বরিশালে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের চত্বরে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এর পরিচ্ছন্নতা বিভাগ কর্তৃক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পনেরো আগস্ট উপলক্ষে দেয়া শোক দিবসের ব্যানার অপসারণর চেষ্টায় আনসার সদস্য কর্তৃক গুলির ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার রাত সাড়ে দশটা থেকে দেড় ঘন্টাবাপী এই সহিংস ঘটনায় অন্তত পঞ্চাশ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে আঠাশ জন বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে এক জনের অবস্থা গুরুতর, তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ার রাত থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত বরিশালের সাথে দেশের সকল জেলা ও ঢাার সাথে সড়ক ও নৌ যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এর পরিচ্ছন্নতা বিভাগ এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বরিশালের সি এ্যান্ড বি সড়কে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাস্তায় আবর্জনা ফেলে রাখে ও ট্রাক দিয়ে সড়ক অবরোধ করে।
এদিকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা প্রশাসক দশ প্লাটুন বিজিবি ও দশ জন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন এর জনসংযোগ দপ্তর। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে খুলনা থেকে বিজিবি বরিশালের দিকে রওনা দিয়েছে।
কিভাবে হামলার সূত্রপাত এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ:
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এর উচ্ছেদ শাখার কয়েকজন প্রথম রাত সাড়ে ন’টায় ইউএনও অফিসের ক্যাম্পাসে ঢুকে ব্যানার অপসারণ শুরু করলে প্রথমে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা বাধা দেয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। পরে সদর ইউএনও মো. মুনিবুর রহমানও তাদের নিবৃত্ত করতে গেলে – বিসিসি স্টাফ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। এক পর্যায়ে ইউএনও এর প্রতি তারা চড়াও হলে ইউএনও নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় আনসার সদস্যদের গুলির আদেশ দিলে আনসার সদস্যরা ছররা গুলী বা রাবার বুলেট ছোঁড়ে।
পরে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ঘটনাস্থলে গেলে আনসার সদস্যরা পুনরায় গুলিবর্ষণ করে বলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পক্ষ থেকে আভিযোগ করা হয়েছে।
ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, রাত সাড়ে ন’টায় দশ জন যুবক রাতে আমার ক্যাম্পাসে ঢুকে ব্যানার অপসারন শুরু করলে আমি দিনের বেলা আসতে বললে তারা ক্ষিপ্ত হয়। পরে আবার রাত সাড়ে দশটায় ষাট সত্তর জনের একটি দল আমার বাসভবনে বিনা অনুমতিতে ঢোকে এবং আমাকে গালি দেয়। আমার বাবা-মা দুই জনেই কোভিড রোগী তারা ভয়ে কাঁপছেন। এমত অবস্থায় আমার সেফটির জন্য আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। এসময় তারা আমার গেট ভেঙে ফেলে এমনকি বাসভবনে ঢোকার চেষ্টা করে।
ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক মাইনুল ইসলাম বলেন, মেয়রের উপস্থিতিতে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে- নেতাকর্মীরা না থাকলে তিনিও আহত হতেন।
’
প্রত্যক্ষদশীরা জানান, বেশ কয়েক দফা ধরে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সাড়ে ন’ টায় প্রথমে বিসিসি উচ্ছেদ শাখার কয়েকজনের সাথে আনসার ও ইউএনও এর বাদানুবাদ। পরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগে অন্তত ত্রিশ চল্লিশ জন সদস্য ইউএনও এর সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হয় এক পর্যায়ে আনসার সদস্যরা গুলি করে। পরে ঘটনাস্থলে মেয়র, আলীগ সভাপতি এ্যাড. এ কে এম জাহাঙ্গীর গেলে এসময়েও আনসার সদস্যরা গুলি বর্ষণ করে। এসময় পুলিশের লাঠি চার্জ ও গুলিতে বেশ কয়েক জন আহত হয়।
ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. এনামুল হক জানান, ’সংঘর্ষ নয়- আমরা পরিস্থিতি শান্ত করতে যা করার তাই করেছি।
ঘটনাস্থলে পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান:
পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান ভোর রাত একটায় ইউএনও এর বাসভবনে এস পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও দু:খজনক। এখানে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। এখনে একটিভিস্টদের ভায়েলেন্ট অবস্থায় দেখেছি। সার্বিক ভাবে দেখছি- তবে যারাই জড়িত থাকুক এই ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক জসীমউদ্দিন হায়দার জানান- আমি ইউএনও’র মারফত যতটুকু শুনেছি- ওরা তার উপর চড়াও হয়েছিল।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশার মো. সাইফুল ইসলাম বাদল জানান, ’আগস্ট মাসে এই ঘটনাটি দুঃখজনক। আমরা সকল বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছি।
মামলা:
এদিকে এই ঘটনায় সদর থানার ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান ও পুলিশের সাব ইনসপেক্টর শাহজালাল বরিশাল কোতয়ালী থানায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহামুদ বাবু সহ অর্ধশত নেতা কর্মীর নামে,বারিতে ও শারিরীকভাবে হামলা, কর্তব্যকাজে বাধা প্রদানের অভিযোগ এনে বৃহস্পতিবার বিকেলে কোতয়ালী থানায় মামলা করেছে। দুই মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েক শত মানুষকে আসামী করা হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলন:
এদিকে আনসার সদস্য কর্তৃক গুলি, পুলিশের লাঠিচার্জ ও ইউএনও কর্তৃক হামলার নির্দেশের ঘটনার প্রতিবাদে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন একই সাথে সাংবাদিক সম্মেলনে আয়োজন করে মেয়রের বাসভবনে। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন পানেল মেয়র গাজী নইমুল হোসেন লিটু।
সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ জানিয়ে উল্লেখ করা হয় ইউএনও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিজেই সিটি কর্পোরেশনের স্টাফও ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সদস্যদের উপর গুলিবর্ষণ করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে দাবী করা হয় ইউএনও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই কাজ করেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবী করেছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন সহ ষাট জন নেতা কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে ও আরো পঞ্চাশের অধিক আহত হয়েছে বলে উল্লেখ করে এর বিচার দাবী করা হয়।
এই ঘটনায় মামলা দায়ের করা হবে কিনা এই প্রশ্নে নেতৃবৃন্দ জানান, এই মুহুর্তে নেতাকর্মীদের চিকিৎসার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। এ ছাড়া এখন শোকের মাস চলছে। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয় ইউএনও এর বাসভবনে হামলার কোন ঘটনা ঘটেনি। তা ছাড়া তারা নির্বিচারে গুলি করেছে। এমনকি মেয়র আসলেও তারা ঘটনাস্থলে গুলিবর্ষন অব্যাহত রাখে।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন শান্ত বরিশালকে অশান্ত করার জন্যই এই হামলা করা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়ে পুলিশ তল্লাশি করছে।
মেয়রের বক্তব্য:
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ জানান, আমার অফিসের লোকজনদের সাথে ইউএনও অফিসের লোকজনদের হৈচৈ শুনে সিনিয়রদের পাঠালে সেখানেও আনসাররা গুলি চালায়। পরে যখন আমি আসি হাত উঠিয়ে নিজের পরিচয় দেই, সেখানেও আমার নেতাকর্মীদের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমি এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ। ওখানে এমন কোন ঘটনা ঘটে নি যে গুলির ঘটনা ঘটবে। এই ঘটনায় আমার অফিসের বেশ কয়েকজন স্টাফ সহ অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। আমার লজ্জা লাগছে- তাই আমি ঘটনাস্থল থেকে চলে আসছি। আহতদের সংখ্যা এখনই নিরুপন করতে পারবো না। আমি এই ঘটনার তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা চাই। অবশ্যই এই ঘটনার আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আমি মনে করি, অনেকেই চায় না বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এই ভাবে নিজের পায়ে চলুক। অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন না পারলেও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নিজের পায়ে চলছে। এটা কারো খারাপ লাগতে পারে। তারাও এই ঘটনার পিছনে থাকতে পারে।
আটক:
পুলিশ কমিশনার জানান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহামুদ বাবু সহ বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় আমরা আলাপ আলোচনা করেই, সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত নেবো। পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বশেষ বারোজনকে আটকের কথা বলা হয়েছে।
সর্বশেষ
বরিশালে বুধবার রাত থেকে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ কর্মীদের হাতে একটি বাস ও রাস্তার আইল্যান্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রাত থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত সড়ক ও নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সকালে হঠাৎ মেয়রের বাসভবনের সামনে প্রায় শতাধিক পুলিশ ঘিরে রাখলে উত্তেজনা চরমে ওঠে। এসময় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা মেয়রের বাসভবনের সামনে ভীড় জমায়। পরে দুপুর বারোটায় পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে কোতয়ালী থানার ওসি নুরুল ইসলাম জানান, এই বাড়িতে মামলার কয়েকজন আসামী আছে জানতে পেরে আমরা বাসভবনে যাই পরে, কাউকে না পেয়ে ফিরে আসি। এদিকে এই ঘটনায় জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এর সাথে ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে মেয়রের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে।