না। এই মহাশূন্যের ভবিষ্যৎ ‘পাল্টাবে কি পাল্টাবে না’ যে সময়-কণারা জানে, তাদের জন্য তিতার আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চান না। সকাল থেকে ছেলেকে সেই যে হন্যে হয়ে ইমলি খুঁজছে, অনেকক্ষণ তার কোনও হদিশ না-পেয়ে সেই খোঁজার পাশাপাশি এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাঁকেও খোঁজা শুরু করেছে সে। কী যে করছে ও, কে জানে! ওকে যদি এই ব্যাপারটা কোনও ভাবে একটু জানিয়ে দেওয়া যেত!
যখন খুব একটা প্রয়োজন নেই, এমনিই এ দিক ও দিকে যাই, তখনও পকেটের মধ্যে মোবাইল থাকে। আর আজ! আহা, সঙ্গে যদি মোবাইলটা থাকত! তা হলে অন্তত একটা ফোন করে ওকে জানিয়ে দিতে পারতাম যে, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক আছি। আর জুরানের কথাও ভাবতে হবে না। ওকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
তার পরে নিজেই নিজের আক্কেল দেখে অবাক হলেন। মোবাইল পরিষেবা যতই উন্নত হয়ে থাকুক, এখনও ক’হাত দূরের কোনও ঘুপচি ঘরে কেউ ঢুকে থাকলে তার ফোনের টাওয়ার পাওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। অন্য রাজ্যে ফোন করতে হলে ফোন নম্বরের আগে জুড়ে দিতে হয় সেই রাজ্যের কোড নম্বর, আর ভিন্দেশে ফোন করতে হলে তো কথাই নেই। যে নম্বর চাই, সেই নম্বরের আগে ওই দেশের বেশ কয়েকটি সংখ্যার বিশাল একটা কোড ডায়াল না-করলে ওই প্রান্তের ফোনে রিংই হয় না।
শুধু কি তাই? এক-একটা দেশের কোড নম্বর আবার এক-এক রকম। তাও সেটা পৃথিবী থেকে করলে। আর এটা তো পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে, একেবারে মহাশূন্যে। এখান থেকে ফোন করতে হলে ফোন নম্বরের আগে কত সংখ্যার কোড বসাতে হবে, তিনি তো জানেনই না। এমনকী, সেটা সংখ্যা, না অন্য কোনও কিছু, তাও তাঁর ধারণা নেই। তার থেকেও বড় কথা, এখান থেকে আদৌ কোনও ফোন পৃথিবীতে করা যায় কি না, তাও তাঁর জানা নেই। ফলে মোবাইল থাকলেও যে তিনি তাঁর বউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন, এমন কথা হলপ করে বলা যাবে না। তাই তাঁর দুশ্চিন্তা প্রতি মুহূর্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বাড়ির জন্য মনটা ভীষণ ছটফট-ছটফট করছে।
শুধু তিতারেরই নয়, মায়ের জন্য মনটা যেন কেমন-কেমন করছে জুরানেরও। আজ পর্যন্ত কোনও দিন সে তার মাকে ছেড়ে এতক্ষণ থাকেনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মাকে।
এমনি সময় তো তার এ সব হয় না। গত বারও পঁচিশে ডিসেম্বরের দিন ভোরবেলায় বাড়ি থেকে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘর ঘুরে সেই রাত্রিবেলায় বাড়ি ফিরেছিল সে। না। মায়ের কথা তার একবারও মনে পড়েনি। শুধু কি সে দিনই? গরমের ছুটির পরে বাবার সঙ্গে কত বার জেঠুর বাড়িতে গিয়ে দিনের পর দিন সে থেকেছে। কোথায়, মায়ের জন্য তো তার এ রকম কখনও হয়নি। তা হলে আজ কেন হচ্ছে! তবে কি এখানে, এত দূরে এসেছে বলে! এই জন্যই বুঝি লোকে বলে, দূরে গেলেই বোঝা যায় কে কত আপন। না। তার আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। ‘আমি এখন মায়ের কাছে যাব।’ মনের মধ্যে কথাটা উঁকি মারতেই সময়-কণা বলল, কী? মায়ের জন্য মন কেমন করছে?
কথাটা শুনে মাথা নাড়াল জুরান, হ্যাঁ।
কোনও কিছু না-ভেবে তিতারও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আমারও।
— তোমারও! তার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পরে সময়-কণা ফের বলল, কিন্তু তোমার মা তো বহু দিন আগেই…
— না না, আমার মায়ের জন্য না। জুরানকে দেখিয়ে বললেন, ওর মায়ের জন্য।
ফিক করে হেসে ফেলল সময়, ও, তাই বলো। ঠিক আছে তোমাদের মন যখন এখানে টিকছে না, তখন দেখছি, কী করা যায়! কারণ, আমরা যা-ই করি না কেন, কখনও কোনও গ্রহের কোনও প্রাণীর মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করি না। মনই হল আসল।
মনে শান্তি থাকলে মারাত্মক শোককেও অনায়াসে কবজা করা যায়। মন সুস্থ থাকলে শরীরে প্রবেশ করার আগেই যে কোনও ব্যাধিকে রুখে দেওয়া যায়। তার পরেও যদি কোনও অসুখ-বিসুখ ফাঁকফোকর দিয়ে গলেও যায়, তো তাকেও সামলে নেওয়া যায়। মন ভাল থাকলে বাঁচার ইচ্ছেটাও বেড়ে যায়। আর সেই ইচ্ছের জোরেই যে কোনও প্রাণী তার কাছে ঘেঁষে আসা মৃত্যুকে একটু-একটু করে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। ফলে, না। তোমাদের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কিচ্ছু করব না। তোমারা যা চাইবে, তাই হবে। বলো, কোথায় যেতে চাও?
তিতার বললেন, বাড়িতে।
— বাড়িতে? না ওর মায়ের কাছে?
জুরান বলল, আমার মায়ের কাছে।
— দুজন দু’জায়গায় যেতে চাইছ?
জুরান বলল, না না। দু’জায়গায় না। দুটো আলাদা আলাদা শোনালেও জায়গাটা কিন্তু একই। কারণ, মা এখন বাড়িতেই আছে।
তিতারও ওর কথায় সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখন বাড়িতেই আছে।
— তাই? ঠিক আছে, দেখছি। বলেই, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সময়-কণা। তার পর বলল, না। উনি এখন বাড়িতে নেই। উনি এখন রাস্তায়। উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছেন। না না, হাঁটছেন না। বলতে গেলে উনি প্রায় ছুটছেন।
চমকে উঠলেন তিতার, ছুটছেন! কিন্তু কীসের জন্য! ছেলের জন্য! না, তাঁর জন্য! নাকি দুজনের জন্যই! তার থেকেও বড় কথা, ইমলিকে কি সময়-কণা এখানে বসেই দেখতে পাচ্ছেন!
তিতার জানেন, আগেকার দিনের ঋষি-মুনিঋষিরা চোখ বন্ধ করে পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে অন্যপ্রান্তে ঘটা যে কোনও ঘটনা চাক্ষুষ করতে পারতেন। তা হলে কি এই সময়-কণাও তা পারেন! নাকি এমনিই বলছেন! বুঝে উঠতে না-পেরে তিতার বললেন, আপনি কি ওর মাকে দেখতে পাচ্ছেন?
— হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।
— একটু দেখা যাবে?
— না।
জুরান বলল, আমিও দেখতে পারব না?
— না।
— তা হলে বাড়িতে নয়, মা যেখানে আছে, আমাদের সেখানেই পৌঁছে দিন।
— তাই? ঠিক আছে। এসো। সময়-কণার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদের চোখের সামনে ফুটে উঠল, দরজার মতো বিশাল বড় ছবি বাঁধানোর ঝা-চকচকে একটা ফ্রেম। তার নীচে চৌকাঠের মতো জায়গাটায় কয়েকটি বোতাম শুধু তিড়িক-তিড়িক করে জ্বলছে আর নিভছে। জ্বলছে আর নিভছে।
ওটা দেখে জুরান মনে মনে বলল, তার মানে এরা ম্যাজিক জানে! ও একবার ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতার মহাজাতি সদনে পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিল। সেখানে দেখেছিল, মঞ্চের উপরে সবার চোখের সামনে পি সি সরকারকে হাত-পা বেঁধে একটা লোহার সিন্দুকের মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা-চাবি আটকে দেওয়া হয়েছিল। দর্শকেরা কেউ কেউ মঞ্চে উঠে সেই তালাটা টানাটানি করে পরখ করেও দেখেছিল, সত্যিই তালাটা ঠিক মতো আটকানো হয়েছে কি না। সেই সিন্দুকের উপরে একটা পটকা রেখে তার সলতেতে আগুন ধরিয়ে যে-ই ওরা সরে গেল, অমনি বিকট শব্দ করে সেটা ফেটে উঠতেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে তীব্র আলোর একটা গোলক ছিটকে গিয়ে পড়ল পিছনের গেটে। যেখান থেকে লোক ঢোকে এবং বেরোয়।
সবার মতো খুব স্বাভাবিক ভাবে তার নজরও সেখানে গিয়ে পড়েছিল। জুরান দেখেছিল, দু’পাশে বসে থাকা দর্শকদের হাত নাড়াতে-নাড়াতে ঝলমলে পোশাক পরে প্রেক্ষাগৃহের মাঝখান দিয়ে হাসতে হাসতে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন স্বয়ং পি সি সরকার।
জুরান চমকে উঠেছিল। গোটা প্রেক্ষাগৃহ তখন করতালিতে ফেটে পড়েছে। কে কী বলছে, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। জুরান তখন ওর বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলেছিল, এই জন্যই বুঝি লোকে বলে পি সি সরকার ইজ পি সি সরকার, তাই না?
ওর বাবা বলেছিলেন, এটা সে-ই পি সি সরকার নয়। উনি ছিলেন সিনিয়র। আর ইনি হচ্ছেন তাঁর ছেলে পি সি সরকার জুনিয়র। উনি ছিলেন এঁর থেকেও বড় জাদুকর।
— এর থেকেও বড়!
জুরানের আজ মনে হচ্ছে, এ নিশ্চয়ই সেই পি সি সরকারের চেয়েও অনেক অনেক অনেক বড় জাদুকর। ইচ্ছে করলেই যে-কোনও জিনিস বিন্দুমাত্র না-ছুঁয়েই চোখের পলকে অদৃশ্য করে দিতে পারেন। আবার মন চাইলেই, অনেক দূর থেকেও শুধুমাত্র চোখের ইশারায় সেটা ফের দৃশ্যমান করে দিতে পারেন। না-হলে এই দরজাটা এ ভাবে তাদের সামনে হুট করে দৃশ্যমান হল কী করে!
দরজাটা দেখে অবাক হয়ে জুরান জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
— চিনতে পারছ না? এটা তো একটা দরজা।
তিতার বললেন, হ্যাঁ, সে তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানেও দরজা!
— তোমরা দরজা দেখছ। কারণ, তোমরা পৃথিবীর অধিবাসী। অন্য কোনও গ্রহের অধিবাসীরা এটাকেই আবার তাদের জগতের ধারণা অনুযায়ী অন্য রকম কিছু দেখবে। তুমি দরজা দেখছ, কারণ, তোমাদের ধারণায় দরজা হচ্ছে, একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় যাওয়ার সোপান।
— সে তো বুঝলাম। কিন্তু চারিদিকে খোলামেলা আদিগন্ত এই উন্মুক্ত জায়গায় হঠাৎ করে দরজা কেন?
— তোমাদের যাওয়ার জন্য।
জুরান বলল, কিন্তু এটার মধ্যে দিয়ে আমরা কোথায় যাব?
— পৃথিবীতে।
পৃথিবীতে যাওয়ার কথা শুনেই তিতারের বুকের ভিতরে যেন সন্তুর বেজে উঠল, পৃথিবীতে? কিন্তু কে নিয়ে যাবে আমাদের?
— নিয়ে যাওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। এই দরজাটার ওপারেই তো পৃথিবী।
— মানে?
— মানে কিছুই না। এটা একেবারে লেটেস্ট একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রটার নীচের দিকে দেখো, কতগুলো আলো জ্বলছে আর নিভছে। মানে সিগন্যাল দিচ্ছে।
জুরানের মুখে যেন এক ঝলক আলো ঠিকরে পড়ল। হ্যাঁ, ওই তো, ওই তো, ওই তো…
জুরানের দিকে তাকিয়ে সময়-কণা বলল, ওই আলোগুলো তোমাদের ডাকছে। আসলে আমি ওই যন্ত্রের মধ্যে তোমাদের গন্তব্য ফিট করে দিয়েছি। এখন তোমরা ওই দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে প্রথম যেখানে পা রাখবে, সেটা শুধু পৃথিবীই নয়, পৃথিবীর যেখানটায় তোমার মা এখন আছে, তার দশ মিটারের মধ্যেই তোমাদের পা পড়বে।
— অ্যাঁ!
সময়-কণা মুচকি হেসে বলল, অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ।
তিতার বিড়বিড় করে বললেন, তা হলে কি আমরা যাব?
সময়-কণা বলল, অবশ্যই।
— তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। জুরান বলতেই সময়-কণা বলল, দেখা তো হবেই। তবে আমার সঙ্গে হয়তো নয়, আমার মতো অন্য কোনও সময়-কণার সঙ্গে। আর সে যে তুমিই হবে, এ কথাও খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। যার সঙ্গে দেখা হবে, সে হয়তো তোমার ছেলে, নাতি বা তারও পরের কোনও প্রজন্ম। তবে হবে। দেখা হবে। হবেই। টা টা।
তিতার আর তাঁর ছেলে জুরান বড় বড় দু’পা ফেলতেই দরজাটার একদম কাছে পৌঁছে গেলেন। সামনে ছিলেন তিতার। তিনি সরে গিয়ে জুরানকে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বললেন, যা।
জুরান বলল, তুমি আগে যাও। আমি ততক্ষণে সময়-কণাকে একবার টা টা করে নিই। আবার কোনও দিন দেখা হবে কি না, কে জানে! বলেই, পিছন ফিরে মহাশূন্যের দিকে কয়েক বার হাত নেড়ে টা টা করল সে। তার পরে বাবার পিছু পিছু ও-ও দরজার ভিতরে পা রাখল। আর পা রাখা মাত্রই বাবার মতো সেও নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওদের কাউকেই আর দেখা গেল না।
চলবে…