বাংলাদেশের দু’টি বোমা হামলা আমি টেলিভিশনে সরাসরি দেখেছিলাম। এরপর থেকে ভয়ে, আতঙ্কে আমি যে কোন অনুষ্ঠানের সরাসরি টিভিতে সম্প্রচার দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রথমটি ছিল ২০০১ সালে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হরকাতুল জিহাদের বোমা হামলা। তখন আমি ‘আরণ্যক’ কবিতাপত্র এর লেখা সংগ্রহ, বিলি-বন্টনের কাজের সুবিধার জন্য মোবাইল ফোন কিনেছি। টিভিতে রমনার বটমূলে ”ছায়ানট” এর বর্ষ আবাহনী গান চলছে, আর আমি ফোনে কথা বলছি চট্টগ্রামে এক লেখকের সঙ্গে পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যার জন্য সেখানকার কিছু লেখকদের লেখা সংগ্রহের বিষয়ে। এমন সময়ে টিভিতে একটা শব্দ হল, স্ক্রীন ধোঁয়াটে হল, প্রথমে মনে করলাম টিভি নষ্ট হল! কিন্তু খেয়াল করে তাকিয়ে বুঝলাম না বোমা ফেটেছে ঢাকা’র রমনায় বটমূলে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম মানুষের আতঙ্ক ছোটাছুটি, কেউ তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা মানুষ দেখে ভয়ে দৌড়ে দূরে চলে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর ফোকাস সরিয়ে নেয়া হল, তারপর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। মোবাইলে লেখকবন্ধুকে বললাম ঢাকায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরা হামলা করেছে, চট্টগ্রামে আপনারা সাবধানে থাকবেন। সেখানে নিহত হন ১১ জন, আহত ১৫০।
তারপর আবার ২১ আগস্ট, ২০০৪। সেদিন বিকেলে বের হইনি বাসা থেকে। দেখলাম আওয়ামী লীগের জনসমাবেশ চলছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। টিভিতে দেখাচ্ছে। বরিশালে থাকতে সন্ধ্যার পর সাধারণত বাসা থেকে বের হতাম ছোটকাগজের সম্পাদক-লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য। শেখ হাসিনা সবার শেষে বক্তব্য দিবেন। বিএনপি-জামাতের শাসনামল, চারদিকে উত্তেজনা, প্রতিদিন কোন না কোন অঘটন ঘটছে। প্রায়ই কোথাও না কোথাও বোমা হামলা হতো, হয় সিনেমা হলে, মেলায়, সার্কাস প্রাঙ্গণে, মাজারে, যাত্রাপালায়, উদীচীতে, গীর্জায়, বিরোধীদলের জনসভায়, আদালতে, আওয়ামী লীগের অফিসে-নির্বাচনী প্রচারণায়। প্রগতিশীলদের ঘাঁটি বলে পরিচিত কোন্ জায়গায় না বিএনপি-জামাত সমর্থিত জঙ্গীরা হামলা করেনি? তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার সবরকম চেষ্টা তারা করে যাচ্ছিল। শেখ হাসিনা সবার শেষে স্টেজে উঠলেন। শুনছি তার কথা। হঠাৎ দুই মিনিট ধরে বোমার শব্দ। ক্যামেরা কেবলি এদিক-ওদিক নড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়া আচ্ছন্ন সমাবেশস্থল। ১৩ টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয় আর তাতেও তাকে কাবু করতে না পেরে সমানে চলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি। কিন্তু প্রথম গ্রেনেডটি লক্ষ্যচূত হবার পরপর তাকে নেতাকর্মীরা মানবঢাল বানিয়ে ঘিরে ফেলেছে, ২৪ জন মানুষ তাদের প্রাণ দিয়ে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে দেন। আহত কয়েকশ। মনে করেছিলাম বোমা হামলা। কারণ এমন একটি পাবলিক সমাবেশে কেউ গ্রেনেডের মতো মারাত্মক বিধ্বংসী সামরিক অস্ত্র ব্যবহার করার চিন্তা করতে পারে সে কথা আমার আমজনতার মাথায় আসেনি।
কিন্তু নষ্ট শয়তানগুলো ভেবেছিল। বাজারে একটি জনশ্রুতি এ শয়তানগুলো ছড়িয়েছে যে শেখ হাসিনাও একদিন নিহত হবে তার পিতার মতো। তা সত্য প্রমাণ করতে চেয়েছিল এরা। যদি পারতো জামাত-বিএনপি সরকার আজও চিরস্থায়ী ক্ষমতায় থাকতে পারতো, যুদ্ধাপরাধী জামাতের শীর্ষ নেতারাও যারা পার্লামেন্ট মেম্বার, এমনকি মন্ত্রী ছিল তারা ফাঁসিতে ঝুলতো না, দেশ মডারেট তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত হত। কৃতকর্ম কাউকে ছাড়ে না, তার ফল ভোগ করতে হয় সকলকে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর আজও জেল খাটছে সে মামলায়। প্রতিক্রিয়াশীল, পাকিস্তানপন্থী, মানবতাবিরোধী ভয়ংকর এসব অপরাধীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করি।
সে ঘটনার ১৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। মামলার রায়ও হয়েছে বহু বছর হল। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চিহ্ন বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলতে সে মামলার রায় যত দ্রুত বাস্তবাস্তন হবে তত বাংলাদেশের মানুষের জন্য মঙ্গল। যারা এখনও পঙ্গু হয়ে জীবন যাপন করছেন তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখতে চান। বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল মানুষও চায় ২১ আগস্টের বোমা হামলার ঘটনায় রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে।