সাত সকালে আচমকা মাথায় চাঁটি। আমার সাদা চুলের গার্ড-লাইন ঘেরা চকচকে টাকের সেন্টারে কেউ যেন চটাং করে মারল। প্রথমটা বুঝতে পারিনি। রিফ্লেক্সে দ্রুত ডান হাত উঠে গেল মসৃণ চাঁদিতে। শক্ত কী একটা জিনিষ আমার নরম আঙুলে ঠেকল। তেমন শক্ত নয়, ভারীও নয়। ওজনদার কিছু হলে আমার পঁচিশ বছরের তেল চুকচুকে টাকে লাল রক্তের জম্পেশ আলপনা ফুটত। আঘাত রক্তপাত জাতীয় কিছু হল না। বিপদ গন্ধে আমার কোঁচকানো চোখদুটো অচিরে স্বাভাবিক হয়ে এল। ভাবলাম, হয়ত হাওয়ার ঝাপটায় লক্ষভ্রষ্ট কোন জিনিষ আমার মাথায় আলতো আঘাত হেনছে। জিনিসটা আমার আঙুলের ফাঁক গলে বেলমুণ্ড মাথায় ঠোক্কর খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল। চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখে কিছু না-ভেবেই বস্তুটা ঝপ করে কুড়িয়ে নিলাম। প্লাস্টিকের দুই-বাই-দুই ইঞ্চির ছোট্ট একটা প্যাকেট। তারমধ্যে ঢিলের সাথে সযত্নে মোড়ানো একটা চিরকুট। মাথা হাত ঘুরে বস্তুটা আমার হেপাজতে। হাফ পাঞ্জাবীর বুক পকেটে আপাতত বন্দী পাখি।
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পরের দ্রব্য পকেটে ঢুকালাম। ঠিক হল কি, খানিক দোনোমনা। একটু ভেবে যুক্তি সাজালাম। ওটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে পকেটস্ত করবার যুক্তি। আমার মাথায় ওটা ঠকাস করে পড়ল কেন? বেশ করেছি জিনিষটা পকেটে ঢুকিয়ে। আমার পকেটে তো এসময় ওটার ঢুকবার কথাই ছিল না। এসময় আমি নিজের ঘরে। হারমোনিয়ামে রিড টিপে গলা সাধি। ছাত্র-ছাত্রীরা আসবার আগে গলাটা উপর-নিচ খেলিয়ে নিই। সা-থেকে আস্তে আস্তে দম ধরে রেখে উপরে উঠছিল গলা। নি-তে এসে দাঁড়ালাম। কয়েক বার গলা ছেড়ে দম রেখে নি-নি করছিলাম। ঠিক তখনই….
বিমলা হন্ত দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ঐ উঁচু নোটে গলা তুলে বলল, ‘ব্যাসন, ব্যাসন লাগবে।’ তীক্ষ্ণ উঁচু স্বর। মুডটা চটকে গেল। রেওয়াজ বন্ধ করে বেজার মুখে আমিও চেঁচালাম, ‘সাত সকালে ব্যাসনের হবেটা কি? কালকেই তো ফর্দ মিলিয়ে চার ব্যগ বাজার আনলাম।’ বিরক্তিতে ঠাসা আমার মুখ। আমার দিকে তাকিয়ে টাকে হাত বুলিয়ে আলতো চাঁটি মারল বিমলা। নরম গলায় বলল, ‘না গো, তোমার দোষ নয়। রাজু আসবে বলেছে তো! ও–তো জানো, চা-য়ের সাথে বেগুনি খেতে খুব ভালোবাসে।’
শালা বাবু, তাও আবার একমাত্র শ্যালক! তিনি বেগুনি খাবেন। অতএব বানাবার উপকরণ ব্যাসন আনতেই হবে।
হারমনিয়ামের রিড টেপাটেপি বন্ধ করে চটপট চপ্পল গলালাম। পাঁচ মিনিট দ্রুত লয়ে হাঁটা। পাশের পাড়ায় রঘুনাথের দোকান। এ পাড়ায় গিজগিজ করছে আমার ছাত্র ছাত্রী। রঘুনাথের দোকানের উপরেই অসিমারা থাকে। অসিমা আমার প্রিয় ছাত্রী। একটু ভিতু ভিতু। নিরীহ ধরন, কিন্তু সিনসিয়ার। ক্লাস ফাইভ থেকে মেয়েটা গান শিখছে। ওর বাবা-মাকেও চিনি। করপোরেশনে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী ওর বাবা। সেকেলে ধরনের লোক। ওর মা সুন্দরী মহিলা, গান বাজনা ভালবাসেন।
রঘুনাথের দোকানের কয়েকটা বাড়ি পর একটা একতলা ভাঙা বাড়ি। ওটা রমেশদের। রমেশ আমার তবলার ছাত্র। ওর পাশের বাড়ির মেয়েটিও, তার বিয়ের আগে আমার কাছে গান শিখতো। এ অঞ্চলের সব বাড়িই আমার খুব চেনা। লোকজন খাতির করে আমাকে। খাতিরের লোক দেখতে পেয়ে অনেক খদ্দের উপেক্ষা করে রঘুনাথ আমার দিকে তাকাল। চোখ নাচিয়ে ঘ্যার ঘ্যারে গলায় বলল, ‘মাস্টারজি, কি লাগবে বলুন।’
‘ব্যাসন, আধা কিলো,’ উত্তরটা দেওয়ার ঠিক পরেই ওই বস্তুটা উড়ে এসে আমার টাকে আছড়ে পড়েছিল। টক করে একটা আওয়াজ। ভালোই একটা খোঁচা লাগল মাথায়। খোঁচার কথা বাড়িতে বলিনি। গরম গরম বেগুনি আর চা খেয়ে ফাঁকা ঘরে টাকে খোঁচা মারা বস্তুটা বের করলাম। অন্যের জিনিষ! কেমন যেন কাঁপা হাতে চিরকুটটা খুললাম।
আমার বুকে ধরাস ধরাস। চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা। ঝক ঝকে হাতের লেখায় ‘অসিমা আমার অসিমা’। অ্যাঁ, প্রেমপত্র! তাও আবার আমার ছাত্রীর! আমার মেয়ের চাইতেও ছোট একরত্তি বালিকার উদ্দেশে লেখা।
আজকাল প্রেমপত্র কেউ লেখে নাকি! এসএমএস, ই-মেল, মোবাইল, ফেসবুক। হাজার একটা অ্যাপ। সে পথে না গিয়ে সাবেকি কায়দার প্রেমপত্র! এতো আমাদের উঠতি বয়সে হত, আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের ব্যাপার।
অন্যের প্রেমপত্র কি পড়বো? গল্পের একটা গন্ধ নাকে আসছে যেন!। ভাবলাম, পড়বো নাই বা কেন? গল্পটা তো উড়ে এসে আমার টাকে নিজেই হামলে পড়ল। হামলে পড়ল বলে চিরকুটটা পেলাম এবং দোনামোনা করতে করতে খুলেই ফেললাম।
পড়লাম। এক বার, দুবার, তিনবার। সুন্দর হাতের লেখা, গোটা গোটা অক্ষর, ‘অসিমা আমার অসিমা/ কবসে সাকসাত নেহি হুয়া।/মেরা সুখা-দুখা দিন,/আউর গম ভরা দিল।/ কবে দেখবো মুরত তুমার/ আউর বুঝবে পিয়াস আমার।/দিল খুলকে ভ্যেলেন্টাইন বানাও/আউর টাইম প্লেস জলদি বাতাও/। ইতি রাজু চিৎলাঙ্গিয়া।’
ফুট নোটে লিখেছে, ‘তুমি মাস্টারজিকে বলেছো আমার কথা?’
আমি গুম হয়ে বসে থাকলাম। ছাত্র ছাত্রী এখনও কেউ আসেনি। একটু ফাঁকিবাজি করবো আজকের ক্লাসে। ওদের শুধু তান লিখতে দেবো আমার খাতা থেকে। আট মাত্রার চারটে তান। আর আমি পড়ে পাওয়া গল্পের বাকিটা খুঁজবো। আমার টাকে চাঁটি মারল আর আমি ছেড়ে দেবো? বিমলা ঘরে ঢুকতেই আমার ভাবনার সুতো ভোঁ-কাট্টা।
-কি ব্যাপার! গান থামিয়ে কি ভাবছো?’ বিমলার প্রশ্নে অতি কৌতূহল।
আমি হাতের চিরকুটটা লুকিয়ে একটা কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়লাম বিমলার দিকে তাকিয়ে। অসিমার মা-র সাথে ইদানীং মহিলা সমিতির মিটিঙে প্রায়ই দেখা হয় বিমলার। কিছু অতিরিক্ত খবর থাকতে পারে বিমলার কাছে ভেবে দুম করে বলে ফেললাম, ‘অসিমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। গান-পড়াশুনা সবেতেই ভালো মেয়েটা। আচ্ছা, অসিমা কি প্রেম করে?’
বেমক্কা প্রশ্ন। বিমলা থতমত খেয়ে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, ‘করতেই পারে। বাবা-মা যা চাপে রাখে মেয়েটাকে!’
-চাপেই তো রাখা উচিত। এখন পরিক্ষার সময়।
-তাবলে সব সময় শুধু পড়া আর গান! জানো, পড়াশুনার ক্ষতি হবে বলে একমাস আগেই ওর বাবা মোবাইল কেড়ে নিয়েছ। ইন্টারনেট কানেকশনও দু-মাস বন্ধ। মেয়েটার একেবারে দমবন্ধ অবস্থা!’
বুঝলাম, অসিমার জীবনে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আর এ জন্যই প্রেমিক চিৎলাঙ্গিয়া ওর বেলকনিতে চিঠি ছুঁড়েছে। একদম পুরানো বস্তাপচা কাহিনী। জোলো গল্প। কিন্তু জোলো হলে কি হবে, ব্যাপারটা তো সত্যি! অসিমাকে তো বে-লাইনে যেতে দিতে পারিনা। ওকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসি। আমার মেয়ের মতই অসিমার সুরেলা কণ্ঠ। আমার মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, মোটা মাইনের চাকরি জুটিয়ে গান-বাজনা ছেড়ে দিল। আসিমাও কেরিয়ার গড়তে গান-বাজনা ছেড়ে দিক, আমি চাইনা। আমি চাই, ও যেন কেরিয়ার বিয়ে এসবের পরও গানবাজনা চালিয়ে যায়।’
-তুমি চাইলেই তো আর হবে না। ওদের রক্ষণশীল পরিবার। ইস্কনে দীক্ষা নিয়েছে। ওরা যা চাইবে, তাই হবে। তুমি একদম মাথা গলাবে না’। খুব চিন্তা করে বিজ্ঞের মত ধীরে ধীরে নিজের মত জানাল বিমলা।
কিন্তু আমি বিমলার মত অত প্র্যাক্টিকাল ভাবনা চিন্তা করতে পারিনা। মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘আমার ছাত্রীর ভালোমন্দ দেখবো না? একটা মেয়ে প্রেমে ফেঁসে গিয়ে বিয়ে করে লাইফ বরবাদ করবে! গান বাজনা ছেড়ে দেবে? মাড়োয়াড়ি বাড়িতে নিরামিষ খেয়ে জীবন কাটাবে?
-করুক গে, মরুক গে। তোমার তাতে কি? পরের ব্যপারে একদম নাক গলাবে না।’ বিমলা ঝাঁজিয়ে উঠে পাশের ঘরে গেল টিভিতে শাড়ি-সো দেখতে।
- * *
উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম দুটো পরীক্ষা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সামনের বুধবার আবার অঙ্ক পরীক্ষা। আজ বৃহস্পতি, সন্ধ্যা বেলা আমাকে লক্ষ্মী পুজার ফুল-মিষ্টি-বেলপাতা আনতে বাজারে যেতে হল। বাজারের বাইরে নেতাজী কেবিনের সামনে পথ আটকানো ভিড়। ইদানীং ফাস্ট ফুডে ওরা শহরের এক নম্বর। দোকানের পাশে ঢাউস কড়াই পেতে চিকেন পকোরা ভাজছে উড়িয়া যুবক। কড়াই ঘিরে হামলে পড়েছে একগাদা ছেলে-মেয়ে। কাপ্রি, টিশার্ট, জিন্স, স্লিভলেস, হাফপ্যান্ট—ফ্যাশন প্যারেড।
আমার ফতুয়া-পাজামা, খাটো মাথা চোখে পড়েনা সবার। আমি দেখতে পাই অনেককে। যেমন, এক কোণে অসিমা আর নীল জিনস কালো টিশার্ট পড়া লম্বা-চুল যুবক চিকেন পকোরা সাঁটাচ্ছে। ভালো করে দেখলাম যুবককে। ওটাই কি চিৎলাঙ্গিয়া? ভাবতে ভাবতে ফুল-মিষ্টি হাতে বিলম্বিত পদক্ষেপে বাড়ি ফিরলাম।
পরদিন সকালে আসিমা এল আমার বাড়ি। পরীক্ষার চাপে রোগা শরীর আরো কাহিল। ওর পরনে সাদা রঙের নোতুন সালোয়ার কামিজ। পাজামার উপর হাফ পাঞ্জাবি চাপিয়ে আমি প্রাত্যহিক রেওয়াজে ব্যস্ত। ও নিচু হয়ে আমার পা-ছুঁয়ে প্রণাম করল, ‘স্যার দু’টো পরীক্ষাই ভালো হয়েছে।’
আমি উত্তর দিলাম না। ও কার্পেটে বসে। মাথা নিচু। নিশ্চুপ কিন্তু মুখের ভাবে মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চায়। গান থামিয়ে আমি হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, ‘চিকেন পকোরা কেমন খেলে?’
-ও, হ্যাঁ স্যার। কাল বিকেলে খেয়েছিলাম নেতাজী কেবিনে।
-সঙ্গে ওটা কে ছিল?
-সুদীপদা। আপনি চেনেন। ত্রিদিবদার ভাই। ত্রিদিবদা আমার সাথে তবলা বাজাত। আপনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। ত্রিদিবদা চাকরি পেয়ে চেন্নাই চলে গেল। তারপর সুদীপদা এখন সঙ্গত করে। আপনাকে বলেছিলাম স্যার।
-ও, তাহলে চিৎলাঙ্গিয়া কে?
-চি চি চি চি …..
অসিমার ফর্সা মুখ একদম লাল। ঠিকরে আসছে চোখ। সাদা সালোয়ার ঘামে ভিজে উঠেছে। আমার ঘরে ফ্যানের নিচে বসে কথা আটকে অসিমা পুরো বোবা। পাশের ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বিমলার প্রবেশ। অসিমাকে হাত ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। জল টল খাইয়ে অসিমাকে বাড়ি পাঠিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার ঘরে ঢুকল বিমলা। গলা সপ্তমে তুলে বিকট হুঙ্কার, ‘পরের মেয়ে। যদি ওর হার্টে ধাক্কা লাগে? যদি কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়? স্ট্রেসের ফলে কত কি ঘটে! ওর কিছু হলে তুমি দায়ী থাকবে কিন্তু, বলে দিলাম’।
আমার মাথা নিচু। রাগ উঠ গেলে বিমলা থামতেই চায় না। বলেই চলেছে বিমলা, ‘এডাল্ট মেয়ে। যার সাথে খুশি মিশবে। প্রেম করবে, বিয়ে করবে। শুধু মেয়ে-মেয়ে বিয়ে না করলেই হল। নিজের মেয়েকেও তাই বলি।’
কথার ভয়ঙ্কর ঝাপটায় আমি নত মস্তক। ভাবনার ঢেউ উঠছে মাথায়। মাঝে মাঝে বুকে কেন যে এত আবেগ উথলে উঠে! সত্যিই বড় বোকার মত কাজ করেছি আমি। তবে ছাত্রীকে ভালবেসে একটু শাসন করতে পারবো না! ছাত্র ছাত্রীদের কত বিপদে সাহায্য করি!
বিমলার সাথে বাক্যালাপ বন্ধ রেখে দিনটা কেটে গেল। পরদিন সকালে আমার ঘরের মেঝে ভর্তি ছাত্রছাত্রী। ভৈরবে কোমল ধা লাগিয়ে সবে মাত্র মহাদেবের ভজন ধরেছি। তখনই সাক্ষাৎ এক মহাদেব তনয়ের আবির্ভাব। মাথা ভর্তি কোঁকরা চুল, ডাগর চোখ। সুদর্শন কার্তিক হাত জোর করে নমস্কার করল। ওর দিকে ঘুরতেই আমার পা-ছুঁয়ে প্রণাম। দু’হাতে এগিয়ে ধরল সন্দেশের এক দশাসই প্যাকেট।
ওর চোখের দিকে তাকালাম, ‘কিছু বলবে?’
-একা বাত করবার সুযোগ মিলবে স্যার?’ যুবকের ভরাট কণ্ঠস্বর।
ওকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলাম। দুকাপ চা আর বিস্কুট রেখে সুপুরুষ যুবকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিমলা রান্না ঘরে চলে গেল। ফাঁকা ঘরে আমার মুখোমুখি সুপুরুষ নায়ক। আরেকবার নমস্কার করে মুখ খুলল, ‘স্যার আমাকে তবলা শেখাবেন? আপনাকে অসিমা কিছু বলে নি?’
-কে অসিমা?’ আমি কিছু না-জানার ভান করলাম।
-আপনার ছাত্রী অসিমা স্যার। আমি ওকে ভালবাসি। শাদীও করবো।’ অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গি, জড়তা বিহীন উচ্চারণ যুবকের।
চা খেতে খেতে আমি বিষম খেলাম। একজনকে বোবায় ধরল। চিঁ চিঁ করতে করতে অক্কা পাবার যোগাড়! আর, আরেক জন! সিনেমার নায়কের মত সব কথা টক টক করে বলে ফেলল। চায়ের কাপে হালকা একটা চুমুক দিয়ে আমি বিস্ময় লুকালাম, ‘তুমি রাজু চিৎলাঙ্গিয়া?’
-হ্যাঁ স্যার।
-তোমার বাবা-মা বিয়েতে রাজী হবেন?’ বড় একটা শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-বাবার কোন আপত্তি নাই। ব্যাবসার ক্ষতি না হোল, তো বাবা রাজী। অসিমার বাবা-মাও মেনে নেবে। আমার মন কা বাত।
-কিসের ব্যবসা তোমাদের?
-ঝাঁটার ব্যবসা স্যার।
-ঝাঁটা?’ আমার চোখ মুখ কপালে ভাঁজ।
যুবক আমার মনের ভাব বুঝে ফেলল। শান্ত মুখে বলল, ‘হাঁ স্যার, ঝাঁটা। ওটাই মেন। জাদা প্রফিট ঝাঁটাতেই আছে।‘
একটু থেমে আব্র বলল, ‘আজকাল ওই ব্যবসাটা আমিই দেখি। একেকটা ঝাঁটায়, আপনারা বলেন ফুলঝাড়ু, ফিফটি পারসেন্ট প্রফিট। বছরে ছ-কোটির টার্ন ওভার। তিন কোটি শুধু আমার প্রফিট।‘
আমি হাঁ-হয়ে শুনছিলাম ব্যবসার অবিশ্বাস্য কাহিনী। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলাম। ঘর জুরে নিস্তব্ধতা। বদ্ধ ঘরে পাখার গরম হাওয়া। মার্চের শুরুতেই বেজায় গরম। স্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে মুখ খুললাম, ‘তোমার ব্যাবসার অবস্থা ভাল। বিয়েতে বাবা রাজী। মেয়ের বাবা-মাও মেনে নেবে। তাহলে বিয়ে করে নাও।’
-সমস্যা একটা আছে স্যার। আমার মাতাজি।
-তোমাদের বিয়েতে মত নেই?
-মত তো নাই স্যার। বলেছে ঐ মেয়েকে ঘরে আনবি তো ঝাড়ু মেরে ভাগাবো।
-তা হলে উপায়? আমার স্বরে উৎকণ্ঠা।
-স্যার, আপনি গুরু। গুরুর আশীর্বাদ মিলবে তো সব বাজীমাত।
-কী বলছ তুমি?
-স্যার, আমার মাতাজি হার্ডকোর বিজনেস লেডী আছে। দিন রাত শুধু পার্টি, খানাপিনা। সব সময় খালি হিসাব, একাউন্টস, শাড়ি, জুয়েলারি, সোনা-চাঁদি। মাথায় একটাই সোচ – প্রফিট, নাফা, লাভ। লটারি খেলে, লোটোতে টাকা লাগায়। হাত খরচের টাকা শেয়ার মার্কেটে খাটায়। সবেতে নেশার মত টাকা ঢালে। আম, আলু, লিচু, বাজরা, গম। বাদ নাই কিছু। লোভ বাড়তে বাড়তে এখন সুদের কারবারেও টাকা ঢালছে’।
একটু থামল চিৎলাঙ্গিয়া। গন্ধ মাখা ধবধবে সাদা রুমালে মুখ মুছল। আস্তে গলা ঝেড়ে আবার শুরু করল, ‘কাজের লোক, ড্রাইভার, সেক্রেটারি সবাইকে খালি গালি পারে মাতাজি। একই লব্জ্ কথায়, ঝাড়ু মারব মুখে।’
আমি ওর কথার অভিমুখ ঘোরাবার চেষ্টা করে বললাম, ‘তোমার মাতাজির কাজে তো টাকা আসছে ঘরে। ভালো কথা তো!’
-ভালো কোথায় স্যার? টাকা দিয়ে টাকা আসে কিন্তু আলো আসেনা। কিছু ভালো হয় না।
-বাবা, তুমি তো সকাল বেলা দর্শন ঝাড়ছো!
-যা বললাম, সহি বাত স্যার।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম, ‘এসব কথা থাক। আমাকে কী করতে হবে বলো।’
-বলছি স্যার। আমার মাতাজির আরেকটা কথা। শুধু আমি জানি।
-বল।’ মন দিয়ে কথা শুনতে সামনে ঝুঁকলাম।
যুবক ধীরে ধীরে বলে চলেছে, ‘মাতাজি খুব সকালে ঠাকুর ঘরে যায়। এক ঘণ্টা গান, পুজা-পাঠ করে। পার্বতীর মাইয়ার ভজন গায়। ভুল তাল, ভুল সুর কিন্তু প্রান ঢেলে গান করে।’
-কী গান?
একবার কেশে গলা পরিস্কার করে নিয়ে রাজু গাইল। সুর বিহীন কণ্ঠ কিন্তু উচ্চারণ পরিস্কার।
‘ঠাট রাজ সি ভুল গয়ি/শঙ্কর মহাদেব তোরে লিয়ে/ অব তন কি সুখ সব ভুল গয়ি/ শিব শঙ্কর তোরে লিয়ে/ সব ছোড় ছাড়কে মাতা/ ম্যায় না কি গলি/ ম্যায় পার্বতী কৈলাশ চলি।
গান গাইতে গাইতে আমার মাতাজির চোখে টপটপ আঁশু ঝরে। ওই মুখ গ্লো করে স্যার। আমি তখন অন্য আলো দেখতে পাই’।
রাজু থামল। আমি নির্বাক। একটু থেমে আগের প্রশ্নটাই করলাম, ‘আমাকে কী করতে হবে তুমি বলো।’
-আপনি ওই ভজনটা অসিমাকে শিখিয়ে দেবেন স্যার। ও জান ঢেলে গাইবে আর আমি তবলায় সঙ্গত করবো।
-তোমাদের বাড়িতে ও গান গাইতে পারবে?
-হ্যাঁ স্যার। ওটাই তো পথ। শঙ্কর মহাদেবকা নাম আর পার্বতীমাই কি গীত।
ওর কথায় ঠোঁটের দু’পাশে হাসি ফুটল আমার। বললাম, ‘পার্বতী সাক্ষাৎ প্রেমের দেবী। ভালবাসার জন্য কত কষ্ট করেছেন। এবার থেকে ভ্যালেন্টাইন ভুলে পার্বতীর গীত গাও।‘
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল যুবক। বলল, ‘ওই ভজনটা অসিমাকে শিখিয়ে দেবেন তো স্যার?’
-আলবাত শিখিয়ে দেব। পার্বতীর ভজন আর মহেশ্বরের গান ও প্রাণ দিয়ে গাইবে। আর তুমিও সঙ্গত করবে। আলো ছড়িয়ে বুকের দরদ দিয়ে অসিমা গাইবে প্রেমের দেবীর গান। কিন্তু…গান শুনবার পর তোমার মা ওকে ঝাড়ু মারবে না তো!
-আলবাত ঝাঁটা মারবে না স্যার। তবে চাঁটা মারতে পারে। আমাকেও মারে স্যার। আমি একটু হাসলাম। উড়ে আসা গল্পের নায়ক, সুদর্শন প্রেমিক যাবার আগে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। আমি ওর মাথায় হাত রেখে মালকোষ রাগে গুণগুণ করলাম। তারপর গলা ছেড়ে গাইলাম, জয় হো পার্বতী মাতা মহেশ্বরী/ শিব পত্নি দুর্গা মাতা। … কৃপা কর হে, কৃপা কর।’
বিমলা ঘরে ঢুকে বলল, ‘এ গানটা আগে শুনিনি তো!’ এখনই বানালাম। বিমলার দিকে তাকিয়ে বললাম।
বিমলাকে প্রণাম করে উড়ে আসা গল্পের নায়ক আজকের প্রস্থান করল।
টাকে হাত বুলাতে বুলাতে সাত সকালে বিমলাকে বললাম, ‘কাল থেকে নায়ক, ছাত্র হিসাবে এ বাড়িতে আসবে। গল্পের অনেক কিছু এখনও বাকি।’