রসুলের কদম। নবীর পা। নবীর পা মানে আল্লা রসুলের রহমত। কদম মুবারক। খোদাতাল্লার এবাদাত কর। তার দোয়া মাঙ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে তাকে ডাক। তিনি সন্তুষ্ট হবেন।
বদরুদ্দিন মোল্লার বুকের কথা এসব। লোকে মানুক কি না মানুক, বদরুদ্দিন মানে। কথাগুলো শুধু যে বুকের মধ্যে থম মেরে থাকে তা নয়। মাঝে মধ্যে চুলবুল করে। রসুলের কদম মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকেই শোনায় এসব।
ফিরোজ মিনার থেকে মহদীপুর, পাক্কা দু-কোশ পথ। কদম রসুল থেকে তিন মাইল, কমসে কম। কলাপসিবল গেট আর বাইরের দরজায় বড়কা তালা ঝুলিয়ে মুখের ঘাম মুছে এ পথ পাড়ি দেয় বদরুদ্দিন। তখন বোল ধরা আম গাছগুলোর পিছনে খাস্তে যাওয়া সূর্যটা আরাম করে। পছিমের আকাশে গুলাবি আতর। গৌড়ের ঝোপঝাড় আর ইটের দালান ঝিপ ঝিপ অন্ধকারে গুম মারে। গাছের কোটর-বাটর আর ফাটা দেয়ালগুলোর ফাঁক-ফোকর থেকে উঠে আসা একটানা টিরর্ টরর্ টিরর্ টরর্ ডরিয়ে দেয় মানুষজনাকে।
রাস্তায় তখন অন্য শব্দ। টুং টাং, টুং টাং। ঘোষদের তাগরা গাই গুলোর বেয়াদফিতে রাস্তাটা বেদখল। কখনও বর্ডার ফৌজের গাড়ি ধুলার মেঘ উছলিয়ে গাঁ গাঁ করে দিমাক দেখায়। সবুজ কাটা-ঘাসের বান্ডিল মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরে মদনা আর হারু ঘোষ। কোন দিন আবার অনেকগুলো সাইকেলের ঘণ্টি বাজে বদরুদ্দিনের পিছনে। মুচকি হেসে পিছনে ফেরে ও। জামাল শেখ, মতু মিঞা, ভবেন সরকার, কালুয়া টাউন ফেরতা একটু থামে। ওদের ভালোবাসা বদরুদ্দিনের মালুম হয়।
‘একটা সাইকেল কিনে লাও না ক্যানে’? ভবেন বললেও এ কথাটা ওদের সবার। কিন্তু সওয়ালটার পষ্টাপষ্টি কোন জবাব খেলে না বদরুদ্দিনের ঠোঁটে। সাদা কালো দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে বদরুদ্দিনের ঠোঁটের দু’পাশে নরম হাসি পিছলে যায়। ‘শীত–পানি কিছুই তো মানো না চাচা। সাইকেল লিলে আরাম তো কিছু হবে।’ মাথা নাড়ে বদরুদ্দিন। সাইকেলের প্যাডেল দাবিয়ে ওরা হওয়ায় মিলিয়ে গেলে আবার নিজের সাথে কথা শুরু করে বদরুদ্দিন। বাড়িতে বিবি আফরোজাকেও বলে সে কথা।
‘সাইকেল তো এক-দু বছরে কিনে লিতে পারবো। আরাম মিলবে। সবাই কহছে। হামিও মানি। কিন্তু এবাদত কি হবে? বুঝলা বেগম, কষ্ট ছাড়া খোদাকে খুশ করার তরিকা নাই।’
ডাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটু থামে আফরোজা। বড় ছেলে জয়নালের কুড়িয়ে আনা লকড়ি চুলায় গুঁজে চুপ করে থাকে। বদরুদ্দিন থামে না। ‘রসুলের কদমটা মাথায় লিয়া যখন হাঁটি, হামার তকলিফ হয় না কুন। পানি-তুফান, ঠাণ্ডা-গরম সব এক্কই লাগে। মালুম হোল কি, আফরোজা?’ আফরোজা কতটা কি বুঝলো বদরুদ্দিন দিশা পায় না। আফরোজার স্বভাবই ওই। চুপচাপ। কিন্তু দরকার লাগলে জোয়ান মরদের মত দিমাক দেখায়। দুই জুঁয়া (যমজ) ব্যাটাকে চাষের কামে বেবাক জুতে দিল ও। লক্ষ্মীপুরের পনে-তিন কাঠা জমিতে তোফা বাগিচা বানিয়েছে হোসেন। এক কোমর সার সার সবুজ তুঁত গাছ। দেখলেই লোকের চোখ টেরিয়ে যায়। পিছলা শীতে রাহান পীরের মাজারের দখিনধারে মেলাই আলু ধরিয়েছিল হাসান। সংসারটা চলছে আল্লার মোবারক আর আফরোজার তকলিফে।
আফরোজা ছাওয়াল-পাওয়ালের দিলটা বুঝতে পারে। যেমনি দিল লাগিয়ে ভালবাসে তেমনি কানপাট্টিতে থাপ্পর কষে। ছেলেরা মার খেয়ে চিল্লালে বদরুদ্দিন মুখ খোলে। ‘মারছ কেন এত? থাম থাম। বাল-বাচ্চা খোদার দান। ফরিস্তা। ওদের লগে ঘরটা বেহেস্ত, বুঝলা কিনা আফরোজা।’ বুঝবার ফুরসত নাই আফরোজার। কাম আর কাম। ঘরের কাম, ব্যাটাদের দেখভাল। পলুর (রেশম) চাষ। সরকারের অফিস থেকে নগদা-নগদি গুটি কিনল এবার। টাউন থেকে লোক বুলিয়ে পলু পোকা একজামিন করালো। গেল বারের গুটিগুলানে টুকরা-রোগ ধরে গেল। চোখের সামনে কালো দাগ লিয়ে পোকা গুলান শুকিয়ে কাঠ। এবার সাবধানে কাম শুরু করেছে আফরোজা। ঘরটা গোবরে লেপে নিয়ে হলুদ পাউডারটা বদরুদ্দিনের হাতে তুলে দিয়ে আফরোজা বলেছিল, ভালো করে ওষুধটা ছিটাও জী। ঘরের কোনা-কানাচ বাদ না থাকে।’
হলুদের গুঁড়ো মাটির ঘরে ছড়াতে ছড়াতে ভাবছিল বদরুদ্দিন। রোগ না ধরলে পলু পোকাই বচ্ছর ভর খাওয়াবে। বুড়া বাপ-মা, ভাতিজা। ন’জনের সংসার। ভাত-কাপড়, টাউন যাবার ভাড়া, মাল ঢুইবার খরচা। লাগে তো মেলাই। খোদা-তাল্লার রহমতে সব চলছে, চলবে কুন রকম। আর গৌড়ের কদম রসুল থাকলে বদরুদ্দিনও বে-রোজগার হবে না।
-সালাম আলেকুম বদর ভাই’। কথাটা কানে ঢুকতেই ভাবনার রাস্তায় হোঁচট খেল ও।
-আলেকুম সালাম’ বলে চলতে চলতে একটু দাঁড়াল বদরুদ্দিন। অন্ধকারে ওদের চিনতে সময় লাগে। ইউনুস, স্বপন, মানি আর খালি-গায়ে কামালকে নজর করে বলল, ‘কুণ্ঠে যেছ তুমরা?’
-পিয়াস বাড়ি
-ক্যানে
-গম্ভীরা লাগবে। তুমি যাবা নাকি?
-নাহে। ফজলে চাচা মরেছে যে! ওর ঘরে কোরান পড়তে যেতে বুলেছে হামাকে।
ওরা চলে গেলে আবার একা বদরুদ্দিন। স্বরে বিরক্তি, ‘ফজলে চাচার বাড়ি ছুটতে হবে রাতে। আলেম ফাজেল পাশ করা মেলাই লোক তো আছে সমাজে। কোরান পড়তে হামাকে ডাকিস ক্যানে? হামার তো আমপারা বিদ্যা প্যাটে।’
আমপারা বিদ্যা পেটে নিয়ে কদম রসুলে খোদার এবাদত করে বদরুদ্দিন। গৌড়ের নামকরা মসজিদ কদম রসুল। গৌড় দেখতে মেলাই লোক আসে। আসবেই। ইতিহাসে লিখা আছে, বাংলার রাজধানী গৌড়। লখনৌতি, জিন্নতাবাদ, রামকেল .. কত নাম ছিল এর। এখন তো এত্তটুকুন। বাংলাদেশে ঢুকে গেল ছোটসোনা মসজিদ। এপারের বহু দালানের নক্সাকাটা, মিনা করা ইটগুলো খুলে নিয়ে গেল দেশ-বিদেশের মানুষ। সরকার গৌড় বাঁচাতে মিউজিয়াম বানাল। পাথরের কারুকাজ আর দামি সম্পত্তিতে ঠাঁসা ঘর। মিউজিয়ামে ডাকাত পড়ল দুবার। গৌড় লুটে নিল সবাই। রাজধানী তো না, গৌড় এখন কব্বর।
রামকেলিতে মেলার টাইমে লোক জমে ঠিকই। কিন্তু জেল্লা নাই। আগে ফিরোজমিনারে চিরাগ জ্বলত রোজ। লোক বুলত, পিরু শাহর মাজার এটা। ওই মিনারে আজকাল কেউ বাতি দেয় না। অত্ত উঁচা মিনারটা থেকে হেড মিস্ত্রী পিরুকে হড়কিয়ে ফেলে দিল গৌড়ের বাদশা, মালেক-ই-ইন্দোল ফিরোজ শা। ফিরোজ শা গৌড়ের ইতিহাসটা বরবাদ করে দিল। বহুত তকলিফ করে গৌড়কে জিন্নাৎ বানিয়েছিল হুসেন শাহ। বড় সোনা মসজিদ, বারোদুয়ারির সোনার গম্বুজ, উঁচা প্রাচীর, পরিখা-ঘেরা নগর বন্দর সব ছিল এখানে। সবটাই ভেঙে ভুঙে এখন শ্যাষ। লোটন মদজিদ ঢুঁড়লেও মিনা করা ইট মিলবেনা। তবে যতই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাক, কদম রসুল কিন্তু ঠিক আছে। কদম রসুল মসজিদের চমকানি, এখনও লোক টানে। আল্লার মুবারক। কত্ত সাফ-সুত্তর থাকে মসজিদটা। লোক তো আসবেই। রসুলের কদমকে সালাম-নমস্কার করুক না-করুক, খাদেম বদরুদ্দিনকে একটাকা-দুটাকা বখশিশ দিবেই।
তবে সব টুরিস্টের হাত থেকে বখশিশ নিতে মন করেনা। ইতিহাস শুনে লিয়ে ‘শালা গুল মারছে বে’ বলে টাউনের লোক হাসে। হাসুক। ছেলে-ছোকড়ারা ইতিহাস না-মানলে বদরুদ্দিন গা করেনা। শুধু রসুলের কদমটা মানলেই ওর দিল খুশিতে ছলকে ওঠে। রসুলের কদমটা অনেকে মানে। আবার কিছু মানুষের ফিচলামি হাসিতে অবিশ্বাস ঝরে। লোকের মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাস যাই থাক, বদরুদ্দিন তর্ক করেনা। কিন্তু রসুলের কদম নিয়ে কোন বেমক্কা সওয়াল শুনলেই বদরুদ্দিনের দেমাক চড়ে যায়।
আজ বিকেলে প্যান্টশার্ট পরা টুরিস্টের কথায় প্রথমে কঠিন রেগে গেছিল বদরুদ্দিন।
-হজরত মহম্মদের পায়ের ছাপ এটা, তার প্রমাণ কি?
ভারী গলার সওয়ালটা কানে ঢুকতেই এক ঝটকায় মাথায় গোসা উঠে গেছিল বদরুদ্দিনের। রামকেলের দিক থেকে আবছা বিকেলে মানুষটা একা এল। কদম রসুল মসজিদের সামনে বিশুয়ার চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে হাওয়া খেতে খেতে লোকটাকে দেখছিল বদরুদ্দিন। ছিমছাম খানদানি ধরন। মালদার লোকের সাজ পোষাকে এত জেল্লা থাকেনা। লোকটা বাইরের টুরিস্ট। ভাবছিল বদরুদ্দিন।
-যা বে বদরু, কামিয়ে আয়। ভালো মক্কেল লাগছে।’ বিশুয়ার কথায় ঠোঁটের পাশে হাসি ফুটেছিল বদরুদ্দিনের। চটপট হাঁটুর উপর তোলা চেক লুঙ্গিটা নামিয়ে, চিট ধরা টেরিকটের পাঞ্জাবীর হাতাটা ঠিক করে টুরিস্টের সামনে দাঁড়াল বদরুদ্দিন। মুখে আলতো হাসি। মোলায়েম স্বর, ‘আসেন। আমি এখানকার খাদেম। মসজিদের নাম কদম রসুল। চতুষ্কোণ এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি তৈয়ার করেন সুলতান নসরত শাহ। গৌড়ের বিখ্যাত সুলতান হোসেন শার পুত্র হলেন নসরত শাহ্।’
চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আঙুল তুলেছিল টুরিস্ট, ‘এটা কি?’
-এটা হল দিলওয়ার খাঁর পুত্র ফতে খাঁর সমাধি। দিলওয়ার খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি। পীর শাহ্ নেয়ামতুল্লা ওলিকে হত্যা করতে বাদশা আলমগির সেনাপতির পুত্রকে গৌড়ে পাঠান। কিন্তু গৌড়ে এসে রক্ত বমন করে তার মৃত্যু হয়’।
একটু থেমে টুরিস্টের মুখের দিকে তাকিয়েছিল বদরুদ্দিন। স্বভাব-সুলভ নরম স্বর, ‘যান সমাধিটা একবার ঘুরে আসেন।’
লোকটা নড়ল না। হাত তুলে নমস্কার বা আদাপও জানাল না। সমাধির বাইরে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে শুধু প্রশ্ন ছুড়ল, ‘আপনি কত দিন খিদমত করছেন?’
-মেলাই দিন। হামার বাপ খিদমত করছে, নানা করেছে, নানার নানা করেছে….। এখন হামি।
ফতে খাঁর সমাধির উত্তর দিকে টুরিস্টের সাথে কয়েক পা হাঁটল বদরুদ্দিন। পশ্চিম মুখো বদরুদ্দিন চটি খুলল। কোলাপসিবল গেটের তালায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘খালি পায়ে আসেন। এখানে শেষ নবী হজরত মহম্মদের পায়ের ছাপ দেখতে পাবেন। সুলতান নসরত শাহ্ সাড়ে চারশো বচ্ছর আগে কালো পাত্থরের উপর এই ছাপ লিয়ে আসেন আরব থিকা।’
একটু থেমে টুরিস্টের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করল বদরুদ্দিন। নির্বাক টুরিস্টের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘এখানে দেখতে পাবেন কালো এক ফুট পাথরের উপর পরিষ্কার পদচিহ্ন। সাদা সাটিন-কাপড়ে ওটা ঢাকা। কাপড়ের গায়ে রুপার সূতায় আঁকা ফুল, বাহারি পাতা। জায়গা বিশেষে এখনও সোনার জলের ঝিকমিকি। তামাম হিন্দুস্থানে এ কামের নজীর নাই। নবাব সিরাজদৌল্লার ভেট এটা। হামার নানার নানা তখন ছিল কদম রসুলের খাদেম।’
ইতিহাসটা আজকের টুরিস্টের মনে ধরেনি। খুব হেসেছিল ও, ‘তাই নাকি? এ সব গাল-গল্প সব মানুষকে ব’ল না।’
কথাটা শুনে প্রথমে মাথা গরম হয়ে গেছিল বদরুদ্দিনের। একটু পরে দিমাক ঠাণ্ডা হলে বুক খালি করা একটা শ্বাস পড়ল। কলজাটা শুনশান লাগলো। মনের মধ্যে চিন চিন ব্যাথা। পড়াশুনা শিখা লোক ফালতু বাত বুললে রাগের চেয়ে দুঃখ লাগে বেশী। কুন দুখ আবার জান হিলিয়ে দেয়। আজকে পরদেশি টুরিস্টের কথায় একটু রাগ-দুঃখ হলেও তেমন গায়ে মাখেনি বদরুদ্দিন। নিজেকে বুঝিয়েছিল, কদম মুবারকের নেয়ামত কি সবাই বুঝে? আর কদম রসুলের খাদেম, খোদা তাল্লার খিদমদগার, আল্লা রসুলের অপমান ছাড়া সব সহ্য করে।
মসজিদের চৌকাঠে থেকে পায়ের ছাপ দেখে বারান্দায় নেমে এল লোকটা। বদরুদ্দিনের চোখে চোখ, ‘আপনি মুসলমান, হাদিস মানেন না?’
প্রশ্নের তীরটা খুব চোখা। খ্যাচ করে বুকে বিঁধল। একটু খাবি খেল বদরুদ্দিন। জবাবের তোয়াক্কা না-করে লোকটা আবার সওয়াল ছুঁড়ল, ‘পয়গম্বরের কোন চিহ্ন মানা গুনাহ, আপনি মানেন না? আপনি খোদাতাল্লার খাদেম, না আল্ল রসুলের দুষমন?’
আচমকা ছুড়ে দেওয়া ধারাল প্রশ্নটার জবাব দিতে পারেনি বদরুদ্দিন। একটা ভারী পাথর দুরমুশ করছিল ওর বুক। দরদর ঘামছিল বদরুদ্দিন। ওর শরীর জুড়ে তখন ক্রোধের ঝালাস। মুখে মাথায় ছলকে ওঠছে গরম খুন। কদম রসুলের খোলা মাঠে তখন ধুসর বিকেল। সূর্যের ম্লান আলোয় বদরুদ্দিন রহস্যময়। একটু থেমে বুকের আথাল পাথাল রুখে দিল ও। খোদার রহমতে ও জেনেছে, রাগ-গুসসা হারাম। খোদার খিদমত, খোদার এবাদত বেয়াকুফি নয়। বেয়াকুফি হল আজনবির উপর গুসসা।
প্রায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঐ টুরিস্টের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বদরুদ্দিন। ‘মন যা চায় খাদিমকে কিছু সাহায্য ….।’
বদরুদ্দিনের পা থেকে মাথা জরীপ করছিল লোকটা। মাটিতে চোখ রেখে যেন নিজেকেই কথা গুলো শোনাচ্ছিল বদরুদ্দিন, ‘দ্যাখেন, সরকার থিকা সাহায্য আমরা পাইনা। পঞ্চাশ বছর আগে খাদেম হিসাবে হামার বাপের নাম রেকর্ড হয়। তখন থিকা বচ্ছরে নব্বই টাকা সরকার থিকা হামাদের পাওনা। ঐ টাকা লিতে এখন একশ টাকা খরচা লাগে। হামরা লিই না। টুরিস্টরাই হামাদের ভরসা।’
সব কথা শুনেও একটা পয়সা না দিয়ে বেড়িয়ে গেল লোকটা। মসজিদের দরজার বাইরে একটা সাদা গাড়ি থেকে চিৎকার আসছিল, গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে মকবুল চাচা। জলদি আও।’
গাড়িটার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বদরুদ্দিনের দু-চোখে জল ঝরল। দু’পা, সারা শরীরে আগের মত কাঁপন। চেপে রাখা বুকের উথাল-পাথাল ওর জানটাকে আবার হিলিয়ে দিল। অনেক টুরিস্টের কথায়, অবিশ্বাসী মানুষের হাসিতে দুঃখ লাগে ঠিকই। মান-অপমান গায়ে মাখে না বদরুদ্দিন। কিন্তু আল্লার দুশমন! শালা হামাকে কহছে আল্লার দুশমন?
গৌড়ের বুকে এখন অন্ধকার। গৌড়ের পরাণ জুড়ে ঝুপ করে নামল বিষণ্ণতা। প্রাচীর ঘেরা কদম রসুলের মাঠে, দালানে গাড় হয় অন্ধকার। ঝোপঝাড় কোটর-বাটরের রহস্যময় শব্দে গুমরে ওঠে যন্ত্রণা। নিঃসঙ্গ দালান গুলোয় চাপা কান্না। আমগাছ নিঙড়ানো বাতাসে দীর্ঘশ্বাস। কদম রসুলের মাঠে অন্ধকারে স্থির, নতজানু বদরুদ্দিন। ওর দু’চোখে গলে গলে পড়ছে বুকের আর্তনাদ। অস্ফুট শব্দ ঠোঁটে, শরীয়তের বিধান কি ভাঙছি হামি? দুনিয়ায় কোন গুনাহ করলাম যে লোক দুষবে ‘আল্লার দুশমন!’
কতক্ষন ও ভাবে বসে ভাবছিল, বদরুদ্দিন জানেনা। বিশুয়ার চিৎকার, ‘এই বদরু, বাড়ী গেলিনা বে’ শুনে হুঁশ ফিরল বদরুদ্দিনের। মহদিপুর থেকে সওদা করে রামকেলে নিজের ঘরে ফিরছিল বিশুয়া। মসজিদ খোলা দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে কতবার তাকে ডেকেছিল, বদরুদ্দিন জানেনা। বিশুয়া চলে গেলে উঠে দাঁড়াল বদরুদ্দিন। দুহাত দিয়ে রসুলের কদমটা মাথার মাঝখানে ঠিক করে বসাল। নিরুচ্চারে আবার কথা বলে চলে, ‘বাপ বুলত হামরা খাদেম। খোদার খিদমদ হামাদের কাম। অনেকে তোর কথা মেনে লিবে না। যে যার ধরম লিয়ে চলবে। ….শেষ পয়গম্বর খোদার শক্তি দেখাতে আরবের পাহাড়ে বাহাত্তর কদম হেঁটেছিলেন। নবীর শক্তিতে নরম হয়ে গেছিল পাত্থর। সেই পাত্থরের তুই জিম্মাদার। কদম রসুল তোর চিল্লা খানা (সাধন স্থান)। এই ঠায়ে তুই খোদার খিদমত কর।’
পাঁচ অয়াক্ত নামাজ আদা করত বাপজান। চ্যাংড়া বয়সে হামাকে খাদিম বানিয়ে বাপ কি ভুল করেছে?
পড়া লিখা জানা হাজি নিজাম আলি কাবা মসজিদে সেজদা করেছে। আসোয়াদ পাথর চুমেছে। সেও তো কহছিল, ‘নবীর কদম এটা, হামি মানি না।’
ক্লান্ত পায়ে পথ ভাঙছে কদম রসুল মসজিদের খাদেম। ওর দু চোখে জল, সত্তায় আচ্ছন্নতা। এত দিনের চেনা পথকে অপরিচিত করে গাঢ় অন্ধকার। বুকের ভিতর কে যেন বলে ওঠে, ‘দেখে শুনে পথ চিনে হাঁট বদরুদ্দিন। নইলে আছাড় খাবি।’
হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছে বদরুদ্দিন। গরু চড়ানো বয়স থেকে রসুলের কদম মাথায় নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে ও। আর একটু হাঁটলেই তার বেহেস্ত।
‘বেহেস্তে খোদাতাল্লার দরবারে কি হামার কুন ঠাই নাই’? রসুলের কদম মাথায় নিয়ে আমাবস্যার রাতে তারা ভরা আকাশের অনন্ততায় প্রশ্নের উত্তর খুঁজল নিঃসঙ্গ বদরুদ্দিন। ‘হাজার চোখ দিয়ে আল্লা রসুল কি এই অধম খাদেমকে দেখছে!’
অজান্তে কখন যেন বদরুদ্দিনের দুটো হাত দোয়া মাঙার ভঙ্গিতে বুকের সামনে উঠে এল।