অবসর গ্রহণের মুখোমুখি হয়ে প্রদোষ চট্টোপাধ্যায় তাঁর মেয়ের বিয়ে দিলেন। দুর্দান্ত ভুরিভোজের আয়োজন করেছিলেন তিনি যদিও তাঁর পরিচিত ক্যাটারিং সার্ভিসের লোকজন কিছুটা হলেও ঠকিয়েছিল তাঁকে। মটনকারিতে বেশ গোলমাল ছিল। যাহোক বিয়ে মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন যখন তিনি জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখনই আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা, “আপনার মেয়ে-জামাই-কে তাহলে আর হেঁসেলের বাইরে রাখতে পারলেন না — তাই তো!”
প্রদোষবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “যা বলতে চাইছেন পরিস্কার করে বলুন!”
প্রায় বছর দশ আগের কথা। সেদিন প্রদোষবাবুর মেয়ে সঙ্গীতা উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার জন্য তিনি সকলকে ‘রসগোল্লা’ খাইয়ে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খোশগল্পে মেতে উঠেছিলেন। কথার ফাঁকে বলেই ফেললেন,”সঙ্গীতা তো — কলেজে ভর্তি হল! ওর বিয়ের ব্যবস্থা এবার করতে হবে তো! পাত্র খোঁজার ভারটা নিতে হবে আপনাদেরই!”
ভালোই লেগেছিল তাই বলেছিলাম, “পাত্র সম্পর্কে আপনাদের চাহিদা কিছু তো আছে নিশ্চয়ই!”
— কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, গ্রাজুয়েট, সরকারি চাকরি হলে তো সোনায়-সোহাগা! তবে আমার একটি বিশেষ চাহিদা আছে –সেটি হল পাত্রকে অবশ্যই উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ মানে মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় আর নাহলে ভট্টাচার্য হতেই হবে।”
প্রদোষবাবুর মেয়েকে কোনক্রমে সুশ্রী, শ্যামবর্ণা বলা চলে। উঠতি বয়সের দীপ্তিতেও বেশ একটু ম্লানই দেখায়। তখন থেকেই একটি ছেলের সঙ্গে রাস্তায় – অটোয় বেশ তর্ক করতে দেখা যেত। তাই বলেছিলাম, “আপনি চট্টোপাধ্যায় ঠিক আছে — তাই বলে আজকের দিনেও …” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রদোষবাবু বলে উঠলেন, “আমাদের বনেদি বংশের আভিজাত্য ঠিক কেমন, তা কি আর জানেন! আমার ভাই প্রেম করেছিল নিম্নবংশীয়া এক ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে — দেখতে সুন্দর, উচ্চশিক্ষিতা। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর আমাদের বৃদ্ধ -ঠাকুর্দা বিয়েতে মত দিয়েছিলেন কিন্তু সে-মেয়েকে বহুদিন পর্যন্ত হেঁসেলে রান্না করতে দেওয়া হয় নি। এতটাই আমাদের জাত্যাভিমান! আমাকেও সেটি মেনে চলতে হবে তো!”
দশবছর আগের সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, “প্রদোষবাবু, আপনি তো উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ অথচ মেয়ের বিয়ে দিলেন তপশিলি জাতিভুক্ত ছেলের সঙ্গে! তাই জানতে চাইছি মেয়েকে আপনার রান্নাঘরে অ্যালাও করছেন তো! ব্রাহ্মণের তেজ যে ধুলোয় লুটোপুটি খেয়ে গেল মশাই!”
শ্লেষ হজম করে আরও শ্লেষাত্মক হয়ে উঠলেন প্রদোষবাবু। বললেন, “দেখুন প্রেম যে জাত-বেজাত মানে না। এখন সে-ব্রাহ্মণও নেই, সে-ব্রহ্মতেজও নেই। তাছাড়া যুগের তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! নাতি-নাতনি যাই হোক না কেন, চাকরির এই মন্দা-বাজারে তার ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও সুরক্ষিত হবে তো! আপনাদের মতো আমি হাওয়ায় ভেসে বেড়াই না বুঝলেন!” বলতে বলতে ঘর থেকে গটমট করে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
গল্প: বোঝাপড়ার প্রেম
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শহরের ব্যাঁটরা থানা এলাকায় পীযূষ কান্তি সরকারের জন্ম ১৩৬৮ সালের ১৩ই বৈশাখ ( ২৭ এপ্রিল ১৯৬১ )। হাওড়ার কদমতলায় সাতপুরুষের ভিটে। বাবা রতন সরকার, মা বেবি সরকার-- উভয়েই প্রয়াত। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং -এ ডিপ্লোমা প্রাপ্ত সাহিত্যিক নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ঞ মিশনের আইটিআই-এর শিক্ষক। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা কবিতা,গল্প, নিবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২টি কবিতার বই -- 'জীবনের জানলায়' ও 'আলোর কলম' প্রকাশিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন