শিক্ষায় আবেগীয় ক্ষেত্র
বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা আমাদের সকলের জীবনেরই এক বর্ণিল ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা ক’জন বন্ধু সবসময়ই একসাথে বসতাম। বিশেষ করে আমি, দুই দিলীপ ও সমরেণ। বড় দিলীপ খুব মাই ডিয়ার টাইপের ছেলে ছিল। খুব নরম-শরম, উচ্ছল, ভালো ছাত্র। সমরেণ একটু শান্ত-শিষ্ট, কম কথা বলা ছেলে ছিল কিন্তু তার সেন্স অফ হিউমার ছিল সাংঘাতিক। আমাদের মাঝে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। বড় দিলীপদের বাড়িতে একটা কাঁচামিঠা আম গাছ ছিল। একবার আমের সময় ওর বাসায় গেলে ওদের বাসার প্রত্যেক সদস্য যে অকৃতিম যত্ন, আদর আর ভালোবাসা দিয়েছিল সেটি আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান।
সমরেণদের বাড়িতে আসা-যাওয়া হতো মূলত দুর্গা পূজো উপলক্ষে। দুর্গা পুজোতে সমরেণদের বাড়ি যাব না এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার ছিল আমার কাছে। মনে আছে – একবার পূজোতে আমি আর ছোট দিলীপ বাসা থেকে বেরিয়ে পুজোর পকেট খরচের টাকা দিয়ে গেন্ডারি/আখ কিনে খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে হেঁটে সমরেণদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাস্তার পরিমাণ একদম কম নয়, অন্তত কিলো পাঁচেক তো হবেই। ফেরার সময় পা আর চলে না! সমরেণদের বাড়িতে গেলেও যথেষ্ট আপ্যায়ন হতো আর সবশেষে বারবার দুর্গতিনাশিনীর কাছে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা তো থাকতোই।
সমরেণদের বাড়িতে আমার যাবার আরেকটি কারণ ছিল ওর এক খুড়তুতো ভাই – আমারই বয়সী একটি ছেলে, নাম হাদান। হাদান সেই বারো তেরো বছর বয়স থেকেই প্রতিভাবান ভাস্কর। বাবার কাছেই তার হাতেখড়ি। সমবয়সী হবার কারণে হাদানের সাথে আমার অত্যন্ত হৃদতামূলক সম্পর্ক ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে ঘটা করে যে দুর্গা পূজো হতো অধিকাংশ সময়েই সেখানে প্রতিমা বানাতে আসতেন হাদানের বাবা আর হাদান। পূজা মণ্ডপে যখন হাদান ও তার দলবল প্রতিমা বানাতো তখন আমি ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছি ওদের সাথে গল্প করে, ওদের এটা-ওটা এগিয়ে-জুগিয়ে দিয়ে।
সমরেণদের বাড়িতে গেলে আবারো হাদানের সাথে দেখা হতো। এতো আন্তরিকতা নিয়ে গল্প করতো সে যে আমার খুব ভালো লাগতো। হাদান এখন অনেক নাম করা প্রতিমা শিল্পী। ক’বছর আগে ওর সাথে দেখা হয়েছিল। সেই আগের মতোই আছে। হাল্কা-পলকা, সাদাসিধা, নিরহংকারী। ঢাকার কলাবাগান বা বনানীতে যে বিশাল আয়োজনের দুর্গা পূজা হয়, হাদান এখন সেখানে অনিবার্য পছন্দ। প্রতিমা কারিগরের নাম হিসেবে যখন হাদানের নাম দেখি, আমার খুব ভালো লাগে, খুব গর্ব হয় ওর জন্যে।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বড় দিলীপ আর আর আমি দুই শাখাতে চলে যাই। স্যারদের কাছে খুব অনুরোধ করেছিলাম আমাদের যেন একই শাখাতে রাখা হয় কিন্তু বিধি বাম। জোড়-বেজোড় রোল নাম্বারের ফাঁদে পড়ে আমাদের বিচ্ছিন্ন হতেই হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের একটি গল্প ছিল – বলাই। রবি ঠাকুরের লেখা। প্রকৃতি বিশেষত একটি শিমুল গাছের সাথে এক মাতৃহীন কিশোর, বলাইয়ের প্রেমের গল্প সেটি। গল্পটি এরকম – মাতৃহীন বলাই তার কাকা-কাকীমার কাছে মানুষ হয়। তার প্রকৃতি প্রেম অসাধারণ। চারপাশে প্রকৃতির ছোটোখাটো পরিবর্তনও তার নজর এড়ায় না। প্রকৃতিকে সে এতই ভালোবাসে যে বাসার সামনের গজিয়ে ওঠা কচি ঘাসগুলোকে মালি কেটে দিলেও সে ব্যথিত হয়। এতে অন্যেরা খুব একটা বিচলিত হয়না। আর তখন সে বুঝতে পারে কিছু দুঃখ আছে যা একান্তই তার একার।
বলাইয়ের কাকার বাসার রাস্তার উপরে একটা শিমুল গাছের চারা গজালো। ধীরে ধীরে সেটি বড় হলে একদিন বলাইয়ের কাকা সেটিকে কেটেও ফেললেন। ইতোমধ্যে বলাই তার বাবার কর্মস্থল থেকে চিঠি লিখলো তার কাকিমাকে যে সে বিলেতে পড়তে যাবে। যাবার প্রাক্কালে তার অতি প্রিয় শিমুল গাছের একটা ছবিও সাথে নিয়ে যেতে চায় সে। কাকীমা কাকাকে বললেন একজন ফোটোগ্রাফার ডাকতে। এর পর গল্পটি এভাবে শেষ হয় –
আমি বললেম, ‘সে গাছ তো কাটা হয়ে গেছে’
বলাই এর কাকী দুদিন অন্ন গ্রহণ করলেন না, আর অনেকদিন পর্যন্ত আমার সাথে একটি কথাও কননি।বলাই এর বাবা ওকে তাঁর কোল থেকে নিয়ে গেলো, সে যেন ওঁর নাড়ি ছিঁড়ে; আর ওর কাকা তাঁর বলাইয়ের ভালোবাসার গাছটিকে চিরকালের মতো সরিয়ে দিলে, তাতেও ওঁর … বুকের মধ্যে ক্ষত করে দিলে।
ওই গাছ যে ছিল তাঁর বলাইয়ের প্রতিরূপ, তারই প্রাণের দোসর।
বলাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দিলীপের অন্য শাখাতে চলে যাওয়াটা সেদিন ঠিক এভাবেই আমার বুকের মাঝে ক্ষত তৈরী করেছিল এবং আমি আমার বন্ধুদের ঠিক এই লাইনগুলির কথাই বারবার বলেছিলাম। আর এটিও সত্য যে দুটি শ্রেণিকক্ষের মাঝে শুধুমাত্র একটি দেয়াল আমাদের সম্পর্কের মাঝে আস্তে আস্তে দূর্ভেদ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যে দিলীপকে আমি এত এত ভালোবেসে ফেলেছিলাম তার নিজেরই গুণে, সেই বন্ধুটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। অন্য ক্লাসে উঠেও দিলীপ আর আমি আর এক শাখার ছাত্র হতে পারিনি। ক্লাসের ফাঁকে বা এখানে-সেখানে ওর সাথে দেখা হলে ও হেসে কথা বলতো। কিন্তু কীভাবে যেন সেই হাসির মধ্যকার প্রাণটি উড়ে যেতে থাকে। আমার জীবনেও শুন্য স্থান পূরণ হয়ে যায় অন্য বন্ধুদের দিয়ে। তবে ওকে আমি অনেক দিন খুব মিস করেছি। হয়তো এখনো করি যোগাযোগহীন।
নতুন ক্লাসে নতুন নতুন শিক্ষকবৃন্দের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তারাপদ স্যার আমাদের ইতিহাস ও হিন্দু ধর্ম পড়াতেন। বেশ রাগী মানুষ ছিলেন। ক্লাসে উনি প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন। আমাদের ডেকে টেবিল এর পাশে দাঁড়িয়ে পড়া বলতে বলতেন স্যার – মোগল সম্রাট, পাল সাম্রাজ্য, বা সেন বংশের ইতিহাস। আমরা দু’চার লাইন বই থেকে মুখস্ত বলে তারপর বানিয়ে বানিয়ে এটা ওটা বলতাম বিড়বিড় করে। স্যার তার কিছু শুনতে পেতেন বলে মনে হয় না। একসময় বলতেন – যা। সে দিনের মতো আমাদের ইতিহাস শিখন শেষ। মুখস্তের বাইরে যে ইতিহাসের কিছু জানা, বোঝা, বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কিছু আছে সেটি আমরা কোনোদিনই বুঝিনি।
ইতিহাস ক্লাসে সব থেকে কষ্টকর ছিল অসংখ্য সাল মনে রাখা। আর এই কারণে ইতিহাসকে সেই সময় আমার অন্যতম কঠিন একটি বিষয় মনে হতো। বুঝি না কেন ইতিহাসকে গল্পের মতো করে শেখানো হয় না। বা কেন ঐতিহাসিক কোন সময়ের সাথে এই সময়ের কী পার্থক্য সেটি শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে বলা হয় না; কেন খুঁজে বের করতে বলা হয় না ইতিহাসের একটি সময়ের ভালো-মন্দ দিকগুলি। ইতিহাস মানেই কি শুধু দিন তারিখের কচকচানি? তা কেন হবে?
কর্মসূত্রে আমি একবার নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব সভ্যতা পুস্তকটির কিছু অংশের অনুবাদ করেছিলাম বা অন্যের অনুবাদ সম্পাদনা করেছিলাম। তখন বইটির কন্টেন্ট ভারাক্রান্ততা দেখে আমি ব্যাথিত হয়েছি। শুরু হয়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকে আর শেষ হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়ে এসে। বোতলের মধ্যে যেমন আমরা চিনি বা লবণ ঠেসে ঠেসে ঢুকাতে থাকি, পুস্তকটিতেও সেভাবে গাদাগাদা তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পুস্তকটি কোনভাবেই আমার কাছে সুখপাঠ্য মনে হয়নি – না উপস্থাপনার ক্ষেত্রে, না বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে বা নান্দনিকতায়। অথচ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র কী চমৎকারভাবেই না তাঁর লেখা ছোটদের রামায়ণ বা মহাভারতে রামায়ণ মহাভারতের গল্প বলেছেন! কী প্রাঞ্জল লেখা! আমরা তার ধারে কাছেও যেতে পারি না।
যাহোক, আমাদের বাংলা পড়াতেন বিষ্ণু স্যার। ছাত্র হিসেবে উনি খুব ভালো ছিলেন সেটি আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি। স্যার একটু ধীর লয়ে কথা বলতেন। তাঁর যে বিষয়টি আমাদের মুগ্ধ করতো সেটি হলো তার রস বোধ। মনে আছে একবার খোকন নামে আমাদের এক বন্ধু দুষ্ট আচরণ করলে ক্লাস ক্যাপ্টেন বোর্ডে তার নাম লিখে রাখে। বিষ্ণু স্যার ক্লাসে ঢুকে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে খোকনকে উঠে দাঁড়াতে বলেন। স্যারের পরবর্তী সংলাপগুলি এখনো সহপাঠীরা এক হলে একবার না একবার আলোচনায় এসেই যায়। স্যার খোকনের উদ্দেশ্যে বলেন, “কী রে খাকিন (খোকনকে বিদ্রুপ করে ডাকা), বোর্ডে তোর নাম লেখা কেন? নাম চেতাচ্ছিস নাকি? ইলেকশনে দাঁড়াবি? খামাকা নাম চ্যাতাসনে।“
স্যারের এই প্রশ্নের উত্তরে ফর্সা খোকনের লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় নিচু করে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না। বিষ্ণু স্যারের ক্লাসের আগে খোকনের বাঁদরামি করা সেই শেষ। তারাপদ স্যারের সাথে বিষ্ণু স্যারের একটি জায়গায় মিল ছিল আর তা হলো – বিষ্ণু স্যারও ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে আমাদের কিছু লিখতে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতেন। এখন বুঝতে পারি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক কেন ঘুমিয়ে পড়েন। একজন শিক্ষককে যখন পাঁচ বা ছয়টি ক্লাস নিতে হয় একটানা, তখন ঘুমের আর দোষ কোথায়!
পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বিষ্ণু স্যার স্বর্গত হয়েছেন। এই স্নেহশীল মানুষটি আমার ও আমার মতো অগনিত শিক্ষার্থীর হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি অম্লান করে রেখে গিয়েছেন নিজ গুণে। স্যারের অনেক স্মৃতির মাঝে একটি ঘটনা আমাকে আজও নাড়া দেয়। একদিন এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আলোচনায় ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’ এই লাইনটুকু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্যার আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন। আজ বুঝি সেই কান্নাটির সাথে শিক্ষার আবেগীয় ক্ষেত্র (affective domain) এর সম্পর্ক কতো গভীর ছিলো। আর আজ বলাইয়ের যে গল্পটি আমার এই লেখায় উল্লেখ করেছি, কাকতলীয়ভাবে সেটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়িয়েছিলেন বিষ্ণু স্যার। সেদিনের সেই ক্লাসটির জন্যেই বলাই আমার জীবনেরও অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে।
(চলবে)