সাগরের অথই জলে তলিয়ে গেছে অর্ণব। কী ঘটবে অর্ণবের জলজজীবনে? সমুদ্রসৈকতে অপেক্ষারত উর্বশীর জীবনে নেমে এলো কোন ঝড়? একে অপর থেকে কি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল নবদম্পতি? সাগরতলের জীবনে অর্ণব আর বাস্তব জীবনযুদ্ধে অশুভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে থাকা উর্বশীর মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ ঘটতে থাকে? হারিয়ে যাওয়ার পর কীভাবে অর্ণব বার বার ফিরে আসে উর্বশীর ঘটমান চলার পথে? বাস্তব আর পরাবাস্তবের আলোয় কীভাবে জ্বলে ওঠে ম্যাজিক রিয়ালিজম? সচেতন ও অবচেতন মনের এক সমগ্রতা বা অভিন্নতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সুররিয়ালিজমের কোন পথ মাড়িয়ে এগোবে এই উপন্যাসের কাহিনি? জানতে হলে পড়তে হবে উপন্যাসটি।
পর্ব – এক: মেঘপাহাড় ফুটে আছে সাদা গোলাপের মতো
প্রখর রোদে পুড়ে যাচ্ছিল শরীর। মুখের রোদ ঢাকার জন্য বাঁ হাত কপালে রেখে সামনে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল অর্ণব। ঝাঁঝাঁল গরমে জ্বলতে থাকা চোখের জ্বলুনি তবুও কমল না। হাতের ছায়া ভেদ করে গরম বাতাসে ভর করে উড়ে এসে রোদ ঝাপটা দিচ্ছে চোখে। বেলে মাটির গভীরে ডুবে যাচ্ছিল নগ্ন পা। ডুবে যাওয়া পা রেহাই পাচ্ছে না উষ্ণতার আঁচড় থেকে। পায়ের স্যান্ডেল ও রেখে এসেছে বালুতটে। ইচ্ছা করলেও পা বাঁচানো যাচ্ছে না বালুর উত্তাপ থেকে। আর পায়ের আগুনেও পুড়ছে বালি। বাইরে চুয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেলে মাটির তল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে অদ্ভুত ঝিঁঝি আওয়াজ। তাপ বিকিরণও আওয়াজ তোলে, সেই আওয়াজ কাঁপিয়ে দিতে পারে বালির স্তূপ, প্রতিধ্বনিত হতে পারে বাতাসের তাপ ভেদ করে, টের পেয়ে অর্ণব কিছুটা সময় কান পেতে রইল। আর তখনই শুনল উর্বশীর ডাক- ‘কোথায় যাবে?’
গন্তব্যের নিশানা সাগরসৈকত, সামনে-পেছনে রোদ আর রোদ, ঝাঁঝাঁ রোদেরও একটা শক্তি আছে; সেই শক্তি আঁকাবাঁকা করে দিতে পারে সরল রেখার টানা পথ, চোখে ঢেলে দিতে পারে বিভ্রম আর থইথই অন্ধকার। প্রবল রোদে কড়া আঁধার আচমকা আক্রমণ করল অর্ণবের পেছনে হাঁটতে থাকা উর্বশীর চোখ। ও চিৎকার করে অর্ণবের উদ্দেশে বলল, ‘থামো, থামো। আর না এগোনোই ভালো। পা পুড়ে যাচ্ছে। ফোসকা বেরুচ্ছে। এই বুদ্ধি নিয়ে বেড়াতে বের হও তুমি!’
অর্ণব বলল, ‘শোনো, রোদকে ভয় পেয়ো না। রোদের সখ্য মেনে নাও।’
‘তোমার খুশি, তুমি মানো। আমি আর পারছি না। ফিরে যাচ্ছি।’ বলেই উল্টোমুখী হয়ে হন হন করে পা বাড়াতে গিয়েও এগোতে পারল না উর্বশী।
হো হো করে হেসে উঠল অর্ণব। উল্লাসের সঙ্গে বলল, ‘ভেবো না রোদের সখ্য মেনে নিয়েছি। রোদ আমাদের পোড়ানোর আগেই রোদকে পোড়াব আমরা, এগোও সামনে; পেছনে নয়। সামনে এগোনোর নামই জীবন।’
‘ভুল তরবারি দিয়ে কোপাতে চাও তুমি রোদের শরীর। সামনের শত্রু পরাক্রমশালী হলে, কৌশলে মোকাবিলা করতে হয় তাকে। এগোনো মানে, এ মুহূর্তে রোদশত্রুর সীমানায় নিজেকে ঠেলে দেওয়া, নির্ঘাত পরাজয়কে বুকে টেনে নেওয়া। কাঁটাতারের নিষেধ না মেনে, বালুতটে পোঁতা খুঁটিতে উড্ডীন লাল পতাকার সাঙ্কেতিক নিষেধ বার্তা অস্বীকার করে এগোনোর নাম জীবন নয়।’
উর্বশীর কথার ভেতর থেকে প্রতিটি শব্দ-বর্ণ আগুনশক্তি নিয়ে বেরিয়ে রোদের ঝাঁঝাঁ শব্দ-তরঙ্গকে বিদ্ধ করল।
রোদের নীরব শব্দগুচ্ছ এখন আর শুনতে পাচ্ছে না অর্ণব। কিছুটা স্থিত হয়ে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে, তাকাল উপরের দিকে―আকাশে ভাসমান সাদা মেঘপাহাড় এখন উড়ছে না, বসে আছে ঘাপটি মেরে। মেঘপাহাড়ের পাদদেশ বরাবর ফুটে আছে আকাশের নীল স্তর আর মেঘের মূল পাহাড়ের সাদা বুক ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে আগুন, সূর্যের কড়া রোদ। মেঘপাহাড় সেই রোদ শুষে ধুয়ে দিচ্ছে রোদের তেজ, তীব্রতা। আর সাদা ফেনায় সাদা গোলাপের উজ্জ্বল পাপড়ি মেলে ধরেছে আকাশে।
‘শোনো, উর্বশী! আমরণ লড়াই শিখেছি। বশ্যতা শিখিনি। আকাশের দিকে তাকাও, দেখো সাদা মেঘপাহাড় কীভাবে প্রবল রোদের প্লাবনকে বশ করে সাদা গোলাপের মতো ফুটে আছে, দেখো!’
ওপরের দিকে তাকানোর শক্তি নেই, তবু উর্বশী তাকাল ওপরে। কোঁচকানো চোখ আচমকা খুলে গেল সাদা মেঘের ভেতর রোদফুলের খোলা পাপড়ির ঝাঁক দেখে।
সোল্লাশে কবিতার ছন্দে উর্বশী বলতে লাগল, ‘বাহ্! বাহ্! রোদ খেয়ে সাদামেঘ ফুটে আছে ফুল হয়ে। কী বিস্ময়! কি বিস্ময়!’
মায়াবী বাঁশির ডাক শুনতে পেল অর্ণব। পেছনে নয়, এগোনোর সাহস নিয়ে, আরও জোশে পা বাড়াতে লাগল সামনে। পা পোড়ার জ্বালা মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। উর্বশীও এগোতে লাগল অর্ণবকে অনুসরণ করে। সামনে বিস্তৃত সাগর, সাগরের ঢেউ আর ফেনিল শুভ্রতার উল্লাসধ্বনি- ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের ফেনিল উচ্ছ্বাস।
প্রবল টানে এগোতে লাগল অর্ণব।
‘এই! আর যেও না। নেমো না সমুদ্রে, হাঁটু পানির বেশি যেও না।’ চিৎকার করে ডাকল উর্বশী।
অর্ণব শুনল না। এগোতে লাগল সামনে। ভেঙে পড়া ঢেউয়ের আঘাত বুক পেতে নিয়ে, দু হাতের প্রসারিত ঝাপটায় পাল্টা আঘাত হানল উত্তাল ঢেউয়ের শরীরে। প্রতিঘাত নয়, ঢেউয়ের আছড়ে পড়া উল্লাসকে বরণ করে নিল সে পুষ্পবর্ষণ হিসেবে।
‘এই! আর এগিয়ো না। দেখো লাল পতাকা উড়ছে।’ ভাটার সময় সমুদ্রে নামার নিষেধবাণী ওড়াচ্ছে উড্ডীন পতাকা। ভেজা বালুতটে দাঁড়িয়ে পানিতে না নেমে, চিৎকার জুড়ে দিল উর্বশী।
অর্ণব হয়তো শুনতে পেয়েছে, হয়তো পায়নি, বিশাল ঢেউয়ের গর্জনের তলে চাপা পড়ে গেছে উর্বশীর নিষেধবাণী। পাহাড় সমান অজগর ঢেউ প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অর্ণবের দেহের ওপর। কিছুক্ষণ পরই শুভ্র ফেনিল উচ্ছ্বাসের টানা স্রোত নিস্তরঙ্গ পুকুরের কোমল ধারার মতো ছুঁয়ে গেল পাড়ে দাঁড়ানো উর্বশীর নগ্ন পা।
আরে, এ কি! শুভ্র জলধারা তো পা ছুঁয়ে যাচ্ছে! ক্ষমা চাচ্ছে পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে! চট করে ভেসে ওঠা ভাবনার ছোবল খেয়ে উর্বশী তাকাল সামনে- পাহাড়সমান উত্তাল ঢেউটা মিলিয়ে গেছে। সাগরের প্রবল টানে আবার দূর থেকে আরও অগণিত ঢেউ ছন্দ তুলে এগিয়ে আসছে পাড়ের দিকে। যত দূরে চোখ যায় কেবল পানি আর পানি, বিস্তৃত জলরাশি সীমাহীন নয়, আকাশ ছুঁয়ে তৈরি করে রেখেছে সীমান্তরেখা। ওই রেখার দিকে তাকিয়ে উর্বশীর মনে হলো, সাগর অনেক বড়। বিশাল। কথাটা সত্য। একই সঙ্গে মনে উদিত হলো, মন তার চেয়েও বড়, সীমাহীন। সীমান্তহীন মনকে দৃষ্টিসীমায় টেনে ধরে রেখে ও জলধারার মধ্যে খুঁজতে লাগল অর্ণবকে। নেই। দেখা যাচ্ছে না ওকে। এতক্ষণ কি ডুব দিয়ে নোনাজলে ডুবসাঁতার দিতে পারে কেউ? মাথা তুলছে না কেন ও? একবার ডাক দিল সজোরে … অ… র… ণ…ব…
শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো না। লোনাজলের বিস্তৃত তরঙ্গ-স্রোতের টানে বর্ণগুলো হারিয়ে গেল বিপুল সমুদ্রে।
চলবে…