’এই সেই বুলেট যেটি আমার শরীর থেকে বের করা হয়েছিল। উনিশ শ পঁচাত্তর সালে আমার শরীরে মোট এগারোটি বুলেট বিদ্ধ করে ঘাতকরা, ছয়টি বুলেট এসে লাগে বাম পায়ে, দুইটি ডানপায়ে, দুইটি ডানহাতে ও একটি পেটে। এর দশটি অপারেশন করে বের করা হয়। একটি আজও রয়ে যায় হাটুতে, এটি হয়তো মৃত্যু পর্যন্ত আমার সাথে থেকে ই শ্মশানে যাবে। আর অপারেশন করে বের করা দশটি বুলেটের একটিকে আজো আমি সংরক্ষণ করে রেখেছি ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসাবে’- পয়তাল্লিশ বছর ধরে আগস্ট হত্যাকান্ডের স্মৃতি নিয়ে বরিশাল নগরীর ফলপট্টি এলাকায় বসবাস করছেন শিল্পী ললিত দাস। তিনি সহ তার ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপের অন্তত ছয় সদস্য সেদিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন মিন্টু রোডের মন্ত্রীর বাসভবনে। এই হত্যাকান্ডে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবার বর্গের সাথে এই শিল্পীদলেরও একজন সদস্য নিহত হয়।
নিজ বর্ণনায় সেদিনের আগস্ট হত্যাকান্ডে নিজের গুলীবিদ্ধ হওয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয় পানি ,বিদ্যুৎ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যদের মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ও নির্মম পরিবেশের ছবি তুলে ধরেছেন পঁচাত্তর বছর বয়সী এই সংগীত শিল্পী।
’উনিশ চুয়াত্তর সালে বরিশালে ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপ এক নতুন ক্রেজ নিয়ে আসে। আবদুর নইম খান রিন্টু, জিল্লুর, টুটুল সহ বেশ কয়েকজন এই ব্যান্ড গ্রুপের সৃস্টি করেন। কিছু পরে আমিও সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেই। সেদিনের এই ব্যান্ড গ্রুপ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বরিশালের প্রথম ব্যান্ড গ্রুপ। উনিশ পঁচাত্তর সালের মে-জুন মাস হবে। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব আসেন অশ্বিনী কুমার হলের পিছনে বাকশাল অফিস উদ্বোধন করতে। উদ্বেধনী অনুষ্ঠানে উনি ছাড়াও আরো তিন মন্ত্রী যোগ দেয়। সে সময়ে আমরা ক্রিডেন্স এর পক্ষে সংগীত পরিবেশন করি। উনি আমাদের গানে খুশী হয়ে ঢাকায় তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
সে সময়েরআমাদের গ্রুপের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তারই আগ্রহে এগারো আগস্ট সকালে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপের দশ সদস্য তৎকালীন সময়ে গাজী স্টিমারে ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। স্টীমারে গিয়ে রাত নয়টায় ঢাকার সদরঘাট পৌছই। এতো রাতে আমরা আর কোথাও যেতে পারিনা। স্টীমার ঘাটের রেস্ট রুমেই আমরা রাত কাটিয়ে দেই। সকালে আমাদের দলটি নবাবপুর রোডের হোটেল নিগার এর রুম ভারা করি। খোজ নিয়ে জানলাম মন্ত্রী সাহেব নেই -দুইদিন পরে আসবেন। আমরা হোটেল ছেরে মিন্টু রোডে সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়িতে যাই। কিন্তু হাসনাত ভাইকে না পেয়ে আবার আমরা লঞ্চঘাটে ফিরে আসি। তখন লঞ্চ ওয়াটার ওয়েজ মাত্র চলে গেছে ক্রিডেন্স এর প্রতিষ্ঠাতা রিন্টু আমারে সবাইকে খাওয়ালো। সে আমাদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে আবার আমরা মন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে নীচতলায় ঐ রাতে থাকি। পরেরদিন আমরা বিকেলে রিহার্সাল দেয়ার সময়ে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব ও রাসেলকে ঐ বাসায় দেখি।
ললিত দাস জানান, হাসনাত ভাই আমাদেরকে রাত নয়টায় শিল্পমন্ত্রীর বাসায় নিয়ে যান। দুইটা গাড়ি ও একটা পিকআপ নিয়ে আমরা রওনা দেই। আমরা বাড়িতে গিয়ে মন্ত্রী ছাড়াও রাজশাহীর এক এমপি রাজনৈতিক নেতা শহীদুল হক জামাল কে দেখি।
তিনি জানান‘ শুরু হল গানের অনুষ্ঠান। প্রথম গান -গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা। এর পরে মন্ত্রীর নির্দেশে রীতা-রীতা যেও না চলে গানটি গাই। খুব সুন্দর অনুষ্ঠান। মন্ত্রীর নির্দেশে জামাল ভাই পাঁচ হাজার ও অন্যান্যরা মিলে আরো পাঁচ হাজার টাকা আমাদেরকে দেয়। গান শুনে মন্ত্রী বেতার টেলিভিশনে আমাদেরকে সুযোগ দেয়ার জন্য নির্দেশে দেন। এসময় আমি আমার জন্য চাকুরীর একটি ব্যবস্থা করতে মন্ত্রীকে বলার জন্য হাসনাত ভাইকে অনুরোধ করি। হাসনাত ভাই বললে- মন্ত্রী জানান এক সপ্তাহের মধ্যে চাকুরী নিলে কুমিল্লায়, একমাসের মতো অপেক্ষা করলে বরিশাল টেক্সটাইল মিলে ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। আমি রাজী হই। রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা ঐ বাড়ি থেকে মিন্টু রোডে সেরনিয়াবাত এর বাড়িতে ফিরে আসি।
ললিত দাস জানান- তখন আমার মনে খুব খুশী লাগছিলো- নতুন চাকুরী সেই সাথে ক্রিডেন্স এর গানের ইনস্ট্রুমেন্ট এর জন্য ব্যবস্থা, রেডিও টেলিভিশনে কাজের সুযোগ, সব মিলিয়ে দারুণ সব ঘটনা। আমরা নিজেদের মধ্যের এই খুশী আর মাত্র কয়েকঘন্টা পরে সব মিলিয়ে যাবে তখন কে জানত?
’রাত তিনটা সারে তিনটা হবে-গুলীর আওয়াজে আামি সহ সকলের ঘুম ভেঙে গেল। করা যেন ব্রাশ ফায়ার করছে- চিৎকার করছে। ভিতরে থেকেও কেউ বলছে হু-আর ইউ? প্রতি উত্তরে কিছু গালাগালি শুনতে পেলাম। একটু পরে দেখলাম রাস্তা দিয়ে আরো কনভয় আসলো, আবারো ব্রাশ ফায়ার। একদল সিঁড়ির নীচে, আরেকদল সিঁড়ির উপরে উঠে গেলো। অধিকাংশেরই কালো পোশাক। আমরা সিঁড়ির পাশে নীচের রুমে ছিলাম। বন্দুক দিয়ে তারা দরজায় আঘাত করতে লাগলো। দরজা ভেঙে পরার উপক্রম। এইসময়ে আমি সহ শিল্পী জিল্লুরকে দরজা খুলে দিতে বললাম। জিল্লুর দরজা খুলে দিল। হুর মুর করে অস্ত্র হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের পেটাতে লাগল অস্ত্রধারীরা। তারা রাইফেলের বাট দিয়ে আমাদের আঘাত করতে লাগলো। আমরা চিৎকার করে বললাম‘ আমরা বরিশাল থেকে এসেছি আমরা শিল্পী মানুষ।’ আমাদেরকে হ্যান্ডস আপ বলে উপরে নিয়ে যেতে লাগল। আরেক গ্রুপ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাদের পরিবারবর্গকে উপর থেকে নীচে নামাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সবাইকে নীচে আনল। আমার ডানদিকে ছিলেন মন্ত্রী, পাশেই তার ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, তার কোলে মন্ত্রীর নাতি সুকান্ত বাবু ছিল। বামদিকে পরিবারের অপরাপর সদস্যও পিছনে আমাদের শিল্পীদের অপরাপর সদস্যরা ছিলেন।
হঠাৎ ব্রাশ ফায়ার শুরু হল। প্রথমেই শিশু সুকান্ত বাবুর খুলি উড়ে গেল। দেখলাম তার মগজ মাটিতে পড়ে তখনও কাঁপছে। হঠাৎ মন্ত্রী তার পাশের টি টেবিলে উপুর হয়ে পড়লেন। তার পিঠ থেকে রক্ত ঝরেছিল। ঘাতকরা সবাই কালো পোশাক। যে লোকটা ব্রাশ ফায়ার করছে- সে তখনও হাসছে। একটা ম্যাগাজিন ফুরিয়ে গেলে তাকে আরেকটা নতুন আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হচ্ছে। সেটি দিয়েই সে আবার ব্রাশ ফায়ার করছে। আমি পড়ে গেলাম সেরনিয়াবাতের শরীরের নীচে। স্পস্ট শুনতে পেলাম সেরনিয়াবাত সাহেব তখন সুরা ইয়াছিন পরছেন। আবার ব্রাশফায়ার শুরু হল- সেরনিয়াবাত সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ের কথা মনে হলো। আমার খুব জলতেস্টা পেলো। তখনও সেরনিয়াবাত সাহেবের শরীরর থেকে রক্ত ধরছে। মনে হল জল না পেলে হয়তো এই রক্ত পান করেই বেচে থাকতে হবে। ঘাতকরা এক সময়ে চলে গেলে- সাহান আরা বেগম বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করতে বলেন-কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা- রক্তের স্রোত-আর মৃত্যুযন্ত্রনায় কাতরতা ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই। আমার মনে হলে যেকোন ভাবেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। পিছনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। মাত্র তিনফুট দূরে বাইরে যেতে মনে হলো অনন্তকাল। অবশেষে টেনে হিঁচড়ে বাইরে গিয়ে ড্রেনের জল খেতে গিয়ে দেখি সেখানেও রক্তের স্রোত। গড়াগড়ি দিয়ে খোলা জায়গায় আসার চেষ্টা করলাম, মুখ হা করে রইলাম দু এক ফোটা যদি বৃস্টি পরে। এমন সময় পুলিশের একটি দল বাড়ি ঘিরে রেখে মন্ত্রী কোথায় জানতে চাইলো আমি দেখিয়ে দিলাম। কয়েকটি গাড়িতে তাদের আহতদের নিয়ে যেতে দেখলাম। একসময়ে দেখলাম হাসনাত ভাই তার আহত স্ত্রীকে গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছেন। চিৎকার করলাম বাঁচার আকুতি নিয়ে। দুই পুলিশ ও আমার বন্ধু মুকুল দাস সহ গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেল পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেখানে সার্জারি ওয়ার্ডে আহতের চিকিৎসা চলল। আহতদের মধ্যে আমি ছাড়াও ছিলাম জিল্লুর রহমান, রফিকুল ইসলাম রফিক, দিলীপ মন্ডল. সৈয়দ গোলাম মাহামুদ। এখানে একদিন পরে আমরা জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, ক্রিডেন্স প্রতিষ্ঠাতা আবদুর নইম খান রিন্টুকে হত্যা করা হয়েছে তাও শুনলাম কয়েকদিন পরে।। এখানে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা শেষে বরিশালে ফিরে যাই। প্রায় একবছর বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। পরে প্রথমে সদর হাসপাতালে ও পরে মেডিকেলে গিয়ে আরো দুইটি অপারেশন করি। শরীর থেকে দশটি বুলেট বের হলেও এখনও রয়ে যায় একটি। সেটি আমার শরীরের সাথেই শেষ পর্যন্ত থাকবে।
ললিত দাস জানান আহত হয়ে দীর্ঘ চিকিৎসায় কেউ সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। আত্মীয় স্বজনরা পর্যন্ত আতঙ্কে কেউ খোঁজ নিত না। দীর্ঘদিন ধরে কোন সরকারী সুযোগও দিত না আগস্ট হত্যাকান্ডে আহত হবার কারনে। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই -শুধু একটু ইচ্ছ আমরা যারা আহত শিল্পীরা আছি-তার যদি আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেখা করে আমাদের সুখ দুঃখের কথা বলতে পারতাম।