রাস্তায় কোনও গর্ত চোখে পড়লেই হল, ছোট গর্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে মুঠো মুঠো স্টোনচিপ বের করে সেটা বুজিয়ে দেন। আর বড় গর্ত হলে আশপাশ থেকে ইটের টুকরো কুড়িয়ে এনে সেই গর্ত ভরাট করেন।
শুধু তাই-ই নয়, গর্ত সমান করার জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে সব সময় রাখেন একটা দূরমুশ। কারণ তিনি দেখেছেন, শুধু স্টোনচিপ বা ইটের টুকরো দিয়ে গর্ত বুজিয়ে দিলেই হয় না, গাড়ির চাকা বার কতক ওর উপরে পড়লেই আবার যে কে সেই হয়ে যায়। তাই গর্ত বোজানোর পরে তিনি সেটা দূরমুশ করে দেন। তিনি এটা করেন, যাতে আর কারও সাইকেল কিংবা স্কুটারের চাকা ওই গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা না ঘটে।
না, একদিন দু’-দিন নয়। একটানা পাঁচ বছর ধরে এই কাজ করে আসছেন মুম্বইয়ের আন্ধেরির (পূর্ব) বিজয়নগরের মধ্যবয়সী এক সবজি বিক্রেতা। নাম দাদারাও বিলহোর। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের ব্যবসার ক্ষতি হয় প্রতিনিয়ত। তবু তিনি তাঁর কাজে অনড়।
যে কাজ পুরসভা বা পূর্ত দফতরের কর্মীদের করার কথা, সে কাজ তিনি নিজে যেচে করেন কেন? প্রশ্ন করতেই কেঁদে ফেললেন ৪৬ বছর বয়সী এই সবজি বিক্রেতা। আসলে ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই ভানদুপের এক পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হওয়ার পর খুড়তুতো এক ভাইয়ের সঙ্গে মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিল তাঁর ১৬ বছরের ছেলে প্রকাশ।
তখন জোগেশ্বরী-ভিখরোলি সংযোগস্থলে চলছিল পৌরসংস্থার সড়ক মেরামতির কাজ। রাস্তা খোঁড়া হলেও পুরো জায়গাটা ভরাট করা হয়নি। এখানে সেখানে খানাখন্দ ছিল। প্রবল বৃষ্টির পর সেই সব গর্ত ছিল জলে ভর্তি।
পৌরসংস্থার পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দিয়ে সেখানে লাগানো ছিল না কোনও বোর্ডও। তেমনই একটি গর্তে পড়ে উল্টে যায় প্রকাশদের মোটরবাইক। প্রকাশ এবং তার খুড়তুতো ভাই কয়েক ফুট দূরে ছিটকে পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় প্রকাশের। খুড়তুতো ভাই রাম গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায়।
ছেলের মৃত্যুর সুবিচার পেতে আইনি লড়াইও চালাচ্ছেন বিজয়নগরের এই বাসিন্দা। তিনি জানান, পুরসভার বরাত পাওয়া যে বেসরকারি সংস্থা রাস্তা খুঁড়েছিল, সেই সংস্থার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪এ (অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু) এবং ৩৩৮ (প্রাণঘাতি আঘাত করা) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এর ফলে রাস্তা মেরামতির কাজে যুক্ত থাকা মুম্বই পৌরসংস্থার এক কর্মকর্তা এবং এক ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। যৎসামান্য সামর্থ্য নিয়ে আইনি লড়াই লড়লেও, এর পাশাপাশি, আর কারও সন্তান যাতে রাস্তার গর্তের জন্য দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এই ভাবে মা-বাবার কোল খালি করে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে না যায়, সে জন্য ছেলের পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দিন থেকেই তিনি এই ভাবে রাস্তা সারিয়ে চলেছেন।
প্রথম প্রথম এলাকার লোকেরা ছিলেন নিছকই কৌতূহলী। ভেবেছিলেন, দু’-চার দিন পরেই তিনি হাল ছেড়ে দেবেন। কিন্তু যখন দেখলেন ব্যাপারটা তা নয়, তখন দাদারাও যেখানেই রাস্তা সারাতে থাকেন, এগিয়ে যান স্থানীয় বাসিন্দারাও। সাধ্য মতো সাহায্য করেন তাঁকে।
দাদারাও রাস্তা সারান আর কাঁদেন। বলেন, আমার একটা মেয়ে রয়েছে। বাড়িতে আমি কান্নাকাটি করলে ও আরও ভেঙে পড়বে, তাই… তাঁর নিকটজনেরা আশা করেন, এ ভাবেই রাস্তার খানাখন্দ ভরাট করতে করতে দাদারাও হয়তো একদিন নিজের বুকের ক্ষতটাও, পুরোপুরি না হলেও অন্তত খানিকটা সারিয়ে তুলতে পারবেন!