সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর চেতনা ও কবিতা বিশ্লেষণ
“বন্ধু তোমার বুক ভরা লোভ,
দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি, নতুবা দেখিতে,
তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।” (মানুষ)
বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদের প্রবক্তা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত ও পথিকৃৎ কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে যে সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তা অভূতপূর্ব অবিস্মরনীয়। তার তীব্র সাম্যবাদী চেতনা ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকলের মাঝে ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাসজ্জাত জাতীয় সংহতি এবং একতার সঞ্চার করেছিল। আজ এই একুশ শতকেও নজরুল আমাদের কাছে সর্বতোভাবে প্রাসঙ্গিক।
জীবনানন্দ বলেছেন – “নজরুল উনবিংশ শতকের ইতিহাসে প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।” তাঁর সংশয়হীনতা, জাগ্রত মানুষের প্রতি প্রবল আস্থা এবং ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের মজবুত ভিত বাঙালি সমাজ ও সভ্যতায় সমূহ নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চারণ। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে, প্রহরে। “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান” – আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নজরুলের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী। নজরুলের সাম্যবাদ তাঁর অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। তিনি সব ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবধর্মকে উচ্চাসনে বসিয়েছেন।১৯৫২ সালে নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি বলেছেন “মানুষ” কবিতায়-
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড, গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি।
মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
কৈশোরেই নজরুলের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ভিত গড়ে ওঠে যা পরবর্তীকালে তাঁকে সাম্যবাদী হতে সাহায্য করেছে। রানীগঞ্জে নজরুলের শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ নামে একজন প্রিয় বন্ধু ছিল।নজরুল ইসলাম মুসলমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় হিন্দু ব্রাহ্মণ আর শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ খ্রিস্টান। তিন বন্ধু একসঙ্গে খেলাধুলা করতেন, একসঙ্গে বেড়াতেন। এই যে তিন ধর্মের তিন বন্ধুর একত্রে মেলামেশার কারণে নজরুলের ভেতর সেই কৈশোর থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটেছে, তাঁকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত করেছে।
দারিদ্র্যের কারণে তিনি ব্রিটিশ পরিচালিত ঊনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে করাচি সেনানিবাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সৈনিক জীবনই তার চেতনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেখানে বসে তিনি কাজের অবসরে কাব্য চর্চা শুরু করেন। রুশ বিপ্লবের সময় সারা দুনিয়ায় যখন সর্বহারার জয়গান উচ্চারিত হচ্ছে ঠিক তখনই কবি নজরুলকে তা নাড়া দিয়ে যায়। এই সময়েই নজরুল লিখে ফেলেন-
“সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।” (প্রলয়োল্লাস)
এই কবিতা দিয়েই নজরুল তাঁর সাম্যবাদী আদর্শের জানান দেন বলেই ধরে নেয়া যায়। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা “মুক্তি”। কবিতাটি তাঁর সাম্যবাদী চেতনার স্ফূরণ ঘটিয়েছে। নজরুল তাঁর “মুক্তি” কবিতাটি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দপ্তরে পাঠান। সেই সুবাদে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সংগঠক মুজাফফর আহমেদ এর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও পরিচয় হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মুজাফফর আহমেদ এর পরামর্শে নজরুল সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। নজরুল কমরেড মোজাফফর আহমদের সহচার্যে এসে আরো বেশি সাম্যবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন থেকেই সাম্যবাদীর চিন্তার প্রকাশ পুরোদমে ঘটে নজরুলের লেখায়। নজরুল কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত “ধুমকেতু”, “লাঙল”, “নবযুগ”, গণবাণী প্রভৃতি পত্রপত্রিকা হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তার মুখপত্র।১৯২২ সালের ১২ ই আগস্ট নজরুলের একক চেষ্টায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক “ধূমকেতু”। “ধূমকেতু” রাজনৈতিক কাগজ হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে।
১৯২৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর মুজাফফর আহমেদ লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক “লাঙল” পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাজী নজরুল ইসলামকে লাঙলে’র প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। “লাঙল” এর প্রথম সংখ্যাটিতে নজরুল “সাম্যের গান” নামে কবিতা লিখলেন-
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান।”
নজরুল তাঁর কাব্য জীবনের প্রারম্ভ থেকে হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন যখন কতকটা স্তিমিত তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাতাস তীব্র হয়ে উঠল, নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতার শাশ্বত বারতা- “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” (কান্ডারী হুশিয়ার)
নজরুলের অনেক কবিতায় সাম্যবাদের উচ্চকিত উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কবিতা গুলি হল- সাম্যবাদী, প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, কান্ডারী হুশিয়ার, সর্বহারা, কুলি-মজুর, সাম্যের গান, মানুষ, আনন্দময়ীর আগমনে, কামাল পাশা ইত্যাদি।
তিনি মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ খুঁজে পাননি। তার কাছে কোনো জাতপাতের বিভেদ ছিল না। সকল মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়ে তিনি দেখতে চেয়েছেন। তিনি কবিতায় বলেছেন-
“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুনো এক মিলনের বাঁশি।”
নজরুলই প্রথম কবিতায় ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন সকল অন্যায়, শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে তিনি তাঁর “প্রলয়োল্লাস” কবিতায় উচ্চকিত উচ্চারণ করলেন-
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।”
মার্কসীয় সাম্যবাদী ধারার গভীর প্রভাব বিস্তার ঘটেছে নজরুলের সাম্যবাদী ও সর্বহারা কাব্যে। সাম্যবাদী আন্দোলনের ধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই এবং নিজেকে তার সমসাময়িক প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যকলাপ এর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিলেন বলেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। “চোর-ডাকাত” কবিতায় বলেছেন-
“বিচারক ! তব ধর্মদন্ড ধর
ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।”
বিশ্বের মানবশ্রেণীকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানালেন নজরুল।নির্যাতিত মানুষের, শোষিত মানুষের জাগরণকে জয়ধ্বনী দিয়ে নজরুল লিখেছিলেন-
“শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান/ জয় নিপীড়িত জনগন, জয় জয় নব উত্থান।”
বর্তমান যুগে এই হানাহানির বিশ্বে, এই জাতি ধর্ম বিভেদ বহুল বিশ্বে দাঁড়িয়ে আজ নজরুলের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করে আবার বলি-
“তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের, দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কঙ্কালে? হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।” (সাম্যবাদী)