নাটোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়, বৃহত্তর হালতিবিলের পাশে অবস্থিত। রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউনিয়নের বীরকুৎসা জমিদার বাড়িটি এলাকায় “হাজার দুয়ারী জমিদারবাড়ি” হিসেবে পরিচিত।
যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বাড়িটি। বেদখল হয়ে যাচ্ছে এখানকার মূল্যবান সম্পদ। এলাকাবাসীরা মনে করেন, দ্রুত জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এর কোন চিহ্ন হয়তো থাকবে না। তখন বাড়িটি মানুষের মনে শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে।
গবেষক ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে জমিদারি প্রথা চালু থাকাকালে তৎকালীন বাগমারার বীরকুৎসা ছিল একটি পরগনা। এই পরগনার জমিদার ছিলেন ভারতের কাশী থেকে আসা বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ওরফে বিরু বাবু।
আর গোপাল ধাম ছিলেন পাশ্ববর্তী নওগাঁ জেরার আত্রাই উপজেলার আমরুল ডিহির বিশাল রাজা। প্রভাতী বালা নামে তার এক রুপবতী কন্যা ছিল। রাজা গোপাল ধাম জামাতা বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ও কন্যা প্রভাতী বালার নামে বীরকুৎসা পরগনাটি লিখে দেন।
প্রভাতী বালা ছিলেন রুচিশীল এবং খুবই শৌখিন মনের মানুষ। তার পছন্দ অনুযায়ী বিরু বাবু বীরকুৎসায় গড়ে তোলেন একটি নয়নাভিরাম অট্টালিকা। এর মেঝে শ্বেত পাথরে আবৃত করা হয়েছিল। অট্টালিকার জন্য হাজারটি দুয়ার তৈরি করা হয়েছিল সে সময়। এ থেকেই অট্টালিকার নাম হয় হাজারদুয়ারী জমিদার বাড়ি।
হাজারদুয়ারী জমিদার বাড়ির দরজাগুলো ছিল তিনটি স্তরে সাজানো সেগুন কাঠের কারুকাজ খচিত । প্রথমে কাঠ, তারপর লোহার গ্রিল, এরপরে তা দামি কাঁচে মোড়ানো হয়। রানী প্রভাতী বালা প্রাসাদের সব দরজা, মেঝে, আসবাবপত্র প্রতিদিন চাকর-চাকরানীদের দিয়ে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে-তকতকে করে। রাখতেন।
বিরু বাবুর দুই ভাই দূর্গা বাবু ও রমা বাবু এই প্রাসাদেই থাকতেন।প্রাসাদের সামনে বাহারি ফুলের বাগান ছিল। সেই বাগানে বিকেলে জমিদার পরিবার সময় কাটাতেন।প্রাসাদের পশ্চিম দিকে খিড়কি দরজা পার হয়ে সান বাঁধানো একটি বিরাট পুকুর রয়েছে।
এই পুকুরে শুধুমাত্র জমিদার পরিবারই স্নান করতেন। প্রাসাদের ভেতরের এক পাশে ছিল জলসা ঘর। সেখানে বসতো গানের আসর। কলকাতা থেকে ভোলানাথ অপেরা এসে গান বাজনা করতো। পূর্ব দিকের দেউড়ির দুই পাশে ছয় জন করে বারো জন বরকন্দাজ থাকত।
দেউড়ির পাশে ছিল মালখানা। এর কিছু দূরে ছিল মহাফেজখানা।দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে রেন্ট রোল অ্যাক্টের বলে জমিদারি প্রথা উঠে গেলে বিশাল অট্টালিকা, বিপুল সম্পদ ও জমিজমা ফেলে বিরু বাবু স্বপরিবারে ভারত চলে যান।
দামি শ্বেত পাথর, উন্নত কাঠের দরজা, গ্রিল এবং কাঁচ প্রায় সবই চুরি হয়ে গেছে। এখনো চুরি হচ্ছে। প্রাসাদের পূর্বের দেউড়ি পার হয়ে সামনে আরেকটি বড় পুকুর আছে, সেখানে গোসল করত আমলা, পেয়াদা ও বরকন্দাজরা।
এই পুকুরটিও আজ বেদখল হয়ে গেছে। বকুলতলার পাশে খাজনা আদায়ের ঘর ছিল। যা এখন বীরকুৎসা তহসিল অফিস নামে পরিচিত। এর পাশের পূজা মন্ডপটিতে বসানো হয়েছে পোস্ট অফিস। ভবনের ভেতরে অনেক কক্ষ বর্তমানে ফাঁকা পড়ে আছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব কক্ষে এখন সন্ধ্যার পর নেশার আড্ডা বসে, আর দিনের বেলায় বসে জুয়ার আসর। জমিদার বীরু বাবুর দাদা অবিনাশের নাম অনুসারে প্রাসাদের কাছে ১৯১৭ সালে বীরকৎসা অবিনাশ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
হাজার দুয়ারীর চার পাশসহ বিভিন্ন জায়গায় জমিদারদের ফেলে যাওয়া প্রায় ৩শ’বিঘা জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ভাবে দখল করে রেখেছে। বাঁকি জমিগুলো যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে।
অযত্ন আর অবহেলায় পরিত্যক্ত এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি নিজের অস্তিত্বকে এখনো জানান দিচ্ছে তাই সরকারিভাবে বেদখলকৃত সম্পত্তি উদ্ধার করে, প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটি সংস্কার ও পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি, স্থানীয় সচেতন মহলের।