পর্ব – ছয়: মানবী নয় বিদ্যুৎকন্যা
নিজের চোখের ভেতর থেকে সজোরে বেরিয়ে আসা সুপার কম্পিউটার প্রযুক্তির গ্রিড কম্পিউটিং সিস্টেমের তৈরি টানেলে উর্বশীর সঙ্গী, তরুণটি দেখল পাহাড়চূড়ার মানব-মানবীর আলাদা অস্তিত্বের ভর প্রবল আকর্ষণে বিলীন হয়ে গেছে একে অপরের মধ্যে। দুজনে মিলে এক ভর, এক অস্তিত্ব হয়ে আলো ছড়াচ্ছে- এই বিলীন অস্তিত্বের ভেতর থেকে আগের মানবীরূপে ফিরে আসতে পারবে উর্বশী? সহস্র টন বারুদের বিস্ফোরণ ঘটল প্রশ্নমালায়। বিস্ফোরিত আলোর ঝলকেও ও দেখল ভরহীন অস্তিত্বের ভয়। আর সেই ভরের কেন্দ্র থেকে উৎসারিত হচ্ছে চন্দন আলোর শিখা। হাহাকার করে উঠল তরুণটির মন। এই হাহাকারের অর্থ জানা নেই। উর্বশীকে ভালোবাসে কিনা, সন্দেহ থাকলেও তার দেহের প্রতি যে-টান তৈরি হয়েছিল, সেই টানের প্রতি সন্দেহ না থাকলেও সব হারানোর শংকায় নিজের অনুরণে জেগে উঠল হতাশা।
পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে লোভ আর আকাঙ্ক্ষার গোপন তাড়নায় নিয়ে তবু দাঁড়িয়ে রইল তরুণটি।
আকস্মিক একটা পরিবর্তিত আবহ ফুটে উঠল চারপাশে, পাহাড় চূড়ায়। ওপরে তাকিয়ে ও দেখল আপন অস্তিত্ব নিয়ে উর্বশী হাতের ইশারায় ডাকছে তাকে, ‘উঠে এসো হিমাদ্রি।’
ডাকে সাড়া দিতে পারছে না হিমাদ্রি। মুখ ফুটে কথাও বেরুচ্ছে না। ওর বুকের ভেতর খলবল করে শব্দ ফুটছে। অথচ একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারছে না।
‘হিমাদ্রি! এমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? উপরে এসো। দেখো, সাগর থেকে উঠে আসা রংধনু আবার মিশে গেছে সাগরে। আমাকে আলোর পরশ আর আদর দিয়ে গেছে। উঠো, ওপরে উঠো। দেখো পাহাড় আর সাগরের সৌন্দর্যের বিস্ময়কর রূপ!’
উর্বশীর ডাকে নতুনভাবে নড়ে উঠল হিমাদ্রির মন। নিজের নাম নিজ কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের কোমল বাতাস ঝাপটা দিল ওর মুখে। চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে উঠল স্বাভাবিক প্রকৃতি পাহাড়, গাছ-গাছালি, সাগর আর পাহাড় থেকে দৃশ্যমান অথই জল। সাগর থেকে উঠে আসা বাঁকানো আলোর বিম একটানে ছুটে গেছে সাগরে। নীল সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জল শুষে নিয়েছে পাহাড় আর সমুদ্রের সংযোগকারী রংধনুর মতো আলোর বাঁকানো বিম। দৃশ্যটি কেড়ে নিয়েছিল আত্মার জলজ উপাদান, ভয় আর তৃষ্ণায় জড়িয়ে গিয়েছিল গলা। উর্বশীর কণ্ঠে নিজের নাম শোনার পর ভিজে উঠেছে জিহ্বা। শব্দধ্বনি বেরুল এবার, ‘উর্বশী, নেমে এসো।’
হিমাদ্রির ক্ষীণ কণ্ঠ দশ ফুট দূরত্ব অতিক্রম না করেই মিলিয়ে গেল শূন্যে।
উর্বশীর উচ্ছ্বাস কমছে না- ওর আনন্দদ্যুতি দুঃস্বপ্নকে পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষা আর লালসার ঢেউ আকস্মিক দুর্বিনীত মোচড় দিল হিমাদ্রির দেহে। এবার সে জোরালো কণ্ঠে বলল, ‘নেমে এসো উর্বশী, ফিরে যাই। এই নির্জন পাহাড় থেকে বেরোও। নেমে এসো।’
‘পাহাড় কোথায় দেখলে। আমি তো পাহাড় দেখছি না। দেখছি আলো। থকথকে আলোর কার্পেটে পা রেখে রেখে হাঁটছি। আমার আত্মার ভেতর চুপচাপ পুরে নিয়েছি ঝলমলে আরেক আত্মা; প্রবল বাতাসে নিঃশ্বাসের আঁচড় খেয়েছি তার। স্পর্শের মাঝেও পেয়েছি অপূর্ব স্পর্শের কামড়। নির্জনতা কোথায়, নৈঃশব্দ্যের কলরোল দেখছো না কেন?’
আবার ভয় পেয়ে অসাড় হয়ে যেতে লাগল হিমাদ্রির দেহের মোচড়। আকাঙ্ক্ষার পাপড়ি গুটিয়ে যেতে লাগল উর্বশীর কথা শুনে। উর্বশীর উৎসারিত আলো হিমাদ্রির দেহের কামনায় ঢেলে দিল আঁধার। গোপন পোকার কামড় বসে গেল বিবেকের মাংসে। একবার ইচ্ছে হলো ফিরে যেতে। কয়েক পা পেছনে গিয়ে সামনে এগোল আবার। উর্বশী নেমে আসছে। উর্বশীকে নিয়েই ফিরবে- এমন মনোভাবে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়াল হিমাদ্রি।
কাছে আসার পর উর্বশীর দিকে হাত বাড়াল হিমাদ্রি। হাতে হাত না রেখে, একবার সাগরের দিকে তর্জনি তাক করে উর্বশী বলল, ‘ওই যে দেখো নীল সমুদ্রে ঢেউ উঠছে। হাত ধরো না, ডুবে যাবে, ঢেউয়ের আঘাতে চুরমার হয়ে যাবে।’
উর্বশীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল হিমাদ্রি। তখনই পাহাড়টা হঠাৎ কেঁপে উঠল।
হিমাদ্রির মনে হলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে মহাশূন্যের সিংহাসনে সূর্যের আলপনায় বাঁধানো মুকুটপরা অসামান্য এক নারী- তার অঙুলি হেলনে কেঁপে উঠেছে পাহাড়; ঢেউ জেগেছে অথই জলে। আঁধার গিলে ফেলছে ওকে- ভেবে ভয় পেয়ে একবার চিৎকার দিল। স্ফীত হলো অবিশ্বাস্য আতঙ্ক আর যন্ত্রণার পেরেক গেঁথে গেল বুকে। এ যন্ত্রণার উৎস জানা নেই ওর। ভয়ের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে যন্ত্রণা। শুদ্ধতার অঙুলি হেলনে যেন উর্বশী উপুড় করে দিয়েছে বিষপাত্র। একই সঙ্গে ওর মনে হলো স্বচ্ছতার পূর্ণস্নান সেরে উর্বশী ধারণ করেছে নতুন কোনো শারীরিক বর্ম।
ভাবতে ভাবতে বাড়ানো হাত ফিরিয়ে নিল হিমাদ্রি।
সেদিকে নজর দিল না উর্বশী। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গেল মোটর বাইকের দিকে। কেন এসেছিল, উদ্দেশ্য কী ছিল, সব ভুলে দাঁড়াল মোটর বাইকের পাশে।
রোবট হয়ে গেছে হিমাদ্রি। পরিবর্তিত উর্বশীকে আর চেনা যাচ্ছে না। সূর্যের আলো নয়, মুখে ঝিলমিল করছে চন্দন আলো। আলোর পরশ পেয়ে সূর্য বোধ হয় মূর্ছা গেছে, অথবা লুকিয়ে ফেলেছে লালচোখ। চন্দন আলো চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দ্যের অন্তরদেশে জ্বলে উঠেছে নক্ষত্রপুঞ্জ। বাইকে বসে হ্যান্ডেল ধরে স্টার্টারে চাপ দিয়ে বলল, ‘ওঠো। বসো পেছনে।’
সুবোধ বালিকার মতো উর্বশী উঠে বসল পেছনে। আশ্চর্য পরিবর্তন টের পেল হিমাদ্রি। পেছনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরার কথা। সেভাবেই এসেছিল। এখন বসল দূরত্ব মেপে। এ দূরত্বকে সহজ কোনো শূন্যতা মনে হলো না। বরং ওর মনে হানা দিল নতুন ভাবনা―নক্ষত্রপুঞ্জের দূরত্বের চেয়েও এ দূরত্বের ব্যাপ্তি অনেক বেশি।
বাইকের গিয়ারে চাপ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার মুহূর্তে কিছুটা উড়ে এসে উর্বশী ধাক্কা খেল হিমাদ্রির পিঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু সংঘর্ষের মতো কাঁপন উঠল দেহের কোষে কোষে। ইলেকট্রিসিটির শক লাগলে যেমন হয়, তেমনিভাবে কেঁপে কেঁপে উঠল হিমাদ্রি। তার মনে হতে লাগল উর্বশী এখন আর কোনো মানবীকন্যা নয়, বিদ্যুৎকন্যায় বদলে গেছে। ভয়ে কুঁকড়ে গেল হিমাদ্রির দেহ। একই সিটে বসা দুজনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল সহস্র মাইল দূরত্ব। এ দূরত্বের খবর টের পেল না উর্বশী।
চলবে…