বরিশাল নগরের থানা কাউন্সিল (উপজেলা পরিষদ) কম্পাউন্ডে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ছাত্রলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। এসময় সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের লক্ষ্য করে আনসার সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার (১৮ আগস্ট) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনার পর থানা কাউন্সিলসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা।
এবিষয়ে যা বললেন মেয়র
‘বরিশালে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে প্রশাসনের লোকজন, তাতে আমার পদত্যাগ ছাড়া উপায় নেই। আমাকে তারা কাজ করতে দিচ্ছে না। কার ইশারায় এমনটা করছে তারা? আমার কাজে মনোনিবেশ করতে পারছি না উনাদের কারণে। উনারা সব প্যাকড হয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন।’
বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের পর বুধবার রাত ৩টার দিকে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের রেগুলার কাজ। সেই অনুযায়ী আমার করপোরেশনের কর্মীরা রাতে উপজেলার পরিষদ চত্বরে বিভিন্ন ব্যানার অপসারণে যায়। এ সময় ইউএনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের লোকজনের ওপর গুলি চালায়। এতে আমার প্রশাসনিক কর্মকর্তাও আহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় আরও অনেকে।
‘খবর শোনার পর আমি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের ঘটনাস্থলে পাঠাই বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য। তবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরও গালিগালাজ করে ইউএনও। পরবর্তীতে আমি ঘটনাস্থলে গেলে আমার ওপরও গুলি চালানো হয়। আমার শরীরেও গুলি লাগে। এর পরই আমার লোকজন আমাকে ঘিরে রাখে। আমার মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহামুদ বাবুকেও আটকে রাখে।’
মেয়র বলেন, ‘আসলে আমি কষ্ট পেয়ে লজ্জায় সেখান থেকে বাসায় চলে আসি। প্যানেল মেয়রদের রেখে আসি, যাতে সেখানে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। পরে শুনি পুলিশ গিয়ে আমার নেতা-কর্মীদের এলোপাতাড়ি মারধর করেছে।
‘শত শত লোক আহত হয়েছে। এমন হলে আমি কীভাবে কী করব? আমাকে এমনভাবে কেন টার্গেট করা হচ্ছে? আমাকে কেন কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না? এগুলো আমার প্রশ্ন নয়, নগরবাসীর প্রশ্ন।’
মেয়র জানান, ব্যানার সরিয়ে নিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। যেগুলো সরানো হয়নি, সেগুলো অপসারণে রাতে কাজ শুরু করেন কর্মচারীরা। উপজেলা পরিষদ চত্বরে তাদের বাধা দেয়া হয়।
এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান মেয়র সাদিক।
তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে গুলি চালাতে হবে। এটা ষড়যন্ত্র।
যা বললেন ইউএনও
তে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান মধ্যরাতে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, যে অবস্থায় আমি আছি সেখানে বক্তব্য দেওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। আমার কোভিডে আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবা-মা সরকারি বাসভবনের ওপর থেকে দেখছিলন কি হচ্ছে বাইরে।
তিনি বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ১৫-২০ জনের একটি দল মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের পাশে ঘোরাঘুরি করছিলো। তখন আনসার সদস্যরা আমাকে জানায়, বেশকিছু ছেলে-পেলে আমাদের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেছে। এটা সিকিউর এলাকা তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এটা বলেছে। তখন তাদের আমি চলে যেতে বলার জন্য আনসার সদস্যদের বলি। এরপরপরই জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে রাজীব নামে এক ব্যক্তি কারো পারমিশন না নিয়ে, কারো তোয়াকা না করে আমার বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। আমি নিচে নামার আগেই তাদের ঘরের দরজার সামনে দেখতে পাই।
সে তার পরিচয় দেওয়ার পর আমি বললাম এতো রাতে কি কারণে এসেছেন এখানে। তখন সে জানায় নির্দেশনা রয়েছে তাই তারা ব্যানার ছিঁড়ছে। তখন আমি বললাম এটা সরকারি কম্পাউন্ড, এখানে সরকারি অফিস-আদালত রয়েছে, আমরা সরকারি অফিসাররা এখানে থাকি। আর এতো রাতে এখানে এগুলো শোভন নয়, কাইন্ডলি আপনারা চলে যান, কালকে যেটা করার করবেন। পার্টির যা সিদ্ধান্ত সেটা পরে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানালেও সে বের হয়ে যাচ্ছে না, তো যাচ্ছে না। পরে আমি দাঁড়িয়ে থেকে তারা চলে গেলে মেইন গেট আনসার সদস্যদের সহায়তা আটকে দেই। এরপর আমরা উপরে বাবা মায়ের সঙ্গে বসা। তখন হঠাৎ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৬০-৭০ জন লোক এখানে আসে। আনসার সদস্যরা ভয়ে দৌড়ে উপরে উঠে এসে আমাকে জানায়, স্যার আপনার বাংলোর মধ্যে ৬০-৭০ জন ঢুকতাছে। তারা যখন আমার বাংলোর সামনে তখন আমি ঘর থেকে বের হয়েছি। তখন একজন আমাকে পরিচয় দিলেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান বাবু। তার পাশে বহু লোকজন, সেখান থেকে একজন খুব উচ্চস্বরে আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করছিলো। তখন আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি ভাই আপনার পরিচয়টা। তিনি তখন তার নাম সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত বলে জানায় এবং বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দাবি করেন। এসময় তার পাশ থেকে একজন বলছিলো তুই পরিচয় দিয়ে কি করবি? একসময় কথা বলতে বলতে যখন আমার পেছন দিকে লোকজন আসতে শুরু করে, তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাকে ঘিরে ধরা হচ্ছে। তখন আনসার সদস্যদের ইশারা দিলে তারা আমার কাছে চলে আসে। আনসাররা বাঁশি বাজালেও যখন তারা সরছিলো না তখন আনসার সদস্যরা ফোর্স করছে। তখন যে যার মতো করে দৌড়াইছে। আর তখন আমি নিজে মাহামুদ হাসান বাবুর হাত ধরে ফেলেছিলাম এবং আনসারের হাতে তুলে দেই। তাদের বের করে দিয়ে আমাদের গেট আটকে দিয়েছি। তারপরে দুইশ, তিনশ, চারশ না পাঁচশ আমি জানি না, বহু লোক এসে আমাদের সরকারি গেটটাকে ভেঙে তচনছ করে ভেতর থেকে ঢুকে আমার ঘরের বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে। ভাগ্যিস আমার উপজেলার অফিসাররা চলে এসে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা আটকে উপরে নিয়ে যায়। কারণ ওরা নীচতলায় ঘরের ভেতর পর্যন্ত চলে এসেছিলো। যে সিচ্যুয়েশন সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা যাবে না।
তিনি বলেন, যে অবস্থায় আমি আছি সেখানে বক্তব্য দেয়ার মতো অবস্থা নেই। আমার বৃদ্ধ কোভিডে আক্রান্ত বাবা-মা ওপর থেকে দেখতিছেন কি হচ্ছে বাহিরে।
আমার পক্ষ থেকে গুলি করার অর্ডার (ডেসপাসের অর্ডার) দেওয়া হয়নি, তবে আমার বাসার সামনে যখন আমাকে ঘিরে ধরা হবে তখন আনসার সদস্যরা তো আমাকে সেভ করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।
যা বললেন সিটি কপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন বলে দাবি করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস। শর্টগানের গুলিতে আহত ওই কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) ভোরে সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন।
তিনি বলেন, বরিশাল নগরে বিভিন্ন এলাকায় থাকা অবৈধ ব্যানার অপসারণ নিয়মিত কাজ। সেই কাজের অংশ হিসেবে থানা কাউন্সিলে কিছু ব্যানার টানানো যা কিনা শোকের মাসের সঙ্গে যাচ্ছিলো না। তাই ওই ব্যানারগুলো অপসারণের লক্ষে সেখানে যাওয়া হয়। কম্পাউন্ডে যাওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের স্টাফদের বাধা ও খারাপ ব্যবহার শুরু করেন এবং সেখানে কাজ না করার জন্য বলেন। এর দুই-এক মিনিটের মধ্যেই তিনি খারাপ ভাষা ব্যবহার করে গুলি চালানোর জন্য আনসার সদস্যদের নির্দেশ দেন। আমার চোখের সামনেই ঘটে এই ঘটনা। তখন বেশ কিছু লোক গুলিবিদ্ধ হয়েছে, যে যেভাবে পেরেছেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য সবাই দৌড়াচ্ছিলেন। পরবর্তীতে মেয়র বিষয়টি জেনে ঘটনাস্থলে যান এবং মেয়র একা ভেতরে প্রবেশ করার সময় আনসার সদস্যরা গুলি ছোড়েন।
বিসিসি প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। আর আমাদের কর্মচারী ও আমরা তো নিরস্ত্র তাহলে অস্ত্রের সামনে কীভাবে হামলা চালানো সম্ভব।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ মানে সরকারি কাজেই বাধা দেওয়া। আর গেল রাতের ঘটনা প্রচণ্ডভাবে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার শামিল। ইউএনও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক যা বললেন
জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, আমরা সবাই এসেছি জনগণের সেবা করতে, আমরা সরাসরি সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সব আদেশ-নির্দেশ পালন করি এবং আমরা জনগণের বন্ধু। সেখানে কোনো প্রশ্ন থাকলে বিভাগীয় কমিশনার স্যার কিংবা আমাকে জানাতে পারতো। এখানে একটি আলোচনার বিষয় ছিলো, কিন্তু সেটি না করে তাৎক্ষণিকভাবে যে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে সেটা আসলেই দুঃখজনক।
পুলিশ কমিশনার যা বললেন
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, খবর পাওয়ার পরপরই মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ফোর্স আসে থানা কাউন্সিলে। পরে পরিস্থিত স্বাভাবিক করতে যা যা প্রয়োজন ছিলো তা করা হয়েছে। আনসার সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন আহত হয়েছেন, তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিষয়গুলো সার্বিকভাবে দেখছি, কীভাবে কি কারণে ঘটনাটির উদ্ভব হলো সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আমরা বলতে পারবো।
বিভাগীয় কমিশনার যা বললেন
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, আগস্ট মাসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হচ্ছে শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে সবাই মিলে বরিশালবাসীর সেবা নিশ্চিত করবো। এ সময় এরকম একটি ঘটনায় আমরা সবাই ব্যথিত, মর্মাহত। আমাদের পুলিশ কমিশনার বলেছেন ঘটনার তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ভালোভাবে অগ্রসর হোক, এগিয়ে যাক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।