বরিশালে রঙ বেরঙের নান্দনিক পাঞ্জাবী বা ফতুয়া পরা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলা মানুষটিকে পিছন থেকে দেখলে যে কেউ বলবে মুকুল’দা যাচ্ছেন। মা-বাবার আদুরে নাম দুলু। মুকুল দাস জন্মগ্রহন করেন ১৯৪৯ সালে ১০ জানুয়ারী নগরীর দপ্তরখানা এলাকায়। স্বর্গীয় বাবা মনীন্দ্রনাথ দাস ও স্বর্গীয়া মাতা সরযূ দাস এর ৬ সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। অন্যান্যরা হলেন প্রশান্ত দাস, অনুপ দাস, উত্তম দাস, অমিতাভ দাস ও মেয়ে স্বপ্না দাস।
শিক্ষা জীবন শুরু হয় প্রভাতী প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমানে উদয়ন স্কুল) এর মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিকে ভর্তি হন ব্রাদার ডুবো এর পরিচালনায় ‘জুনিয়র ক্যামব্রিজ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে’ (বি এম স্কুলের মধ্যে), পরবর্তীতে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায় এবং নিয়মিত ছাত্র হন বিএম স্কুলে।
তবে কৈশোর জীবনের একটি স্মৃতি আজও মনে গেঁথে আছে দুলু দা’র। সেই স্মরনীয় ঘটনার বর্ননায় তিনি বলেন, তখন আমার বয়স দশ কি বারো। দপ্তরখানা ছিল আমাদের চার পুরুষের বাস। আমরা ছিলাম ওখানের টিম্বার মার্চেন্ট। এদিকে বাজার রোডে ছিল এক গুজরাটি পরিবার। পরিবারটি নিরামিষভোজী। পরিবারের কর্তা নাগিন ভাই প্যাটেল তামাক ব্যবসায়ী। গদিঘর ছিল বড় কালীবাড়ি সংলগ্ন। তার মেয়ের নাম ছিল রিতি প্যাটেল। খুবই সুন্দরী। আমার সমবয়সী। আমি যেহেতু সুন্দরের পূজারী ছিলাম সেহেতু আমাদের মধ্যে কৈশোরীক প্রেমের সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। মেয়েটি মাঝেমধ্যেই আমার টানে আমাদের বাসায় আসতো এবং মাছ-ভাত খেয়ে যেত লুকিয়ে। যেহেতু সবাই জানে ওরা নিরামিষভোজী। পহেলা বৈশাখ আমাদের গদিঘরে শুভ হালখাতা অনুষ্ঠিত হত। আমন্ত্রন থাকতো ওদের পরিবারের সবার। অপরদিকে ওদের হালখাতা অনুষ্ঠিত হত দীপাবলীতে (দেওয়ালী)। সেখানে আবার আমরা যেতাম। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমাকে বিরহের মধ্যে রেখে রিতিরা চলে যায় সুরাট। তবে গুজরাটি ভাষায় আমার নাম লিখতে শিখিয়েছিল রিতি।
১৯৬৫ সালে বি এম স্কুল থেকে এস এস সি, এইচ এস সি ১৯৬৭ সালে, বানিজ্য বিভাগ এবং ১৯৭০ সালে সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এম কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন মুকুল দাস।
বহু গুনে গুনান্বিত মুকুল দাসের খ্যাতি রয়েছে মঞ্চ অভিনেতা হিসাবে। ছোট বেলায় বাড়ির উঠোনে পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে মা সরযূ দাস এর পরিচালনায় রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘বিনি পয়সার ভোজ’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ের শুরু। ষাটের দশকে ‘বরিশাল যুব সংঘ’ ব্যানারে নূরমহল (অভিরুচি ) সিনেমা হল মঞ্চে অভিনয় করেন বাসর থেকে আসরে এবং শাহজাহান সহ বিভিন্ন নাটকে। ১৯৭৭ সালে বৃটিশ কাউন্সিল মঞ্চে ঢাকার আরন্যক নাট্য দলের ব্যানারে ‘ ওরা কদম আলী’ নাটকে অভিনয় করেন নোয়াখাইল্যা সারেং চরিত্রে। আশির দশকে বরিশালে ‘বরিশাল নাটক’ এর ব্যানারে অভিনয় করেছেন নিখিল সেন এর নির্দেশনায় ‘অথঃস্বর্গ বিচিত্রা’ ‘সাজানো বাগান’ ‘পিতামহদের উদ্দেশ্যে’ ‘নরক গুলজার’ এবং মানবেন্দ্র বটব্যাল এর নির্দেশনায় ‘হারানের নাতজামাই’ নাটকে। বরিশালে আধুনিক নাটকের প্রবক্তা বা আধুনিক নাটক মঞ্চায়নের পথিকৃৎ, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বন্ধু আকবর হোসেন এর নির্দেশনায় গনশিল্পী সংস্থার ব্যানারে অশ্বিনী কুমার হল মঞ্চে ইন্দু সাহা রচিত ‘একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ’ নাটকেও অভিনয় করেছেন এই শক্তিমান অভিনেতা।
কখনো রোমান্টিক ভঙ্গিতে আধুনিক গান কখনো বা বিদ্রোহী রূপে গনসঙ্গীত পরিবেশনে সুখ্যাতি রয়েছে মুকুলদা’র। প্রতিভা সম্পন্ন ও ভজন গানের শিল্পী মা সরযূ দাস এর কাছে আদরের দুলাল দুলু’র গানে হাতেখড়ি। মাত্র ৯ বছর বয়সে দপ্তরখানা কালীপূজা মঞ্চে পরিবেশন করেন পান্না লাল ভট্টাচার্য্যরে শ্যামা সঙ্গীত ‘ মা আমার স্বাদ না মিটিল, আশা না পুরিল।’ সেই সময়ের স্মৃতি স্মরনে মুকুল দা বলেন, তখন একমাসব্যাপী পাড়ায় পাড়ায় সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠান ছিল। ভাল গান গাওয়ার সুবাদে সবাই আমাকে নিয়ে টানাটানি করতো। আমিও আনন্দের সহিত গিয়ে গান গাইতাম। কালীপূজার সময় ছোটখাট অনুষ্ঠান হত। কোলকাতা থেকে দুর্গাপূজায় গান বের হত। সেই গানের রেকর্ড সংগ্রহ করে গান তুলতে তুলতে সরস্বতী পূজা চলে আসতো। সেই দুর্গাপূজার গান পরিবেশন করতাম সরস্বতী পূজায়।
তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মুকুল দাস বলেন, সবার সঙ্গে সবার সৌহাদ্যপূর্ন সম্পর্ক ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। সবাই সবার বাড়িতে যেতে আসতো। দুর্গাপূজার দশমীতে এবং লক্ষী পূজায় মুসলমান বন্ধুরা হিন্দুদের বাড়িতে যেত নাড়– খেতে। আবার আমরাও যেতাম তাদের বাড়িতে ঈদুল ফিতরের নিমন্ত্রন খেতে। বিপদ আপদে পাশে দাঁড়াতো পরস্পর জাতি ধর্ম নির্বিশেষে।
৬৯এ শুরু হয় গনঅভুত্থান। তখন ‘বিক্ষুব্দ শিল্পী সমাজ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এর দলনেতা ছিলেন আবুয়াল সাঈদ নান্টু। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন সাহা, আক্কাস হোসেন, মনি দাস, মুকুল দাস, বাসুদেব সেনগুপ্ত, সেলিম বিন আজম, উৎপল দাস, খুকু দাস, উমা সেন, ললিত দাস ও বরুন সেন। এই শিল্পীরা মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে গনসঙ্গীত পরিবেশন করতেন পাড়ায় পাড়ায় ট্রাকে করে। ৭১এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বরিশালে পাকবাহিনী দখল নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই শিল্পীরাই একাত্তরের চেতনাকে শানিত এবং মানুষদের সংগঠিত করতে গনসঙ্গীত পরিবেশন করেছে পাড়ায় পাড়ায়। মিশুক এই মানুষটি আরো জানান, ৮০’র দশকে যুক্ত হই উদীচী, বরিশাল এর সঙ্গে। উদীচী গনসঙ্গীতের লিড করতেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রন পেতাম।
বর্নাঢ্য জীবনের অধিকারী মুকুল দাসের সাংবাদিক অঙ্গনেও রয়েছে বেশ পরিচিতি। তিনি জানান, ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকার মাধ্যমে তার হাতেখড়ি। এরপর সাপ্তাহিক গনডাক। কাজ করেছেন দৈনিক বাংলার বানী পত্রিকার সিনে সাপ্তাহিক সিনেমা পাতার বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে। ছিলেন সাপ্তাহিক লোকবানী পত্রিকার ফিচার সম্পাদক। সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক বাংলার বনে পত্রিকায়। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকায় যাবার পর লেখালেখি করেছেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার শিল্প ও সংস্কৃতি পাতায়। তখন চীন প্রত্যাগত ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস এর সাক্ষাৎকার পত্রস্থ হয় সংবাদ পত্রিকায়। লেখাটি তখন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানান দুলুদা ।
তিনি আরো জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন বরিশাল থেকে একমাত্র পত্রিকা এবং একমাত্র সংখ্যা “ বাংলাদেশ” প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন এস এম ইকবাল, মিন্টু বসু ও হেলালউদ্দিন। প্রকাশক ছিলেন এনায়েত হোসাইন মিলন, মুকুল দাস ও হারেস আহমেদ খান। দ্বিতীয় সংখ্যার সবকিছু রেডি। ছাপানোর জন্য সদর রোড হাবিব প্রেসে ছিলাম। ছাপা শুরু হবে, এমন সময় পাকিস্থানী আর্মীরা সেলিং শুরু করে। এমতাবস্থায় আমরা ওখান থেকে পালিয়ে যে যার বাসায় যাই। ঐ পত্রিকাটির আর কোন সংখ্যা বের হয়নি।
ফিচার লেখক হিসেবে মুকুল দাস কাজ করেছেন বরিশাল থেকে প্রকাশিত সৈয়দ দুলাল সম্পাদিত ‘দৈনিক আজকের পরিবর্তন’ পত্রিকায়। বরিশালে সর্বজন বিদিত, মুকুল দাস তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী। প্রখ্যাত কোন মানুষ মারা গেলে, তার উপর আধ বা এক ঘন্টার মধ্যে একটি লেখা নিয়ে তিনি হাজির হতেন পত্রিকা অফিসে। এজন্য বার্তা সম্পাদক স্বপন খন্দকার তাকে আখ্যায়িত করেন “অন্তিম প্রতিবেদক” হিসেবে।
একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মুকুল দাস জনপ্রিয় তার শিক্ষার্থীদের কাছে। তার অনেক ছাত্রছাত্রী এখন রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮০ সালে বরিশাল আসার পর মহাবাজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসাবে যোগদানের মধ্যদিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তবে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যান্য সকল কর্মকান্ড সিদ্ধ হস্তে চালিয়ে যান জ্ঞান পিপাসু এই ব্যক্তি। সেকাল- একাল প্রসঙ্গে মুকুল দাস বলেন, আমাদের সময় গুরুজনদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে সেরকম দেখিনা। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে।
১৯৮৮ সালে পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলা নিবাসী তাপসী সমদ্দারকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করেন মুকুল দাস। ১৯৯৭ সালে মুকুল-তাপসী দম্পতির একটি পুত্র সন্তান জন্ম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আঁতুড় ঘড়েই জীবনাবসান হয় সেই সন্তানের। ৩৩ বছর সংসার জীবনে আর কোন সন্তান হয়নি তাদের। তবে এব্যাপারে কোন আক্ষেপ বা দুঃখবোধ নেই, বললেন মুকুল দাস। এ বিষয়ে শিক্ষক নেতা আব্দুর গফুর স্যারের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমার তেমন কোন স্বপ্ন ছিলনা। না চাইতেই আমি অনেক কিছু পেয়েছি। তবে নিঃসন্তান হলেও আমরা সুখী।
ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে মুকুল দাসের অবদান। ভাল ক্রিকেট খেলতেন। কিপার ছিলেন এবং ব্যাট করতেন ওয়ান ডাউনে। একবার বল নাকে লেগে ফেটে যায়। সেই দাগ নাকে বহন করে চলেছে আজও। তার প্রিয় ক্রিকেটার ভারতের পতৌদি নবাব মনসুর আলী খান। ভাল কেরাম খেলতেন। খেলেছেন ব্যাগাডেলী। বি.এম কলেজ অডিটরিয়ামে খেলতেন টেবিল টেনিস। তবে জীবনে একদিন ফুটবল খেলেছেন। বিপরীত দলের এক খেলোয়াড় ল্যাং মারলে তার ডান পা ভেঙ্গে যায়। তারপর আর ফুটবল খেলেননি এই ক্রীড়াবীদ।
সুবক্তা হিসেবেও সুনাম রয়েছে মুকুলদা’র। মঞ্চে যেকোন বিষয়ে আলোচনা করতে বললে অথবা আড্ডায় কোন কিছু জানার ইচ্ছে থাকলে, প্রশ্ন করা মাত্র মুখ থেকে অনর্গল বেরিয়ে আসে আমাদের অজানা সেসব বিষয়বস্তু। অবাক হবার মত, রসালো কথায় তার আলোচনায় বিব্রত হন না শ্রোতা। গড়গড় করে বলতে পারেন তার শৈশবে বোঝার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেখা বা শোনা সকল কিছু। বয়সের ভারে শরীরে কিছুটা ঘূন ধরলেও স্মৃতিশক্তি প্রখর। তার সাথে কথা বললে ফিরে আসে প্রান চাঞ্চল্যতা। সুধী সমাজে শ্রুতি আছে, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মুকুল দাসের মস্তিস্ক একটি কম্পিউটার।
বরিশালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুকুলদা এই নগরীর বাইরে সুপরিচিত, যুব সমাজের মধ্যে অনেকেই তাকে ভালবেসে মুকুল কাকা বলে সম্বোধন করেন। বিষয়টি খুব আনন্দের সাথে উপভোগ করেন তিনি। কাজের সুবাদে বা বিভিন্ন সময় যেসকল গুনীজনের সান্নিধ্য লাভ করে নিজেকে ধন্য এবং সমৃদ্ধ করেছেন বলে মিশুক র্নিঅহংকারী মুকুল দাস মনে করেন, সেই স্মরনীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে- সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কমিউনিস্ট নেতা, উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেন, সাহিত্যিক সাংবাদিক রনেশ দাসগুপ্ত, বিপ্লবী দেবেন ঘোষ, রাজনীতিক মনোরমা বসু (মাসীমা) ও রাজনৈতিক সুধীর সেন, কোলকাতা আকাশবানী’র সংবাদ পাঠক দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়, গীতিকার সুরকার সলিল চৌধুরী, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক ও ছায়ানট সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন, নাট্যকার মামুনুর রশিদ, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার ও -অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার, নাট্যাভিনেতা আলী যাকের, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. নুরুল আনোয়ার, কবি আসাদ চৌধুরী, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস ও অরবিন্দ বিশ্বাস, নজরুলগীতি শিল্পী ধীরেন বসু, সাংবাদিক ও নাট্য নির্দেশক এস আলী মোহাম্মদ, সেতার বাদক সত্যভূষন সেন এবং দুই বাংলার রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হক ও লোক সঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী অন্যতম।
ধুমপান করা মুকুল দাসের শখ। ভালবেসে কেউ যদি তার হাতে এক কাপ চা ও একটি সিগারেট তুলে দেয় সে খুব খুশী। যদি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট উপহার দেন তাহলেতো তার শিশু সুলভ মুখের হাসিটি দেখে সত্যি প্রান জুড়াবে। অনেকে চেষ্টা করেও তাকে বিরত রাখতে পারেনি সিগারেট খাওয়া থেকে। এই প্রসঙ্গে ধুমপায়ী মুকুল দাস বলেন, একবার এক মাদক বিরোধী অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রন জানানো হয়। যথারীতি উপস্থিত হই। অনুষ্ঠানে মাদকের বিরুদ্ধে কত কথা! আমিও আবেগ প্রবন হয়ে যাই। মঞ্চে উঠে বলেই ফেলি “তবে তাই হোক, আজ থেকে আমি, ছেড়ে দিলাম স্মোক।” করতালি আর করতালি। মঞ্চ থেকে নেমে পিছনে যাই। একটি সিগারেট খেলাম লুকিয়ে। তারপর আট দিন আর কারো সামনে বসে সিগারেট খাইনি।
প্রিয় শিল্পী মান্না দে, প্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমার এর ভক্ত মুকুলদা’র প্রিয় খাবার ভাপা ইলিশ, কই দোপেয়াজা, চিংড়ি মালাইকারী ও সিদ্ধ আলুর সাতে ঘেত্ত বোম্বাই মরিচ।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তার সময় অতিবাহিত হয় বই পড়ে, গান শুনে আর টেলিভিশন দেখে।
চল্লিশ বছরের শিক্ষকতা ও সামাজিক জীবনে একাধিক সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন খ্যাতিমান মুকুলদা। এরমধ্যে ১৯৯৯ সালে সংবর্ধনা দেয় কীর্তনখোলা থিয়েটার। একই বছর সম্মাননা জানায় রবীন্দ্র-নজরুল-মুকুন্দ সঙ্গীত উৎসব। পিরোজপুর জেলার কাউখালী ‘উত্তরায়ন খেলাঘর আসর’ সম্মাননা জানায় ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে স্মারক সম্মান দেয় অমৃত সঙ্গীত একাডেমী। দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শিক্ষক সম্মাননা দেয় ২০০৯ সালে। ২০১৩ সালে চিত্রকর, নাট্যজন বলহরি সাহা স্মৃতি সংসদ কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ওই বছর মুকুলদা’কে সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, বরিশাল সদর উপজেলা শাখা। ২০১৪ সালে বন্ধু-সুরিদ কর্তৃক ঢাকা ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত হয় “মুকুল সন্ধ্যা ও সংবর্ধনা।” ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসন কর্তৃক কবি জীবনানন্দ স্মারক সম্মাননা প্রাপ্তি। এই বছরই মহান স্বাধীনতা দিবস স্মারক সম্মাননা প্রদান করে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পদক প্রদান করে বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। তাকে গণশিল্পী সংস্থার স্মারক সম্মাননা প্রদান করে ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে সত্যেন সেন স্মারক সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ স্মারক সম্মাননা দেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরই কন্ঠ সঙ্গীত পদক প্রাপক হন জেলা শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক। ২০২০ সালে স্মারক সম্মাননা দেয় শুকতারা খেলাঘর আসরের সুবর্ন জয়ন্তী উৎসবে এবং ওই বছরই সম্মাননা জানায় অনলাইন দৈনিক বরিশাল টাইমস।
ফ্রিল্যান্সার ফটো সাংবাদিক কিশোর কর্মকার এবং ‘সাময়িকী’ প্রতিবেদক বাপ্পী মজুমদারদের সঙ্গে আলাপকালে মুকুলদা আরও বলেন, এবছর তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে ভূগেছেন ১৫দিন। এখনও শরীরটা অনেক দুর্বল। এরপূর্বে তিনি করোনা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার নাম ‘ করোনা ত্রাস।’ করোনাকে বলি সরো না, এভাবে মানুষ মেরো না, মরতে হলে নিজেই মরো, কাউকে আর ধরো না। এরপরই তিনি করোনা আক্রান্ত হন।
তিনি আরো জানান, কয়েকদিন আগে লকডাউনের সকালে বাজার নিয়ে নতুন বাজার থেকে হেঁটে আসছিলাম। একটি মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দিলে পড়ে গিয়ে বুক এবং হাত-পায়ে ব্যাথা পাই। রক্তাক্ত জখমও হয়। দ্রুত পালিয়ে যায় সাংবাদিক স্টিকার লাগানো মাইক্রোবাসটি। এরপর ডাক্তারের কাছে যাই এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু বুকে ব্যাথায় কাত হয়ে শুতে পারিনা এবং হাঁটি খুঁড়িয়ে।
সর্বশেষ তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার জীবনের চাওয়া কি?
আমার চাওয়ার কিছু নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুস্থ শরীরে মানুষের ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, হাসিমুখে বলেন তিনি।
(১০জুলাই থেকে ১লা আগস্ট ২০২১, তিনি সাময়িকী প্রতিবেদক বাপ্পী মজুমদার ও আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক কিশোর কর্মকারের সঙ্গে আলাপচারিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও খোলা মনে নিজ জীবনের কথা বলেছেন মুকুল দাস।)