‘মহাশূন্যে জুরান’ পর্ব – কুড়ি

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
8 মিনিটে পড়ুন

হঠাৎ মহাশূন্যের দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠল জুরান। উজ্জ্বল হলদে রঙের মশারির মতো থলেটা যে ভাবে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে, যদি ওই গতিতেই এখানে আছড়ে পড়ে, তা হলে আর দেখতে হবে না। যেটার উপরে তারা আছে, সেটা ভেদ করে কতটা গভীরে যে ঢুকে যাবে, কে জানে! আর ওটা যদি সত্যি সত্যিই ওই ভাবে ঢুকে যায়, তা হলে ওটার ভিতরে পদ্মাসন হয়ে বসে থাকা তার বাবার যে কী হাল হবে, তা সহজেই অনুমান করতে পারছে সে।
তাকে যখন আপাদমস্তক চিকেন রোলের মতো মুড়ে কে বা কারা হু হু করে আকাশের ভিতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল, তখন প্রচণ্ড এক ভয়ে ডুকরে উঠতেই তার শরীরটাও বুঝি থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। সেই কাঁপা দেখে, যে বা যারা তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা বোধহয় ভেবেছিল, ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলেই, ও এ রকম হাঁসফাঁস করছে। তাই মোড়কটাকে হয়তো একটু আলগা করেছিল। আর তাতেই মোড়কের তলা দিয়ে সুরুৎ করে গলে গিয়েছিল সে।
পড়ছিল তো পড়ছিলই। পড়ছিল তো পড়ছিলই। মাটি ছুঁতে যখন আর কয়েক মুহূর্ত বাকি, ঠিক তখনই সাঁ… আ… আ… আ… করে এসে যে-একচিলতে সাদা ধবধবে মেঘটা একেবারে চিলের মতো ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে এসেছিল, সেটা বাড়তে বাড়তে কখন যে এত বড় হয়ে গেছে, ও বুঝতেই পারেনি। এখনও বুঝতে পারছে না, এটা কঠিন-নিরেট, নাকি পৃথিবী থেকে আকাশের বুকে যে মেঘকে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়, সেই মেঘের মতোই বায়বীয়, নরম, তুলতুলে!
আগেকার দিনে পৃথিবী থেকে পাঠানো কোনও যান যখন সব চেয়ে কাছের গ্রহ চাঁদে অনুসন্ধান চালিয়ে ফিরে আসত, তখন সরাসরি মাটিতে নয়, সমুদ্রের গভীরতা যেখানে সব চেয়ে বেশি, সেখানেই ল্যান্ড করত। কারণ, ওই সব দ্রুতগতি যানের প্রচণ্ড গতি কিছুতেই ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। ফলে শেষের দিকেও যা স্পিড থাকত, তাতে তা মাটিতে নামার পক্ষে ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই যথেষ্ট ঝুঁকি থাকলেও, তুলনামূলক ভাবে অনেকটা নিরাপদ এবং একমাত্র পথ ছিল, শেষ অবধি যতটা গতি থাকে, সেটাকে সমুদ্রের ভিতর দিয়ে যতটা পারা যায় নিয়ে গিয়ে জলের চাপের নানান স্তরে কমিয়ে একেবারে শূন্যে নিয়ে আসা।
কিন্তু ওটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না যে, ওটার মধ্যে গতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা গতির মুখ পরিবর্তনের কোনও কলকব্জা আছে! আর যদি থাকেও, এখানে তো আশপাশে সে রকম কোনও গভীর জলাশয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে? তবে কি পৃথিবী থেকে ছাড়া অন্যান্য যানের মতোই ওই হলদে রঙের মশারি-থলেটা, তারা যে-মেঘটার উপরে আছে, তাকে ঘিরে চক্কর মেরে মেরে নিজের গতিটাকে একেবারে কমিয়ে তার পরে নামবে?
জুরানের মনে হল, সেটাই স্বাভাবিক। তার পরেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। মনে পড়ে গেল, ভারতের বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলার কথা। যিনি একটানা একত্রিশ দিন চোদ্দো ঘণ্টা চুয়ান্ন মিনিট মহাশূন্যে সফর করেছিলেন। পারি দিয়েছিলেন একশো চার মিলিয়ন কিলোমিটার। শুধু পৃথিবীকেই চক্কর মেরেছিলেন প্রায় দুশো বাহান্ন বার।
তার পর পৃথিবীর মাটি ছোঁয়ার জন্য মহাশূন্য থেকে যখন প্রতি ঘণ্টায় কুড়ি হাজার কিলোমিটার বেগে, অর্থাৎ শব্দের চেয়ে প্রায় আঠারো গুণ বেশি গতিতে ফিরে আসছিলেন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে। ঠিক তখনই, পৃথিবী থেকে মাত্র দু’লক্ষ সাত হাজার ফুট উঁচুতে, হঠাৎ শুরু হয় যান্ত্রিক গোলযোগ। ফলে যানের গতি আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বায়ুর সঙ্গে প্রবল ঘর্ষণে তার বায়ুদূত ‘স্পেস স্যাটেল কলম্বিয়া ফ্লাইট এস টি এস— ১০৭’-এ মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায়। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা তেপ্পান্ন মিনিট। তার পরেই নর্থ সেন্ট্রাল টেক্সাসের আকাশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। টুকরো টুকরো হয়ে যায় গোটা যানটি। দিনটা ছিল, দু’হাজার তিন সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি।
সে কথা শুনে তখন তার মনে হয়েছিল, ওটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা। কিংবা অসাবধানতাবশত হয়েছে। অথবা অন্য কোনও কিছু। কিন্তু এখানে আসার পর, সব দেখেশুনে, সময়ের সঙ্গে এতক্ষণ কাটিয়ে তার এখন, এই মুহূর্তে কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে, এর পিছনে অন্য কোনও গ্রহবাসীদের হাত নেই তো!
হতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়। মহাকাশে থাকার সময় তিনি হয়তো আশপাশের অন্য কোনও গ্রহবাসীদের একেবারেই নিজস্ব অত্যন্ত গোপন এমন কিছু দেখে ফেলেছিলেন, এমন কিছু জেনে ফেলেছিলেন, যা তাঁর নিজেরও বিশ্বাস হয়নি। ওই রিপোর্ট পাঠালে পৃথিবীর মানুষ আদৌ তাঁর কথা বিশ্বাস করবে কি না, সে নিয়ে নিজেরই হয়তো যথেষ্ট সংশয় ছিল। তাই তখন তিনি হয়তো মুখ বন্ধ করে ছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, পৃথিবীর মাটিতে পা দিয়ে রয়েসয়ে, আস্তে আস্তে, একটু একটু করে সইয়ে তার পরে সবাইকে ব্যাপারটা জানাবেন। দরকার হলে গোটা একটা বই-ই লিখে ফেলবেন।
কিন্তু তাঁর মনে মনে ভাবা ওই পরিকল্পনাটা হয়তো ওই গ্রহবাসীরা কোনও ভাবে আঁচ করতে পেরেছিল। তাই তাঁকে চুপ করানোর জন্য আকাশের বুকেই চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে। যা তদন্ত করে বার করা আমাদের মতো সামান্য একটি গ্রহের নগণ্য কিছু মানুষের পক্ষে কখনওই সম্ভব নয়।
তাই যদি হয়, তা হলে তো এখানে আসার পথে তার বাবাও নিশ্চয়ই অনেক কিছু দেখেছেন। অনেক কিছু জেনেছেন। কল্পনা চাওলার মতো আগে থেকে মনে মনে না-ভাবলেও, তিনিও তো পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে এই সব কথা বলে দিতে পারেন! এটা ভেবে, ওরা আবার তার বাবাকে শেষ করে দেবে না তো! সেও যে এর মধ্যে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। তবে!
এ তো মহাবিপদ। কিন্তু এই বিপদ থেকে কে উদ্ধার করবে তাদের! কে! ঈশ্বর! না। সে কোনও গ্রহবাসীকে ঈশ্বর বলে মানতে রাজি নয়। কারণ, যতই জ্ঞান থাকুক, যতই করায়ত্ব থাকুক নানান কৌশল, যতই করিৎকর্মা হোক তারা, তবু ওর মনে হয়, একটা-দুটো গ্রহ নয়, সমস্ত গ্রহের সবাই মিলে হাত লাগালেও, এত কোটি কোটি গ্রহ-তারা তৈরি করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তৈরি করলেও, অত ভারী ভারী গ্রহ-তারাকে মহাশূন্যে এই ভাবে ভাসিয়ে রাখা কখনওই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বনবন করে ঘুরতে থাকা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এলোমেলো ভাবে উন্মাদের মতো ছুটতে থাকা গ্রহ-তারাদের অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষ এড়ানো।
আমেরিকায় যে সাতটি বিল্ডিং নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে পাঁচটি বিল্ডিং তুলনামূলক ভাবে ছোট হলেও, বাকি দুটির উচ্চতা ছিল প্রায় আকাশ ছোঁয়া। একটা একশো ন’তলা। আর একটা একশো দশ তলা। পরে যে দুটো বিল্ডিং উগ্রপন্থীদের বিমান-হানায় ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
সে-ই টুইন্স টাওয়ারের প্রধান আর্কিটেকচার, মিনরু ইয়ামাসাকি যখন দিন-রাত এক করে ভাবছেন, অত বড় বিল্ডিংকে দাঁড় করাতে গেলে কতটা ভিত করা দরকার, যতটা দরকার, ততটাই বা তিনি করবেন কী করে! হিসেব-নিকেষ করতে গিয়ে তিনি যখন আর কোনও কুল-কিনারা পাচ্ছেন না, একেবারে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। তখন হঠাৎ একদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন, একটা চোখ-ঝলসানো আলোর কুণ্ডলির ভিতর থেকে এক জ্যোতির্ময় পুরুষ বেরিয়ে এসে তাঁকে বলছেন, ওরে পাগল, তুই একটা বাড়ি করতে গিয়ে তার ভিত কতটা করবি, সেটা নিয়ে এত আকাশ-পাতাল ভাবছিস? গোটা পৃথিবীটাই তো শূন্যে ভাসছে রে… কী ভাবে ভাসছে, সেটা একবার ভাল করে ভাব, দেখবি, একটা না-একটা রাস্তা ঠিকই পেয়ে যাবি।
উনি পেয়েছিলেন। তাই একটা নয়, ও রকম দু’-দুটি আকাশচুম্বী অট্টালিকা এত সহজেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এই পৃথিবীর বুকে। আসলে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ওই কথাটাই ঠিক। একেবারে একশো ভাগ ঠিক— ‘ঠাকুর চাইলে হয়, না-চাইলে নয়।’
ঠাকুর যদি চান, তা হলে তার বাবাও নিরাপদে এখানে এসে নামবেন। তার সামনে এসে দাঁড়াবেন। দাঁড়াবেনই। হাজার চেষ্টা করলেও কোনও গ্রহবাসী কিচ্ছু করতে পারবে না।
জুরান যখন এ সব ভাবছে, ঠিক তখনই, ওই মশারি-থলেটা ঝুপ করে তার সামনে এসে, একদম ঠাকুমা-পিসিঠাকুমাদের ডালের বড়ি দেওয়ার মতো আলতো করে কী যেন একটা থুপ করে নামিয়েই মুহূর্তের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। জুরান বড় বড় চোখ করে দেখল, না, সে ভুল দেখছে না। তার সামনে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। হ্যাঁ, তার বাবাই।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!