রাজা ত্রয়োদশ আলফানসোকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ১৯৩১ সালে গণতন্ত্র স্থাপিত হল শিল্প ঐতিহ্যময় দেশ স্পেনে। এই সময় দেশের মানুষের রুচি বদলানোর জন্য স্পেনের ছাত্র কংগ্রেস নানা রকম বৈঠক ডাকতে শুরু করে এবং নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে থাকে একের পর এক। এই ভাবে কিছু দিন চলার পর যখন প্রাকৃতিক নিয়মেই শীত পড়তে লাগল, তখন তারা ঠিক করল স্প্যানিশের প্রসিদ্ধ নাটকগুলো মাদ্রির বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ করবে। শুধু মঞ্চে নয়, দরকার হলে মাঠে-ময়দানে ম্যারাপ বেঁধে তারা নাটক করবে। নাটক করবে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। আর সেখানে যাতে সকলেই অবাধে প্রবেশ করতে পারেন, তারও ব্যবস্থা করা হবে। এই পরিকল্পনার নাম দেওয়া হল— না বারাকা।
স্পেনের শিক্ষামন্ত্রী এবং দেশের জনপ্রিয় কবি, সুরকার ও নাট্যকার ‘ফাদরিকো গারথিয়া লারকা’র নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সক্রিয় ভূমিকার জন্য এটা আরও বাড়তি মাত্রা পেয়ে গেল। সরকারি সাহায্যও আসতে লাগল সব রকম ভাবে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অত্যন্ত সুন্দর ও সঠিক নিয়মে তরতর করে এগিয়ে যেতে লাগল সেই সাংস্কৃতিক-যজ্ঞ।
এই প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করতে শুধু কবি, লেখক, শিল্পী, নাট্যকর্মী, সংগীতশিল্পী বা সরকারই নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এল দেশের তরুণ ছাত্রসমাজও। ফলে এটা আর মাদ্রির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রইল না। ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে।
অনেকেই আবার ঘুরে ঘুরে আধুনিক ও ক্লাসিক নাটকগুলো মঞ্চস্থ করতে লাগল নিয়মিত। তার ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বেশ কিছু দল ভ্রাম্যমান নাট্যদলে পরিণত হল। সেই দলগুলোকে আরও উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হল লাক্সারি বাস এবং প্রত্যেক সদস্যের জন্য বরাদ্দ করা হল মাসিক ভাতা।
এই সময়ে তাদের জনপ্রিয়তা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, অনুষ্ঠানের সময় তিল ধারণের জায়গা পাওয়া না। মুগ্ধ দর্শক কেবল তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতেন মঞ্চের দিকে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে ‘লা বারাকা’ স্পেনের শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটা অভূতপূর্ব বিপ্লবের ঝড় বয়ে এনেছিল।
এত জনপ্রিয় হওয়া সত্বেও লা বারাকাকে কিন্তু টিকিয়ে রাখা গেল না। কারণ ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে ফ্রন্ট সরকার খানিকটা আকস্মিক ভাবেই বিপুল ভোটে জিতে গেল। ফলে গণতন্ত্র আরও শক্ত ও মজবুত হয়ে উঠল।
এই রকম পরিস্থিতিতে প্রগতিবাদীরা যখন অন্য রকম একটা কিছুর আশঙ্কা করছে, ঠিক তখনই জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে কিছু সৈন্য হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করল। সেই সব সৈনিকের পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাথলিক পাদ্রি, জমিদার, পুঁজিবাদী এবং অন্যান্য সমাজপতিরা। দেখতে দেখতে দেশের সমস্ত তল্লাট জুড়ে শুরু হল গৃহযুদ্ধ। অরাজকতা। লুঠপাট। তখন কে মরে কে থাকে কোনও ঠিক নেই।
এই বছরেরই জুলাই মাসে এ রকম ভয়াবহ অবস্থা যখন একেবারে তুঙ্গে, সে সময় একদিন লা বারাকা’র হোতা, স্পেনের সেই শিক্ষামন্ত্রী, যিনি আবার দেশের জনপ্রিয় কবি, সুরকার ও নাট্যকারও, সেই ‘ফাদরিকো গারথিয়া লারকা বেড়াতে এলেন এক বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু তাঁকে ধরার জন্য যে ফ্রাঙ্কোর লোকেরা আগে থেকেই ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছিল কে জানে! তারা লারকাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল মানে কোনও থানা কোর্ট-কাছারি নয়, বিচার-টিচার নয়, সোজা পুরে দিল জেলখানায়। তার পর সেখান থেকে সরাসরি চালান করে দিল সেই ঐতিহাসিক কবরখানায়। যেখানে কিছু দিন আগেই, তাঁর ভগ্নিপতি, গ্রানাডার ভূতপূর্ব সোস্যালিস্ট পার্টির মেয়র নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিলেন ফ্রাঙ্কোর লোকেদের হাতে।
তাঁকে শুধু মেরে ফেলেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, সেই মৃতদেহের পায়ে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ঘুরিয়েছিল গোটা এলাকা।
লারকাকেও দাঁড় করানো হল সেখানে। কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়া মাত্র চতুর্দিক থেকে ক্ষিপ্ত সৈন্যের দল মুহূর্তে ছুটে এসে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অকথ্য ভাবে আঘাত করতে লাগল তাঁকে। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। পড়ামাত্র শিলাবৃষ্টির মতো ঝাঁকঝাঁক বুলেট তাঁর দেহ একেবারে ঝাঁঝরা করে দিল।
যখন দেখল দেহটা একেবারে ছিন্নভিন্ন, তখন গুলি থামল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তাঁর নাম যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কখনও জানতে না পারে, সে জন্য ফ্রাঙ্কো সরকার তাঁর সমস্ত লেখাজোখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। বলা হল, কারও বাড়িতে লারকার লেখা কোনও বই কিংবা তাঁর কোনও লেখার কোনও অংশও যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে তাকেও এই ভাবে হত্যা করা হবে। এর পাশাপাশি আচমকা হানা দেওয়া শুরু হল, তাঁর বই যাঁরা বের করেছেন সেই সব প্রকাশকদের দফতর এবং মজুদখানাতেও। খোঁজা শুরু হল বিভিন্ন পাঠাগার এবং এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বইগুলোও। যেখানে যে ক’টা পাওয়া গেল, তা গ্রানাডার প্রকাশ্য রাজপথে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হল।
এত কিছুর পরেও কিন্তু লারকার নাম মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা গেল না। কমল না তাঁর বিন্দুমাত্র জনপ্রিয়তাও। বরং বাড়ল। যদিও পরে কেউ কেউ প্রচার করার চেষ্টা করেছিলেন যে,
এই নির্মম হত্যাই পাঠকের মনকে তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল, ফলে পাঠক তাঁর লেখার মান বিচার করে নয়, তাঁর প্রতি করুণাবশতই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করত।
এখন অবশ্য অনেকেই স্বীকার করতে শুরু করেছেন যে, সুরস্রষ্টা ও চিত্রশিল্পী লারকা’র লোকগাথা, জিপসি কাহিনি, স্পেনের চিরাচরিত রোমান্স ও লোকসংগীত সৃষ্টির নিজস্ব শৈল্পিক গুণের জন্যই, এক সময়ে সরকারের তরফ থেকে তাঁর নাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অপচেষ্টা হলেও, তা সফল হয়নি। বরং যত দিন যাচ্ছে, দিনকে দিন তিনি ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। এর পিছনে অন্য আর কোনও কারণ নেই।