জলের পিঠ থেকে দ্বীপ দেখার আনন্দ আছে, বিশেষ করে যদি পুরোটা একবারে দেখা যায়। খুব ছোটো দ্বীপ না হলে কেবল আকাশ থেকেই তা সম্ভব। আমরাও সোনাদিয়ার পুরোটা দেখতে পাচ্ছি না। এই দ্বীপের ওপাশেই বঙ্গোপসাগর, চারপাশে সাগরের জলভরা চ্যানেল, খুব বিচ্ছিন্ন নয় সে মহেশখালীর ভূমি থেকে, কেননা খাল তো ভূমির ভূগোলের অংশ। তবে এই শিশু দ্বীপের মাতাদ্বীপখানি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত! সোনাদিয়া দ্বীপ যে ইউনিয়নের অংশ সেই কুতুবজুম থেকে সে বিচ্ছিন্ন দুটি খাল দিয়ে, স্থানীয়রা বলে বড়োধার আর ছোটোধার খাল। গুগল ম্যাপে এদের নাম দেখতে পাচ্ছি যথাক্রমে বদরখালি খাল ও নোয়াচিরা খাল। আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা এখন নোয়াচিরা খালে। কে যেন বললো, ওই যে দেখা যাচ্ছে ঘরবাড়ি সেটা মধ্যপাড়া, কারো মত ওটা পশ্চিমপাড়া। সোনাদিয়া দ্বীপে গ্রাম আছে দুটি -পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া আর এ দুই পাড়ার মধ্যে মাঝের ভিটা ঠিক গ্রাম নয়। খাল থেকে যে হালকা জনবসতি চোখে পড়ে তাতে গুটিকয় টিনের চালের ঘর আর একটি হলুদ দালান। এটিই, তার গাত্রবর্ণের ঔজ্জ্বল্যের জন্য, যেন বাঙালি পাড়ায় এক সাহেব দাঁড়িয়ে, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র। তার বকের মতো উঁচু ঠ্যাঙ তাই বলে। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত ঝাউ বন সারি।
আমাদের নৌকা, কাব্য ও শিল্পভারী, একটি কাঠের সেতু ঠিক নয়, জলের ভেতর কাঠের খুঁটি পুঁতে কাঠের স্লাব বসানো পায়ে হাঁটার পথ (pier), তার দিকে এগোয়। কবি নিলয় রফিক যে বলেছিল কাদার জন্য সোনাদিয়া নামতে পারব না, সে হয়তো ভাটায়, এখন জোয়ার, কাদা সব জলের নিচে, আর এই তো সেতু এগিয়ে এসেছে আমাদের নিতে, তীর থেকে তার লম্বা হাতিশুড় বাড়ানো। আমাদের নৌকাখানি সেই সেতুর খুঁটির সাথে যেন ধাক্কা না খায় তাই জাহান এ, বি, ও রশিদ খান- গানের দুই শিল্পী, সতর্ক। দেখি অসমাপ্ত সেতুর উপর, তাকে জেটি বলাই ভালো, কিছু অত্যুৎসাহী গ্রাম্যবালক দাঁড়িয়ে আছে। একে আমাদের ঠিক বৈকালিক বিনোদন মনে হলো না, মনে হলো এরা পর্যটক বা স্থানীয়দের বোঝা (luggage) বয়, অর্থাৎ এরা সৌখিন মুটে। আমরা যে স্থানীয় নই, তা আমাদের দেখেই বুঝে ফেলেছে। তাদের উৎসাহ তাই দ্বিগুণ। ইতিমধ্যে এসে পড়েছে সেই কমলা রঙ গানবোট, ভিড়েছে কাঠের জেটির অন্যপাশে। হঠাৎই এতক্ষণ নির্জন হয়ে পড়ে থাকা জেটিটি কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল। গানবোটের যাত্রীরা সবাই স্থানীয়। মিজান মনির বল্ল, সোনাদিয়ায় এক হাজার থেকে বারো শত লোক বাস করে, এখানে ভোটারের সংখ্যা ৭০০।
গানবোট থেকে যখন লোক নামতে শুরু করেছে, আমরা তখন জেটি ছেড়ে ফের নোয়াচিরা খালের মধ্যভাগে। কিছু বালিকা সুন্দরী গাছ গলা পর্য়ন্ত ডুবিয়ে রেখেছে জলে, কেবল তাদের সবুজ চুলভর্তি মাথা দেখা যাচ্ছে, ঘাট ছেড়ে নৌকা চলেছে যে পথে এসেছি সেই পথে। কারণ, আমরা যেখানে যাব সেই জায়গাটি পশ্চিমপাড়ায়। সেই মাছধরার ঘের, একটি জেলে নৌকা, দুটি ডিঙি পার হয়ে আমরা যাই আরও পশ্চিমে। দুপাশের জলে নিমজ্জিত সুন্দরী বৃক্ষ, খালের শাখা-প্রশাখার বিস্তার দেখে কে বলবে, এটা সুন্দরবন নয়? আমাদের আনন্দিত করে আকাশে বড়ো গোল চাঁদ উঠেছে, দিনের শেষবিন্দু আলোর সাথে মিশেছে পূর্ণিমার মিহি কিরণ। নৈসর্গিক আর কাকে বলে?
দূরে, ওটাই বঙ্গোপসাগর, এক সমুদ্রগামী জাহাজের বাতি জ্বলা কমলা সাদা দেহ দৃশ্যপটে সংযোজন করেছে অভাবিত কৌতুহল। মনে হলো সোনাদিয়া দ্বীপে না এলে বড়ো ক্ষতি হতো আমার। ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ এমন নিসর্গে এলেন না, কিংবা ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ কী করে রইলেন এমন নৈসর্গিক পরিবেশে যাত্রা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে? প্রথমজন পারেননি ছুটির জটিলতায়, দ্বিতীয়জন আক্রান্ত হলেন এক ঋতু-না-বোঝা ঋতু (seasonal) জ্বরে। সঙ্গী হারিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ, স্থানীয় কোনো একজনের নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস, গুগলের বজ্রসহ বৃষ্টপাতের চোখরাঙানি পূর্বাভাষ, দেশব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি, কক্সবাজারে লকডাউন – এতসব প্রতিকূলতা জয় করে আমি যে দৃঢ়চিত্তে এখানে এসেছি সাইয়্যিদ মঞ্জুর আন্তরিক আমন্ত্রণে ও হাফিজ রশিদ খানের বন্ধুত্বসুলভ অনুরোধে সেজন্য নিজেকে সহস্র ধন্যবাদ দিই। এমন সুযোগ জীবনে অনেকবার আসে না। এই যে এক জল স্বচ্ছল খালের পিঠে, আকাশে পূর্ণিমা সংলগ্ন চাঁদ, এক অপার্থিব আলোতে ভরা আকাশ, দুপাশে স্নানরত বৃক্ষাবলী – এর তুলনা কী?
এর কোনো তুলনা নেই!
দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা রাত নেমে এসেছে, আমরা এক চরে এসে নামি। এখানে কেন? কে যেন বললো, এখানেই আমাদের অনুষ্ঠান। আমি শিশুর সারল্যে ভাবলাম এই কাছিমের পিঠের মতো চরটিতে জন্মদিনের উৎসব হয়তো করা যাবে, বনভোজনও সম্ভব, কিন্তু এই খোলা আকাশের নিচে ঘুমাব কী করে? যদি বৃষ্টি নামে। আমি ভেবেছিলাম ছোট্ট চরটি চারিদিকে জলবেষ্টিত। এখন দেখি তার একপ্রান্তে ভূমির পথ, আমার সাথীরা সেইপথ ধরে ধীরে ঝাউ বনের ভিতর হারিয়ে যাচ্ছেন। চাঁদের ছবি তুলতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছিলাম। নির্জন বনে একাকী হয়ে গেলে বালকপ্রাণে যেমন ভয় জেগে ওঠে, তেমনি ভয় জেগে উঠল, দেখি একা নই, পেছনে কবি রুদ্র সাহাদৎ আছে। তার দুহাত ভর্তি ব্যাগ, আমি একটি নিতে যাই ভার কমাতে, কেননা আমি ব্যাকপ্যাকটি পিঠেই রেখেছি, হাত আমার খালি। বিনয়ী তরুণ কবি কিছুতেই আমাকে একটি ব্যাগ দিবে না, বল্ল, ‘এগুলো তেমন ভারী নয়, হালকা।’ পথ নয়, যাচ্ছি জোয়ার জলে সিক্ত মাঠ দিয়ে, পায়ে আমার নাগরিক চামড়ার জুতো, সেই ব্লাক সু, যা পায়ে দিয়ে আমি সিডনির সমুদ্রসৈকত থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ অবধি ঘুরতে এসেছি। পা ফেলতে হচ্ছিল সাবধানে, কোথাও কোথাও হালকা লাফ দিয়ে। মনির বললো, যেখানে ঘাস আছে সেখানকার মাটি শক্ত।
ঝাউ বনে প্রবেশ করে আমাদের দলের কাউকে দেখলাম না। ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে সবাই। ভাগ্যিস রুদ্র সাহাদৎ ছিল, নইলে অন্ধকার ও নির্জন বনে একাকী হলে ভয় পেতাম আমি। কিছুদূর এগুতেই একটি একতলা দালানের দেখা পাই, সাথীরা ঢুকে গেছে সেই বন কুটিরের ভেতর। এখানেই তবে আমাদের তাঁবু। এখানেই আজ মধ্য রাতে আমরা উদযাপন করব কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন। আয়োজকরা জানতো এখানে বিদ্যুৎ আছে, লাইনের নয়, কেননা দ্বীপের এ প্রান্তে বিদ্যুতের লাইন আসেনি, জেনারেটর উৎপন্ন বিদ্যুৎ। আমাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই, বিদ্যুৎ হলেই হলো, উৎস নিয়ে কে মাথা ঘামায়? পরে শুনলাম এই বনজ কুটির, দালান যদিও, নির্মাণ করেছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমুদ্র ও নিসর্গপ্রেমী কর্মকর্তা। তিনি নাকি মাঝে মাঝেই এখানে এসে থাকতেন। এর ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ আসতো সৌরশক্তি থেকে। তিনি নেই, চোরেরা সোলার প্যানেল চুরি করে নিয়ে গেছে, এমনকি নিয়ে গেছে বাংলো সদৃশ্ ঘরটির সমুখে স্থাপিত পানির কলটি। পারলে গোটা বাড়িটিই হয়তো লোপাট করে দিত, বেশি ভারী আর মাটিতে প্রোথিত বলেই পারেনি।
মঞ্জু বাহিনী প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে, তাদের বয়ে আনা বোচকাগুলোর ভেতর কেরোসিন ও পানীয় জল আছে। সমুখে বারান্দা, ভেতরের ঘরে প্লাস্টিকের টুলের উপর এক বড়ো কুপিবাতি কেরোসিনের গভীর সমর্থনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। সেই আলোয় একজন পুরুষ ও একজন কিশোরকে দেখা গেল, বোধহয় এরাই কেয়ারটেকার, একটি ব্যাটারি চালুর চেষ্টা করছেন, তাতে ঘরের ছাদে একটি টিমটিমে বাতি জ্বললো বটে, ঘর আলোকিত করতে ব্যর্থ হলো। আমাদের ভরসা ঐ কুপিবাতিই। আমরা বসেছি কুপিবাতিকে ঘিরে, সঙ্গে আনা খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী মেঝেতে রাখা। আমরা গেলাম একপ্রস্থ ঝাউ বন পার হয়ে সমুদ্র সৈকতে। এই বনজকুটির থেকে ৫০০ ফুট দূরত্বেই বঙ্গোপসাগর তার ঊর্মিমালা নিয়ে নিয়ত গর্জনশীল। তখন জোয়ার, ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালুর সৈকতে। দ্বাদশী বা একাদশী চাঁদকে পূর্ণিমার চাঁদ বলেই প্রতিভাত হলো। ভাগ্যিস হাফিজ রশিদ খান পূর্ণিমা সংলগ্ন চন্দ্রতিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কৃষ্ণতিথি হলে চাঁদের এই রূপ, একপাশে অনিঃশেষ সাগর, অন্যপাশে এই দ্বীপ, তার ঝাউবনবীথি ও বালুর সৈকত এভাবে দেখা যেত না। আমরা মোহিত হয়ে গেলাম, আমরা মুগ্ধ রইলাম। কখনো সৈকত ধরে হাঁটা, কখনো একটি পতিত ঝাউগাছের কাণ্ডের উপর বসে আমরা সেই অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলাম। মনে হলো কখনো একটি রাত সহস্র রাত্রির সমান।
(চলবে)