ভারতবর্ষর স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা সেসময়ে আত্ম নিবেদন করেছিলেন তারা তো আর জানতেন না যে শর্ত সাপেক্ষে দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হবে৷ কাজেই সেসব প্রকৃত স্বাধীনতাকামী নিঃস্বার্থ মানুষগুলোর আত্মত্যাগকে আমরা কোনওভাবেই অস্বীকার করতে পারি না৷ বিশেষ করে মহিলা বিপ্লবীদের কথা স্মরণ করতে হয়৷ সে সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে বেশ কয়েকজন আগুন ঝরানো সাহসিনীদের কথা সর্বাগ্রে উঠে আসে৷
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে মণিকর্ণিকা বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন৷ পরবর্তীকালে তাঁর সাথে ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-এর বিবাহ হয়৷ বিবাহের পর তিনি রানি লক্ষ্মীবাঈ নামে ভূষিত হন৷ গঙ্গাধর রাও-এর মৃত্যুর পর লর্ড ডালহৌসি গঙ্গাধরের উত্তরাধিকার স্বত্ত্ব অস্বীকার করে ঝাঁসি গ্রহণ করতে উদ্যত হন৷ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে লক্ষ্মীবাঈও ঝাঁসি উদ্ধারে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন৷ বীরবালা স্বয়ং তরবারি বর্ম নিয়ে ঘোড়ার পিঠে যোদ্ধাবেশে সজ্জিত হয়ে রণচন্ডীর রূপ নেন৷ ‘মেরি ঝাঁসি দেঙ্গে নেহি’ তাঁর এই হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে ইংরেজ শাসক৷ ভারতমাতার বীর কন্যাসন্তান ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ২৯ বছর বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের গুলির আঘাতে ভারতমাতার কোলে নিদ্রা নেন৷
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন৷ মাস্টারদার নেতৃত্বে প্রীতিলতা ইউরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ করেন। যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা থাকতো ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশের অধিকার নেই’। এখানেই শেষ নয়, ধরা পড়ে প্রীতিলতা ব্রিটিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার থেকে সায়ানাইড খেয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করা শ্রেয় মনে করেছিলেন।
কনকলতা বরুয়ার কথা অনেকে জানলেও তার নাম খুব একটা আলোচিত হয় না। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় এই নারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনিই ভারতের প্রথম নারী শহিদ। বিভিন্ন ব্রিটিশ অফিসে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলার উদ্দেশ্যে কনকলতা একটি ছোট দল নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই ছিল তার শেষযাত্রা। ব্রিটিশ পুলিশের গুলির নিশানা হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তিনি। তবে বুলেটের ভয় দমিয়ে রাখতে পারেনি সেই সময়ের সাহসী নারীদের।
বীণা দাস তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। স্ট্যানলি বেঁচে গেলেও ধরা পড়েন বীণা। তার ৯ বছর কারাদণ্ড হয়। এই বীণাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সীমান্তে যশোর রোডে গড়ে ওঠা একটি অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সারা কলকাতা ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। তারপর সেই ওষুধ তিনি পৌঁছে দিতেন যশোর সীমান্তের নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালে। সেবা করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
সরোজিনী নাইডু নামটি শুনলে দক্ষিণ ভারতীয় বলে মনে হতে পারে। বিয়ের আগে তিনি ছিলেন সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে ‘উইমেন্স ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। তিনিই প্রথম কংগ্রেসের বার্ষিক সভার সভাপতিত্ব করেন। ভারত স্বাধীনতা লাভের পর তিনি আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন।
অরুণা আসফ আলি গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সারির নেত্রী এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম মুখ। ১৯৩২ সালে তিহার জেলে বন্দি থাকাকালে তিনি জেলের ভেতরেই বন্দিদের সঠিক চিকিৎসার দাবি করে অনশন শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় তার দাবি মেনে নিতে।
মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন মেদিনীপুরের এক মহীয়সী বীরাঙ্গনা৷ ১৮ বছর বয়সে বিধবা হলেও দেশের প্রতি তাঁর ছিল নিবিড় ভালোবাসা৷ কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে তাঁকে কয়েকবার কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়৷
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে আগষ্ট আন্দোলনে মেদিনীপুরে এক বিরাট মিছিলের সর্বাগ্রে তিনি জাতীয় পতাকা হাতে নেতৃত্ব দেন৷ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় পুলিশের গুলি লাগা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় পতাকা ভূমিস্থ হতে দেননি৷ অবশেষে পুলিশের আরেকটি গুলির আঘাতে বন্দেমাতরম উচ্চারণের মাধ্যমে ভারতমাতার কোলে লুটিয়ে পড়েন এই বীরাঙ্গনা৷
১৯৩০-১৯৩২ সালে লাবণ্যপ্রভা দেবী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন৷ কন্যা বিপ্লবী শোভারানি দত্তের সহায়তায় ‘আনন্দমঠ’ সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন৷ পাঁচবছর লাবণ্যপ্রভা দত্ত প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী ছিলেন৷
অ্যানি বেসান্ত, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই ইংরেজ নারীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ তিনি কংগ্রেসে যোগদান করে ‘হোমরুল আন্দোলন’ শুরু করেছিলেন৷ এই আন্দোলন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে৷
মাদাম ভিকাজী রোস্তম কামা ছিলেন একমাত্র বিদেশে বিপ্লববাদী নায়িকা৷ ইংল্যান্ডে ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা সম্পাদন করেন৷
হেমপ্রভা মজুমদার ১৯২১ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন৷ তাঁর স্বামী বসন্তকুমার কুমিল্লা জেলার যুগান্তর পার্টি সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন৷ বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করে। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা ভগিনী সরোজিনী দেবী বরিশালে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করেন। যুগান্তর দলের যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের দিদি বিনোদিনী দেবী ও অনুশীলন সমিতির জীবনতারা হালদারের মা রাধারানি দেবী সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানান। বাঙালি বীরাঙ্গনারা কখনও বিপ্লবীদের গোপনে গৃহে আশ্রয় দিয়ে, কখনও গোপনে বিপ্লবীদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, কখনও বিপ্লবীদের অস্ত্র গোপনে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে, কখনও বা পুলিশকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবীদের পালাতে সাহায্য করে পরোক্ষভাবে বৈপ্লবিক কাজে অংশ গ্রহণ করেন । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সমাজের উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত পরিবারগুলির নারীরা একযোগে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমদিকে নারীরা প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী কাজে যোগ না দিয়ে তারা বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়ে, অস্ত্র সরবরাহ করে, গোপন স্থানে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে, পুলিশকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবীদের পালাতে সাহায্য করে পরোক্ষভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বিপ্লবীরা যখন দেশমাতার মুক্তির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন তখন বহু নারী নিজেদের টাকা-পয়সা, সোনার গহনা প্রভৃতি দিয়ে পরোক্ষভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলনে সহায়তা করেন। পরবর্তীকালে নারীরা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সশস্ত্র বিপ্লবে বাঙালি নারীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার পুলিশি অত্যাচার, গ্রেপ্তার, নির্বাসন প্রভৃতি নির্যাতন চালাতে থাকলেও নারীদের আন্দোলন থেমে থাকে নি। হাওড়া জেলার বালির সূর্যকান্ত ব্যানার্জীর বিধবা কন্যা ননীবালা দেবী ভারত-জার্মান বিপ্লবী ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। তিনি পালাতে গিয়ে সুদুর পেশোয়ারে ধরা পড়েন। ভারত-জার্মান বিপ্লবী ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে সিন্ধুবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিপ্লবীরা রডা কোম্পানির পিস্তল লুঠ করেন। বিপ্লবীদের লুঠ করা পিস্তলগুলি সংরক্ষণের অপরাধে বীরভূমের নলহাটির দুকড়িবালা দেবী, ঢাকার বগলাসুন্দরী দেবী ও বিন্দুবাসিনী দেবী এবং বরিশালের দুর্গামণি পাইন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও পিস্তল সংরক্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন। ভগিনী নিবেদিতা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত থেকে বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেন। তিনি বাংলার গুপ্ত সমিতি, অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ।
বাংলার নারীরা ব্রিটিশ-বিরোধী বৈপ্লবিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু-ভবেই অংশ গ্রহণ করেছেন। প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন নারী বৈপ্লবিক কার্যকলাপে যেরকম দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল৷
ভাগ হয়ে গেল বসতবাটি, ভাগ হয়ে গেল কাঁদা হাসা এরই কি নাম স্বাধীনতা না সমঝোতা ?
সেই প্রশ্নর উত্তর খুঁজুক জিজ্ঞাসু প্রজন্ম৷
আমি শুধু রবি ঠাকুরের কয়েকটি লাইন স্মরণ করেই আজকের লেখা শেষ করলাম৷
“আমি নারী বলে আমাকে ভয় করো না? বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন৷“ – রবীন্দ্রনাথ