শরীর মনে দ্রুত উর্দ্ধগামী হয়ে উঠছে। কীভাবে তা কমিয়ে পূর্ব অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই সূত্র কিছুতেই কুঁড়ির মাথায় এল না। ঠিক সেই মুহূর্তে ইব্রার মাথায় একটা সম্পূর্ণ নতুন হিসেব হেলতে দুলতে খেলতে খেলতে এগিয়ে চলেছে। তা এত ধমকাতে থাকল যে নিজে নিজেই অস্থির না হয়ে পারল না। একেবারে অভিনব অনুভূতি। তার কাছে মনের চেয়ে শরীরের দাম চড়চড় করে বেড়ে চলেছে।
নতুন অবস্থান কুঁড়িকেও পৃথক ভাবনায় ঢুকে পড়তে বাধ্য করল। ইব্রার অকর্মর্যতার কারণে তার বাপের দেওয়া কুড়ি হাজার টাকা ইতিমধ্যে সংসারের হাপরে হাপিস হয়ে গেছে। তার বাপ ইব্রাকে যে সাইকেলটা দিয়েছিল, সেটাও দেনার দায়ে বিকিয়ে গেছে। অন্যান্য পাওনাদারদের সংখ্যাও বেড়েছে। তা নিয়ে কুঁড়ির মানসিক বিরক্তি শচীনের চওড়া ব্যাটের মতো। রাগ সামলাতে না পেরে একদিন সন্ধেয় কথায় কথায় বিদ্ধ করল ইব্রাকে, কী আমার সোয়ামি রে, ভাত দেবার ভাতার লয়, কিল মারার গোঁসাই।
।।৩।।
ইব্রা যে তার কথায় এতটা আঘাত পেতে পারে, বলার সময় তা বোধ হয় ভাবতে পারে নি কুঁড়ি। স্রোতের জোর ধাক্কায় ভারী পাথর যেমন এগিয়ে চলে, ইব্রার ভাবনা তেমনি নতুন পথে বইতে শুরু করল। নিজেকে নিয়ে রকমারি ভাবনার অভিনব বাজনা বাজছে তার ভিতরে। সে তো সবেমাত্র পঁচিশ বছরের যুবক। অনেকেই বলে, সুঠাম দেহশ্রীতে সে নাকি হুবহু শাহ্রুখ। কুঁড়ির চোখে সেসবের কোনো মূল্য নেই। উপলব্ধির ঘর এতটাই ফলকা?
প্রশ্নের ঝড়ে যে জোর ছিল, তাতেই কুঁড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কে ভেঙে চৌচির হতে শুরু করল। নতুন শত শত চিন্তা মনের গভীরে। সামসেরের বউ দুলিও তাকে মন দিতে চেয়েছিল। মেয়েটার শরীরের শৈলী কুঁড়ির চেয়ে ঢের ভালো, কেবল বামচোখটা একটু ট্যারা বলেই। একই ক্লাসে পড়ত দুজনে। পিছন থেকে দুলিকে দেকে সে কম উতলা হয় নি কিন্তু সামনে গেলেই সেই উতলাভাব মুহূর্তে মিলিয়ে গেছে বারবার। আজও দুলি দেখা হলেই তার দিকে শকুনির ভাগাড়চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দুলি তাকে কতবার বলেছে, বিকেলে একলা থাকলে থেকে থেকে কেবল তোর কথা মনে পড়ে। ইব্রার শরীরটা তার খুব পছন্দ।
বাড়িতে ফিরে ইব্রা মনে মনে খুব হেসেছিল। অস্ফুটে বলেছিল, তোর চোখদুটো কাল হইছে রে দুলি, নতুবা তোকে নিয়ে কবে—। চোখে চোখে মিল না হলে এমনিই হয়? ইব্রার মুখে বিচিত্র হাসি।
সাবিনাও তার ক্লাসমেট। তখনও সে বিয়ের পিঁড়িতে বসার সুযোগ পায় নি। কলেজে পড়ছে। ছাত্রী হিসেবেও ভালো। গত রবিবার সন্ধেয় যাত্রা শুনতে যাবার সময় তাকে নিয়ে যেভাবে ফস্টিনস্টি শুরু করেছিল, তাতে ইব্রা কিছু সময়ের জন্যে মজে না গিয়ে পারে নি। সাবি মজা করে প্রশ্ন করেছিল, তোর মতো রাজপুত্তুর ওই লাঠিটার সঙ্গে থাকে কী করে বলতো?
খোঁচামারা প্রশ্নে জীবনের নতুন হিসেব। ইব্রা মনে মনে চমকে না উঠে পারে নি। কুঁড়ির শরীরটা যে খেলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে, সাবির মন্তব্যে তা বেশ বুঝতে পারল। শুধু একবার ভাবল, সাবি তার দোল খাওয়া মনে বেশ তো ঝড় তুলে দিতে পারল। পরের সোমবার দ্রুত হাঁটার সময় আড়ালঘেরা রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে যেভাবে তার সঙ্গে হ্যান্ডসেক সারল, তাতেও নতুন করে জেগে উঠল ইব্রার শরীর। কেউটের ছোবলের মতো তার খুব ইচ্ছা হয়েছিল সাবিকে একবার জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পাছে কেউ দেখে ফেলে, সেই ভয়ে পারে নি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু একবার ভেবেছিল, তার বিবাগী শরীরটা কুঁড়ির কারণে সত্যি সত্যি কামারশালার হাপর হয়ে উঠেছে, লোহা পুড়িয়ে লাল করার জন্যে প্রচুর কয়লা টানার ইচ্ছায় ভরপুর হয়ে আছে।
ইব্রার খেয়াল ছিল না যে শ্বশুরের দেওয়া নগদ কুড়ি হাজার টাকা সে নিজের হাতে শেষ করে দিয়েছে। হাত ঘড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিদিন যত্রতত্র খেতে যে সাইকেলটা ব্যবহারে লাগে, সেটাও নেই, ঋণের ক্ষতে মিলিয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু কুঁড়ির কানের দামি দুটো দুল, কিন্তু কুঁড়ির সাফ কথা, বাপের বাড়ির স্মৃতিটুকু মুইছ্যা দিতে পারুম না।
ইব্রার আর্থিক টান চরম হয়ে উঠল। একদিন সন্ধেয় কুঁড়িকে ভয় দেখিয়ে বলল, কথা শুইন্যা না চললে তোরে তিন তালাক দিমু।
কুঁড়ি প্রতিবাদে ঝড় তুলে দিল। —কী বলত্যাছো গো? আমার বাপের টাকাগুলো উদরে পুইর্যা আমাকে খ্যাদানের ধান্দা করত্যাছো? তুমার মতো মিনসের কপালে আগুন।
বিবাগি কুঁড়ি যে কানের দুলদুটো রেখে দিতে বদ্ধপরিকর, তা বুঝতে ইব্রার এতটুকু অসুবিধা হল না। আরও বুঝল, এতদিনেও কুঁড়ি তার সুঠাম দেহভাগের মূল্যটুকু বুঝতে পারল না। ভাবনার বিড়াম্বনায় অস্থির হতে থাকল। পরের দিন বিকেলে ইব্রা কখন বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, কুঁড়ি তা জানতে পারল না। সময় পার হতে হতে সূর্যের সাতরঙ দূরের মাঠে সবুজের বুকে রঙিন স্বপ্ন জাগিয়ে মিলিয়ে গেল। কুঁড়ি ঘরে ঢুকে দেখল, মাটির হাঁড়িতে অল্প পরিমাণ চাল আছে। মাপলে এক কেজির মতো হতে পারে।
আঁচলের খুঁট খুলে দশ টাকার নোটটা সঙ্গে নিয়ে পাড়ার মুদিখানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল কুঁড়ি, কিনল আলু লবণ তেল। পরিমাণে অল্প অল্প। ফেরার পথে আপন মনে একটু হাসল, তার মিনসেটা এমনিই। নিশ্চয় ফিরবে বেশ রাত করে। এত করে বলার পরেও নিজেকে ঠিকমতো সামলে চলতে পারল না। তখনও কুঁড়ির অন্তরের নরম দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছিল ইব্রার উপর। হাজার হোক, সোয়ামি তার, রাত-বাসরের ঘনিষ্টতম বন্ধু। আবেগের আতিশয্যে ইব্রা সত্যি সত্যি শাহরুখ হয়ে উঠতে পারে। কুঁড়ি মৃদু হাসি ফোটালো দু’ঠোঁটের ফাঁকে।
রাত বাড়তে লাগল প্রহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, কুঁড়ি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। রাত আরও বাড়লে পাশের শূন্য জায়গাতে সে খুঁজে পেতে চাইল ইব্রাকে। কেমন যেন মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ল। বুঝল, শূন্য ছোবলের মধ্যে ইব্রার প্রতিকৃতি দুর্বার হয়ে উঠছে। ইব্রা পাশে শুয়ে থাকলে বিছানার স্যাতসেতে গন্ধ টের পেত না। কুঁড়ি কিন্তু সময়ের বিড়ম্বনায় সেই ভ্যাপসা গন্ধ কুঁড়িকে বার বার ছুঁয়ে যেতে থাকল। ইব্রার শরীরী স্পর্শ পাবার জন্যে ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে উঠল। হৃদয়ের কোণে কোণে দোল খাচ্ছে বিশেষ অনুভূতির স্পন্দন। তাহলে ইব্রা তার রাতের জীবনে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এতদিন সে তা অনুভব করতে পারে নি? আধো ঘুমের মধ্যে বার বা মনে হতে থাকল, কে যেন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে কুঁড়ি কুঁড়ি বলে ডাকছে। দরজা খুলে দিয়ে দেখল, ইব্রা নেশার ঘোরে টলছে, মুখে বিটকেল গন্ধ। তাতেও এতটুকু রাগ করল না কুঁড়ি। অন্তত বিছানার দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পাবে সে। শুধু একবার বিনীত স্বরে বলল, কী খ্যায়া আইছ গো?
ইব্রা কোনো উত্তর না দিয়ে জামা প্যান্ট খুলে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিল। কুঁড়ি তার নরম শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার উপর রাগ কইর্যা ছাইপাঁস খাইল্যা? হেই দ্যাখো, কান দুটা খালি কইরা দিয়েছি। লিয়ে যাও তুমি, যা খুশি করো গা।
ইব্রা মত্ততার ঘোরে বিছানার একপাশে চুপচাপ শুয়ে থাকল, ক্লান্তির ঘুম সারা শরীর জুড়ে। কুঁড়ি নিজের শরীরটা ইব্রার শরীরের সঙ্গে সেঁটে দিয়ে জেগে থাকল অনেকটা সময়। বাইরের অন্ধকারে মাদকতার ঢেউ। কুঁড়ির শরীরেও সেই অনুভূতির ঢেউ উপছে পড়ছে কিন্তু ইব্রার কাছ থেকে কোনো সাড়া পেল না সে। বিছানার ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে ঠেকছে না, সেই অনুভব নিয়ে কুঁড়ি চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল ইব্রার মুখ। ভোররাতে আর জেগে থাকা সম্ভব হল না, আনন্দের লহরি শরীরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য হল। জীবন যে এত গভীর অনুসঙ্গের, তা কুঁড়ি আগে কোনোদিন ভাবতে পারে নি।
সকালে জেগে উঠে বাম পাশে চোখ রেখে দেখল, ইব্রা বিছানায় নেই। এত সকালে গেল কোথায়? ও তো রোজ সকালে দেরি করেই ওঠে। দেখল, কাঠের ভাঙা বাক্সের মধ্যে কাগজে মুড়ে যে দুলজোড়া রেখেছিল, তা নেই। হাসি পেল কুঁড়ির। হৃদয়ের গভীরে অন্য ধরণের খুশির বন্যা। আনমনে অস্ফুটে বলল, কানের দুল লিয়া কী করুম, মানের মানুষডারে আমার চাই।
আরেকটু পরে সোনালি পোষাক পরে নতুন সূর্য পূব আকাশে উঁকি মেরে নতুন দিনের শুভ সূচনা ঘটিয়ে দিল।
সাবির বাড়ি থেকে লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ইব্রা কই?
কুঁড়ির বিনীত উত্তর, বাড়িতে নেই।
কোথায় গিয়েছে বলতে পারবে?
ভোর রাতে জেগে উঠে দেখি, বিছানায় নেই।
সাবির বাড়ির লোকজনদের রাশারাশি শুরু হল। —ভেবেছে কী ইব্রা? এখনিই পুলিশে যাচ্ছি। ভালোমতো টের পাইয়ে দেব ওকে।
আরও একটু পরে সামসেরের ট্যারা বউ এসে কুঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঝড় তুলে দিল। রাগে কাঁপছিল সে। ভিতরের ঝংকার উগরে দিয়ে বলল, বিড়ি বাঁইধ্যা খাস রে কুঁড়ি, প্রয়োজনে পরের বাড়িতে কাজ কইর্যা খাস কিন্তু ওই মিনসেডারে আর নিস না। ও পুরুষ মানুষ লয় রে, শরীরী খোরাক টানার হাপর।
আমার লেখা গল্প — প্রহসন – এর প্রথম পর্ব কাল লিখেছি, আজ ১১/১০/২১ – এ লিখব দ্বিতীয় পর্ব।