ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লইসক্যা বিলে যাত্রী ও বালুবাহী দুই ট্রলারের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যার এই দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী ট্রলারটি ডুবে যাওয়ায় বহু হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাত দেড়টা পর্যন্ত ২১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জন যাত্রী নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তাত্ক্ষণিকভাবে নিহত ১৮ জনের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। তারা হলো সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের চিলোকূট গ্রামের আব্দুল্লাহর কন্যা তাকুয়া (৮), সাদেকপুর গ্রামের মুরাদ মিয়ার ছেলে তানবীর (৮), গাছতলা গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭), নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমীন (১৮), ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার দক্ষিণ পৈরতলার আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), উত্তর পৈরতলার ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলা বেগম, দাতিয়ারার হাজি মোবাশ্বের মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মিম (১২), বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের কামাল মিয়ার মেয়ে মাহিদা আক্তার (৫), ফতেহপুর গ্রামের জহিরুল হক ভূইয়ার ছেলে আরিফ বিল্লাহ ওরফে মামুন ভূইয়া (২০), গোরারগাঁও গ্রামের মালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), আবদুল হাসেমের স্ত্রী কমলা বেগম ওরফে রওশন আরা, জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০) ও তাঁর কন্যা মুন্নী বেগম (৬), নূরপুর গ্রামের আবদুর রাজ্জাক ওরফে মন মিয়ার স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জনা বিশ্বাস (৩০) ও তাঁর আড়াই বছরের কন্যা ত্রিদিবা বিশ্বাস, পত্তন ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫৮) এবং ময়মনসিংহ জেলার খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম (৫৫)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর থেকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অন্তত ৭০ জন যাত্রী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের উদ্দেশে ছেড়ে আসে একটি ট্রলার। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে সেটি লইসক্যা বিলে পৌঁছার পর বিপরীত দিক থেকে বালুবোঝাই একটি ট্রলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়। যাত্রীদের কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে। বালুবাহী ট্রলারটি দুর্ঘটনাস্থলের কয়েক কিলোমিটার দূরে আটক করেছে স্থানীয়রা।
দুর্ঘটনাটি ঘটে বিলের মাঝামাঝি স্থানে। আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে তেমন কোনো বাড়িঘরও নেই। ফলে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। দুর্ঘটনার পর প্রথমেই স্থানীয় লোকজন একাধিক নৌকাযোগে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। খবর পেয়ে বিজয়নগর থানা পুলিশ ট্রলারযোগে ঘটনাস্থলে আসে, কিন্তু বিলের ওই স্থানে ঘন অন্ধকারের কারণে উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটে।
রাত সাড়ে ৭টার দিকে জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান ও পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান স্পিডবোটে দুর্ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রুহুল আমিনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। নিহতদের দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি উদ্ধারকারী দল এসে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। তারা জেনারেটরের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করার পর উদ্ধারকাজে গতি আসে। তবে ওই সময় পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের দলে কোনো ডুবুরি ছিলেন না। আর দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারটি তখন পর্যন্ত বিলের পানির নিচে রয়েছে।
তাত্ক্ষণিকভাবে নিখোঁজ যাত্রীর সঠিক পরিসংখ্যানও জানা যায়নি। তবে সাঁতরে তীরে উঠে আসা এবং উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমপক্ষে ৫০ জন যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে।
জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাত্রী ফারুক মিয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পথে বালুবাহী নৌকার ধাক্কায় তাঁদের ট্রলারটি ডুবে যায়। তিনি আহত অবস্থায় তীরে উঠে আসতে পারলেও স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজ পাচ্ছেন না।
মুরাদ মিয়া নামের আরেক যাত্রী জানান, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে তাঁরা দুর্ঘটনায় পড়েন। তিনিসহ আরো বেশ কয়েকজন কোনো রকমে সাঁতরে তীরে উঠে আসেন। অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে।
আঁখি আখতার নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমাদের বহনকারী ট্রলারটি অন্তত ৭০ জন যাত্রী নিয়ে বিজয়নগরের চম্পকনগর থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় ছেড়ে আসে। নৌকায় করে আমি, আমার ছেলে, ভাশুরের ছেলে ও শাশুড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসছিলাম। পথে একটি বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে আমাদের ট্রলারটি ডুবে যায়। আমি সাঁতরে কূলে উঠতে পারলেও আমার ছেলে, ভাশুরের ছেলে ও শাশুড়ির এখনো সন্ধান পাইনি।’