‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – দুই

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল
14 মিনিটে পড়ুন

পর্ব – দুই: উড়ে উড়ে আসছে অর্ণব

ডানে-বাঁয়ে তাকাল উর্বশী। দুপুরেও চারপাশে গিজগিজ করছিল মানুষের ঢল। অথচ এখন জনশূন্য সৈকত। নিজে নাড়া খেল―বুকের ভেতর লুকোনো মায়াপ্রপাতের বাঁধ ভেঙে গেল। শক্তিধর জোয়ারের স্রোতের চেয়েও মহাক্ষমতাবান মায়ার ঢেউ আছড়ে পড়ল বুকে। আর তখনই উর্বশী দেখল ঢেউয়ের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে ডিঙ্গি নৌকোর বৈঠা শক্ত হাতে ধরে অর্ণব দূরসীমানা থেকে এগিয়ে আসছে সৈকতপানে। উর্বশী চিৎকার জুড়ে দিল, ‘ওই যে, ওই দেখুন অর্ণব এগিয়ে আসছে ডিঙ্গি নৌকো বেয়ে।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৈকতরক্ষী বলল, ‘আপা! কোনো নৌকো ভাসছে না সাগরে। কেউ এগিয়েও আসছে না। ফিরে যান আপনার হোটেলে।’
আহ্লাদ ফুটল বুকের ঘরে ফুল হয়ে। আহ্লাদে আরেকবার নিজেকে ধুয়ে উর্বশী বলল, ‘কী বলছেন এসব, অর্ণবকে না নিয়ে ফিরব? ওকে একা ফেলে যাব? ও আসুক। আমি অপেক্ষা করছি।’
‘সাগরে কেউ নেই। দেখুন, সৈকত ফাঁকা হয়ে গেছে। এ সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।’
‘কেউ নেই মানে? ওই যে, চারপাশে মানুষের কোলাহল শুনতে পাচ্ছি।’
‘মানুষজন নেই আপা! মানুষের কোলাহলও নেই। সাগর ডাকছে, নির্জন রাতে সাগরের গর্জন আরও বাড়বে। ওই ডাককে আপনি ভাবছেন মানুষের কোলাহল হিসেবে। চলুন প্লিজ!’
উর্বশীর মনে হতে লাগল সামনে দাঁড়ানো লোকটা মর্ত্যলোকের নয়, আঁধারে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো অশরীরী গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে তাকে। ভয় জয় করার কৌশল জানা আছে। অশরীরীর সামনে থেকে পালিয়ে নয়, তার দিকে দু কদম এগিয়ে বলল, ‘সামনে থেকে সরো। আমার পিছু ছাড়ো, আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না। আমি দেখছি, ওই যে, আঁধারের ভেতর সাগরের সাদা জলআলোয় ভাসছে অর্ণব। ওই যে আসছে এগিয়ে। ওকে না নিয়ে যাব আমি? সরো।’
সৈকতরক্ষী স্তব্ধ হয়ে গেল কথা শুনে। ভয়ও পেল। সে জানে না অর্ণবের কথা। অর্ণব কি ওই তরুণীর স্বামী? সাগরে নেমেছিল? ঢেউয়ের তলে চাপা পড়ে গেছে? টেনে নিয়ে গেছে সাগর, নাকি ভ্রান্ত বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছে এখানে? আজ দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি। এখন প্রায় সাড়ে নটা। কোথাও তো আলোচনা শোনেনি―কেউ সাগরের টানে ভেসে গেছে এমন কথা কোথাও আলাপ হয়নি। সাগরপাড়ের উদ্ধারকর্মীরাও জানে না এ খবর। সাগরে নামা শত শত পর্যটকের মধ্য থেকে টুপ করে কি তবে একজন মানুষ গিলে ফেলেছে সমুদ্র-ঢেউ? নিজের ভাবনায় উড়ে আসা প্রশ্নগুলো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আরো কাছে, মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে এবার সৈকতরক্ষী বলল, ‘আপা, আপনার মন বেশি খারাপ? বেশি মন খারাপ হলেই অনেকে এভাবে সাগরপাড়ে এসে সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলে, সাগরের ঢেউয়ের মধ্যে ভাসিয়ে দেয় মনের দুঃখ-কষ্ট। হালকা হয় মন, এজন্য তাদের বাধা দেই না। আমরা সহযোগিতা করি। তাদের নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করি। এখন আপনাকে সহযোগিতা করতে পারছি না। চলে যেতে হবে আমাকে। আপনাকেও সৈকত ছাড়তে হবে। ওই যে দেখুন আঁধারেও দেখা যাচ্ছে আকাশে উড়াল মেঘ। কেমন ফুঁসে উঠছে মেঘ। এগিয়ে আসছে। যে কোনো মুহূর্তে বাতাস শুরু হয়ে যেতে পারে, ঝড় আসতে পারে। চলুন, আপা আপনাকে টমটমে উঠিয়ে দিই। আপনার গন্তব্যে ফিরে যান।’
সুবোধ বালিকার মতো কথাগুলো শুনল উর্বশী। তারপর চিৎকার করে সামনে আঙুল তুলে বলতে লাগল, ‘ওই যে মেঘ। মেঘের মধ্যেও আলো আছে। ওই যে, আঁধারে মেঘজুড়ে আলোর ফুল ফুটেছে। ওই যে ফুলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে হাসছে অর্ণব। আপনি সরুন। চলে যান। অর্ণব উড়ে উড়ে আসছে। ও আসুক, একসঙ্গে যাব আমরা।’
‘বৈশাখি বাতাসে বিশ্বাস নেই, আপা। হুশ করে বাতাসের চাপে সৈকতে জলোচ্ছ্বাস ঘটতে পারে? বিপদ হতে পারে। সরে আসুন। অন্ধকারে পথ খুঁজে পাবেন না। আলাবোলায় ধরতে পারে আপনাকে। পথ হারালে সৈকতে রাতে মূল রাস্তা খুঁজে পাবেন না, হোটেল খুঁজে পাবেন না।’
কুট করে পায়ে একটা পিন ফোটানো কামড় খেল উর্বশী। ব্যথা পেয়ে লাফিয়ে উঠে তাকাল পায়ের দিকে। ডান পায়ের ওপর একটা লাল কাঁকড়া কামড়ে ধরে বসে আছে। দেখল সৈকতরক্ষীর হাতে ধরা টর্চলাইটের ফোকাস-আলো থেকে। গার্ডের উপদেশবাণী, অনুরোধ কিছুই ওর মাথায় ঢুকল না। বসে পড়ল হামাগুড়ি দিয়ে। ডান হাত দিয়ে কাঁকড়াটি ধরতে গিয়েও সাহস পেল না উর্বশী, অবাক হয়ে টর্চের আলোয় দেখতে লাগল লাল কাঁকড়ার লাল চোখ।
সৈকতরক্ষী বলল, ‘পা ঝাড়া দিন। হাতে ধরার দরকার নেই।’
ঝাড়া দিল না উর্বশী। অবাক হয়ে দেখল মুহূর্তের মধ্যে আরও অসংখ্য কাঁকড়া ছুটে আসছে তার পায়ের দিকে।
‘পা ঝাড়া দিন, সরে আসুন। শত শত কাঁকড়া খাদ্যের গন্ধ পেয়ে ভেজা বালিতটের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে। মুহূর্তেই সাবাড় করে দেবে পা। ওরা ভেবেছে আপনার পা নরম খাদ্য। নড়াচড়া না করলে ভাববে সদ্য মৃত কোনো মাংসপিণ্ড, ওরা শুঁড় নাড়াচ্ছে। সরে আসুন, প্লিজ!’
উর্বশী সরলো না। চোখের পলক ফেলার চেয়েও দ্রুত গতিতে হাজার হাজার কাঁকড়া ছুটে এসে ঘিরে ফেলেছে উর্বশীর পা।
আর ধৈর্য ধরতে পারল না রক্ষী। টর্চের আলো ফেলল পায়ের খুব কাছ থেকে। আলোর তীব্রতায় পায়ের কামড় ছেড়ে দ্রুতই পালিয়ে যেতে লাগল কাঁকড়াদল।
উর্বশীর হাত ধরে টেনে বলল, ‘চলুন আপনাকে হোটেলে দিয়ে আসি।’
উর্বশী শীতল গলায় জবাব দিল, ‘না। যাব না, অর্ণব না ফেরা পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব আমি।’
মহাবিপদে পড়ে গেল রক্ষী। তার যাওয়ার সময় হলেও একাকী সে একটা মেয়েকে সৈকতে রেখে যেতে পারে না- সেই শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নেই তাদের। সৈকতে বিপদগ্রস্তদের রক্ষা করাই তাদের কাজ। অথচ ঘনায়মান আঁধারের উত্তাল-উন্মত্ততায়ও কাঁপছে না মেয়েটি, ভয় পাচ্ছে না। কেমন নির্বিকার অলীক বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে- সাগর থেকে রাজকুমার উঠে আসবে, তার প্রতীক্ষার যেন শেষ নেই। রক্ষীর মনে হলো এটা কোনো আরব্যরজনীর গল্প। রূপকথার কাহিনি। অথবা নিজেই আলাবোলায় আক্রান্ত হয়েছে, কোনো মেয়ে সামনে নেই, অথচ কথা বলছে, দেখছে অলীক কোনো তরুণীকে। ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রোম শিউরে ওঠা মাত্রই রক্ষী আবার লাইট ফোকাস করল মেয়েটির মুখে।
উর্বশী হাসছে। সাগরের নীল ফুটে আছে ওর মুখে- জলের রুপোলি শস্য থেকে যেন গ্রহণ করছে নির্মলতার ছাঁট। এ ধরনের আলো আর আঁধারে আকাশে কোথাও সমুদ্রপাখি না উড়লেও এখন প্রাণ উজাড় করে ও দেখছে হাজারো উড়াল পাখির ঝাঁক।
হঠাৎ চোখ নামিয়ে ও আবার পায়ের দিকে তাকাল। প্রথম কাঁকড়াটি এখনও নখ ফুটিয়ে বসে আছে উর্বশীর পায়ে। টর্চের লাল আলোর ঝলকানিকে চোখ রাঙানো শাসন হিসেবে মানেনি কাঁকড়াটি; যেন নেমেছে মরণযুদ্ধে। আঁধার আবার আলোয় ভরে উঠল রক্ষীর টর্চের আলোয়। বেলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে রক্ষী পা কামড়ানো কাঁকড়াটি টোকা দিয়ে যেই সরিয়ে দিতে যাবে, তখনি উর্বশী সরিয়ে নিল পা। কাঁকড়াটিকে সরিয়ে দিতে চায় না ও। কাঁকড়ার কামড়ের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে ও জীবনকামড়ের স্বাদ। সমুদ্রের এ অসাধারণ প্রাণীটির মরণকামড়ের ভেতর থেকেও এমনি অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে উর্বশী প্রশ্ন করল, ‘পায়ের কাছে বসলেন কেন? উঠে দাঁড়ান। আর ওই পচা টর্চের আলো বন্ধ করুন। আকাশের দিকে দেখুন, শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠছে। ওই যে দেখুন চাঁদ-আলোর রুপোলি ঢেউয়ে চড়ে এগিয়ে আসছে আমার অর্ণব। ও এলে আপনাকে মার দেবে। নিরাপদে পালিয়ে যান দ্রুত।’
স্তব্ধ হয়ে গেল রক্ষী। দিশেহারা হয়ে বাজালো বিপদ সঙ্কেতের হুঁইশেল।
মগ্নতার খোলস ভাঙল না উর্বশীর। আরো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাকিয়ে রইল উত্তাল সাগরপানে। আসলেই উদিত হয়েছে চাঁদ- জোছনার আলো বুকে ধারণ করে, অর্ণবকে নিয়ে হাজার হাজার ঢেউ এগিয়ে আসছে তার দিকে- আঁধারেও এ বিশ্বাসে ঋদ্ধ হতে লাগল ও।
ওদের দিকে ছুটে এলো সৈকতরক্ষীদের জরুরি একটা জিপ। চারজন ডুবুরিসহ আরও কয়েকজন উদ্ধারকর্মী ছুটে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে।
‘কী হয়েছে? এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এ তরুণী এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন?’ রক্ষীকে উদ্দেশ করেই প্রশ্নটা করল উদ্ধারকর্মীরা।
‘উনি কি মানবী না ভূত, বুঝতে পারছি না। অদ্ভুত আচরণ করছেন, অদ্ভুত কথা বলছেন!’
ধমক দিলেন বস-শ্রেণির একজন। ‘আজেবাজে কথা রাখো। ওনাকে সসম্মানে পৌঁছে দাও হোটেলে।’
‘উনি কথা শুনছেন না, স্যার। আঁধারের সঙ্গে কথা বলছেন, বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলছেন। বুঝতে পারছি না উনার কথা। আমার শত অনুরোধ সত্ত্বেও স্থান ত্যাগ করছেন না। সাগর থেকে কে যেন উঠে আসবে, বলছেন।’
‘ওনার সঙ্গে কেউ নেই?’
‘না, নেই। তবে কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন ছিল, সম্ভবত ওনার স্বামী। সাগরে নেমেছেন। উঠে আসছেন না।’
‘সে কি? উদ্ধারকর্মীদের খবর দাওনি কেন?’
‘বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারছি না, স্যার। তাছাড়া হঠাৎ করে সাগরে একজন মানুষ টুপ করে হারিয়ে যাওয়ার কথাও বিশ্বাস করতে পারছি না। দুপুর থেকেই উনি এখানে একাকী দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে কাউকে দেখিনি।’
উদ্ধারকর্মীদের একজন প্রশ্ন করল, ‘আপনার নাম কি, প্লিজ?’
‘আমার নাম উর্বশী।’ নরম কণ্ঠে জবাব দিয়ে উর্বশী আবার বলতে লাগল, ‘আমার স্বামীর নাম অর্ণব। আমার বাবার নাম… আমার মায়ের নাম…।’
‘থামুন, থামুন। আগে বলুন এখানে অসময়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
‘আমার হাজবেন্ড অর্ণবের জন্য।’
‘অর্ণব সাহেব কোথায়?’
‘সাগরে নেমেছে। ফিরে আসবে এখুনি।’
‘সাগরে নেমেছেন? কখন?’
‘দুপুরে।’
‘সে কি! দুপুর থেকেই তো শত শত পর্যটক গিজগিজ করছিল সৈকতে। তখন তো ভাটা ছিল। সৈকতে উড়ছিল সাবধান-সঙ্কেত, লাল পতাকা! তখন কি নেমেছিলেন তিনি সাগরে?’
‘হ্যাঁ, তখন নেমেছিলেন। ফিরে আসবে এখন। এলেই চলে যাব আমাদের হোটেলে।’
‘হোটেলের নাম কি?’
‘ওশেন প্যারাডাইস।’
‘রুম নম্বর বলতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ। ৪৬২…’

হোটেলে ফোন করে জানা গেল আসল খবর। অর্ণব চৌধুরী সত্যিই উর্বশীর হাজবেন্ড। দুপুরে সৈকতের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন এই নবদম্পতি।
অর্ণব সাগরে সত্যিই নেমেছিলেন সাগরে? কিনা জানার জন্য অনুসন্ধানে নেমে পড়ল উদ্ধারকারী দলের দুজন। সামনে সাগর আর পানি। ঘাপটি মেরে থাকা মেঘ ফুঁড়ে এবার গর্জন উঠল।
উর্বশী বলল, ‘ওই যে, অর্ণব ডাকছে। অপেক্ষা করতে বলছে। আপনারা আমাকে যেতে বলছেন কেন? দেখুন ওই লাল কাঁকড়াটি কত ভালো। পা কামড়ে ধরে বসে আছে। বলছে, যেও না, অর্ণব এলে নিয়ে যেও ওকে। তুমি চলে গেলে ও ফিরে এসে কষ্ট পাবে, যেও না তুমি। দাঁড়িয়ে থাকো সাগর সৈকতে…’
উদ্ধারকর্মী দলনেতা একজনের উদ্দেশে বলল, ‘ওনার বাবার সঙ্গে কথা বলো। আসল খবর জেনে নাও। আর হোটেলে ফেরত পাঠাও ওনাকে। উনি অসংলগ্ন কথা বলছেন। যিনি লাল কাঁকড়ার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না।’
উর্বশী ক্ষেপে উঠল, ‘কী বলছেন? স্বাভাবিক না মানে কী! আমি কি ভুল বলছি? কাঁকড়া কথা বলছে, কথাটা কি ভুল? আপনিই ভুল। সরুন সামনে থেকে। মনে করেছেন অর্ণবকে রেখে চলে যাব আমি? কখ্খোনা না। ওকে নিয়েই ফিরব হোটেলে।’
জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া যায় অপরাধীকে। মেয়েটিকে অপরাধী ভাবতে পারছেন না দলনেতা, আবার স্বাভাবিকও ভাবতে পারছেন না। গায়ে হাত দিয়ে মেয়ে অপরাধীকেও ধরে নেওয়ার প্রশিক্ষণ নেই তাদের। কী করবেন ভাবছেন। হঠাৎ বুদ্ধি এলো মাথায়- ‘ঠিক আছে। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলব, মোবাইল ফোনে ধরিয়ে দিন আমাকে।’
‘বাবার সঙ্গে কথা বলবেন, কারণ কী? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?’
নরম কণ্ঠে দলনেতা বললেন, ‘হচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে। এ জন্যই কথা বলব। রাত বাড়ছে। সৈকত শূন্য হয়ে গেছে। এ সময় তো আপনাকে একা ফেলে রেখে যেতে পারি না আমরা।’
হো হো করে হেসে উঠল উর্বশী। ‘আমি একা না। ওই যে দেখুন- লাল কাঁকড়াটি আছে আমার সঙ্গে। আমার পা জড়িয়ে রেখেছে। আমি যেন যেতে না পারি, সে জন্য অর্ণব নিশ্চয়ই ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
দলনেতা আর কথা না বাড়িয়ে পোষমানা ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঠিক আছে, মানলাম আপনার কথা। এখন ফোনে আপনার বাবাকে ধরিয়ে দিন।’
‘ও! আমার কথা এখনও বিশ্বাস করছেন না, নিন ধরিয়ে দিচ্ছি। আমার বাবার সঙ্গে কথা বলুন।’ বলতে বলতে কাঁধে ঝোলানো ক্যাজুয়েল ব্যাগের চেইন খুলে ফোনসেট বের করে কানেক্ট করে বাবাকে বলল, ‘দেখো বাবা সৈকতের লোকজন আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। তুমি কথা বলো, বুঝিয়ে দাও ওদের সব কথা।’
উর্বশীর বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘোলা পানির প্রবল ঘূর্ণির মতো ঘুরতে লাগল সৈকতরক্ষীর চোখ। পাষাণ সাগরের গর্জনকে তার মনে হতে লাগল নির্মমতার বিজয়োল্লাস। আসল খবর আড়ালে রেখে দলনেতা উর্বশীর বাবার উদ্দেশে বললেন, ‘মোবাইল ফোন হাতে রাখুন, প্লিজ। কিছুক্ষণ পর আবার কল করব আমি।’
উর্বশীর বাবা আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কোনো দুঃসংবাদ। এত রাতে ওরা সৈকতে কেন?’
সাগরের হু হু আওয়াজের সঙ্গে আঁধারে ধেয়ে আসা মেঘের গর্জন মিশে গেল। হঠাৎ ঝলক দিয়ে উঠল অন্ধকার আকাশ। দাপুটে আঁধারে ভেসে গেল আকাশরাঙা লালচে আলোয়। সেই আলো বিস্তৃত জলসীমায় ছড়িয়ে দিল বিদ্যুৎঝলক। অসীম সাগরজলের তরঙ্গধ্বনিতে অনুশোচনা নেই, উত্তাল তরঙ্গ বিজয়োল্লাস করে সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে বুক ভরে মানবরক্ত শুষে। অথই জলের তলে শৈল্পিক ঢঙে গড়ে ওঠা জলজ উদ্ভিদের শান্ত পরিবেশে যেন হানা দিয়েছে জলদস্যু। নিঃশব্দতার ভেতর ঘটে চলেছে মহাবিপ্লবের রণডংকা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে শান্তির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কোথাও শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই- ঘরে নেই রাজপথে নেই, নির্মল সমুদ্রপাড়েও নেই―কোথায় নিরাপত্তা? কোথায় শান্তি? আচমকা উদিত প্রশ্নের বেপরোয়া আক্রমণে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠল উর্বশী- সজোরে ডাক দিল, ‘অর্ণব… অর্ণব…’ চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ও সৈকতে। কাঁকড়াটা এখনও ছাড়েনি তার পা। এখনও রাজকীয় ঢঙে আঁকড়ে ধরে বসে আছে পায়ের পাতার ওপর।
উদ্ধারকারী দলনেতা বললেন, ‘মনে হয় মেয়েটির ঘোর কেটে গেছে। বাস্তবে ফিরে এসে স্বামীকে না দেখে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। যাও। হাসপাতালে নিয়ে যাও দুজনে। আর আমরা সন্ধান করি সৈকতে।’
গাড়ির লম্বা সিটে শুইয়ে দিয়েছে ওরা উর্বশীকে, সৈকতরক্ষীদেরও একজন আছে গাড়িতে। কৌতূহলী হয়ে শক্ত করে বসে আছে সে। কাঁকড়াটিকে চিমটি দিয়ে ধরে ছুড়ে ফেলে দিতে হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখল গোল মার্বেলের মতো ঘুরছে কাঁকড়ার লাল চোখ। ঘূর্ণায়মান লাল চোখের ছোবল খেল তার চোখ। চোখ ধাঁধিয়ে গেল সৈকতরক্ষীর। লাল কাঁকড়াটি নখ ফুটিয়ে বসে আছে। রক্ষী হাত গুটিয়ে বসে রইল চুপচাপ। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি উর্বশীর।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫। জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬। কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!