রাশিয়ার ওরিওলে ১৮১৮ সালের ৯ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সব সময় মায়ের রুক্ষ মেজাজ আর বাবার সব সময় আত্মসুখে ডুবে থাকার জন্য তিনি কখনও তাঁদের কাছে খুব একটা ঘেঁষতে পারেননি। বঞ্চিত থেকেছেন তাঁদের স্নেহ-মায়া-ভালবাসা এবং তাদের দেখভাল থেকে। তাই বঞ্চিত লোকজনের জন্য তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠত। তাঁদের কথা ভেবে একা একা কাঁদতেন।
ফলে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনোর পরে তিনি যখন স্বরাষ্ট্র দপ্তরে কর্মজীবন শুরু করলেন, তখন ভূমিদাসদের মর্মান্তিক জীবনযাত্রা তাঁকে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাল। তিনি আর ঠিক থাকতে পারলেন না। এই প্রথার বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট লিখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করলেন। আর তাতেই সরকারের টনক নড়ে ওঠল। সামান্য একজন চাকুরীজীবী এ সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন! এ সব জানাজানি হলে তো সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রকাশ পাবে! বিরোধী দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাই নেতামন্ত্রীরা তাঁর ওপরে অত্যন্ত বিরূপ হলেন। এবং তাঁরাই নানান কলকাঠি নেড়ে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সামান্য অজুহাতে তাঁকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে দিল।
একেবারে কাঠ বেকার হয়ে যাওয়ার পরে তিনি একটু-আধটু লেখালিখি করছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে আর ক’টাকাই বা আসে! সংসার চলে না। ও দিকে মায়ের মতে বিয়ে না করার জন্য বাড়ি থেকে পাঠানো তাঁর মাসোহারাও বন্ধ। দিন যেন কিছুতেই কাটছে চায় না। শুরু হল ভীষণ অর্থ কষ্ট। কিন্তু এই কষ্ট দীর্ঘ দিন স্থায়ী হল না। কিছু দিনের মধ্যেই মা মারা গেলেন। আর মা মারা যেতেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হলেন তিনি।
এত কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতে হঠাৎ এত স্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ পেয়েও তিনি কিন্তু সেই জোয়ারে গা ভাসালেন না। সরকার বিরুদ্ধে থাকলেও, ভূমিদাসদের হয়ে প্রাণপণ লড়াই শুরু করলেন তিনি। মিটিং-মিছিল, জমায়েত, ধর্না, আইন অমান্য— কিছুই বাদ দিলেন না। সঙ্গে পেয়ে গেলেন বেশ কিছু শুভাকাঙ্খীও। সবাইকে নিয়ে তিনি আরও বড় আকারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবং অবশেষে গ্লানিকর জীবন থেকে ভূমিদাসদের চিরতরে, একেবারে আইনানুগ ভাবে, মুক্তির সমস্ত ব্যবস্থা একদম পাকাপাকি ভাবে করে ফেললেন তিনি। ভূমিদাসরা মুক্তি পেল। এবং শুধুমাত্র এই কাজের জন্যই ভূমিদাসদের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন স্বয়ং ঈশ্বর।
এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাটাকে ওই দেশের সরকার একদম ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের মনে হয়েছে এটা একটা চূড়ান্ত অপমান। তাদের পরাজয়। তাই ওই সরকারের নির্দেশে উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা জাল বিছিয়ে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিল। খুঁজছিল সুযোগ। এক সময় সেই সুযোগও এসে গেল তাদের হাতে।
মোগলের মৃত্যুর পরে যে শ্রদ্ধাঞ্জলি তিনি লিখেছিলেন, তার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দেওয়া হয় অন্তরীণ জীবনের টানা আঠারো মাস ধরে একটানা ভয়াবহ লাঞ্ছনা। তার পর যখন মুক্তি পান, তিনি প্রথমেই ছদ্মনামে একটি বই প্রকাশ করেন এবং দীর্ঘ তিরিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছোটগল্প, উপন্যাস এবং নাটক লিখে ওই দেশে ক্লাসিক যুগের পরে রুশ সাহিত্যে যে সুবর্ণ যুগ শুরু হয়, তিনি তার সূচনা করে দেন। একের পর এক লেখেন— ‘আ স্পোর্টসম্যানস স্কেচেস’, ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’, ‘আ মান্থ ইন দ্যা কান্ট্রি’-র মতো এক-একটি বই।
শুধু লেখালিখি নয়, যাঁরা দুঃস্থ সাহিত্যিক, তাঁদেরও নানা ভাবে সাহায্য করেছেন তিনি। রুশ ভাষায় প্রকাশের জন্য পৃথিবীখ্যাত নমস্য লেখক স্বয়ং মোপাসাঁ এবং জোলাও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
তিনি ছিলেন খোলামেলা মনের এবং সমসাময়িক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। ফলে গোটা ইউরোপের সাহিত্যিক সমাজে তাঁর ছিল বিশেষ সমাদর। তিনি আর কেউ নন, ১৮৮৩ সালের তেশরা সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের ব্যুগিভেলে মাত্র চৌষট্টি বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া — ইভান সের্গেইয়েভিচ তুর্গ্যেনেভ। যিনি শুধুমাত্র ইভান তুর্গেনেভ নামেই বেশি পরিচিত।