“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক।”
সৃজনশীল শিল্পী ও সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চায় ছিলেন আত্মনিবেদিত৷ কিন্তু হিংসা জর্জর পৃথিবীতে মানুষের পাশবিক লোভ ,সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ দুর্বল জাতির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ফ্যাসিবাদী জঙ্গি আক্রমণ শিল্পীকে শিল্পসৃষ্টির জগতে নিশ্চিন্তভাবে বাস করতে দেয়নি। তারই ভাবনার প্রতিফলন দেখি বিচিত্রায়৷
সেখানে তিনি বলেছেন, ” পৃথিবীময় মানব ইতিহাসের প্রারম্ভ কাল থেকে দেখি একদল মানুষ আরেক দলকে নিচে ফেলে তার উপর দাঁড়িয়ে নিজের উন্নতি প্রচার করে। আপন দলের প্রভাবকে প্রতিষ্ঠা করে, অন্যদলের দাসত্বের উপর। এই দাস নির্ভরতার ভিত্তির উপরে। মানুষের ঐশ্বর্য স্থায়ী হতে পারে না। যাদের আমরা অপমানিত করে পায়ের তলায় ফেলি তারাই আমাদের সম্মুখের পথে পদক্ষেপের বাধা। …… তারা গুরুভাবে আমাদের নিচের দিকে টেনে রাখে। যাদের আমরা হীন করি ,তারা ক্রমশই আমাদের হেয় করে।”
“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে।
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
প্রথম মহাযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী তাণ্ডবের বীভৎসতা রবীন্দ্রনাথের বিবেকী চিত্তকে শান্তি স্বর্গে বাস করতে দেয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯১৪ সালে একটি প্রবন্ধে এশিয়া ও আফ্রিকাই যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রভুত্বের লক্ষ্য এই অভিমত ব্যক্ত করতে তিনি দ্বিধা করেননি।
১৯১৬ সালে সংগ্রামী কবি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যুদ্ধবিরোধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আমেরিকায় “Out Look” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা কবির হৃদয়কে ব্যথিত, বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
সেই মর্ম পীড়ারই প্রকাশ দেখা যায়
“কালান্তরে।”
“মহাযুদ্ধ এসে অকস্মাৎ পাশ্চাত্য ইতিহাসের একটা পর্দা তুলে দিলে। যেন কোনও মাতালের আব্রু গেল ঘুচে। এত মিথ্যা এত বীভৎস হিংস্রতা নিবিড় হয়ে বহু পূর্বকার অন্ধ যুগে ক্ষণকালের জন্য হয়তো মাঝে মাঝে উৎপাত করেছে। কিন্তু এমন ভীষন উদগ্র মূর্তিতে আপনাকে প্রকাশ করেনি।……….. চোখের সামনে দেখলুম জালিয়ান ওয়ালাবাগের বিভীষিকা৷ যে য়ুরোপ একদিন তৎকালীন তুর্কিকে অমানুষ বলে গঞ্জনা দিয়েছে। তারই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রকাশ পেল ফ্যাসিজম এর নির্বিচার নিদারুনতা।
একদিন জেনেছিলুম আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা য়ুরোপের একটা শ্রেষ্ঠ সাধনা ৷ আজ দেখছি য়ুরোপে এবং আমেরিকায় সেই স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে।
কবিকণ্ঠ উচ্চারিত হল —
“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী। নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব।”
তবু এ কথা বলতে হয় যারা আজ দুঃখ পাচ্ছে, প্রাণ বিসর্জন করছে তারাই আবার সৃষ্টি করছে। এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন অপমানিত জাতিরাই নতুন যুগকে রচনা করছে।
তাই কবির অন্তস্থল থেকে বেরিয়ে আসে — “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই —নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। “
বিবেকের তাড়নায় রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন, মানুষের হিংসা লোভ যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দুর্বলের উপর সবলের নির্বিবেক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের বাণী ফলিত করে তুলতে হবে। বৈষম্য পীড়িত মানবসমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে মানব সাম্য ও সমাজতন্ত্রের উদার আদর্শ।
তাই তিনি লিখলেন, “য়ুরোপে এক রাষ্ট্র জাতির মধ্যে অন্যভেদ যদি বা না থাকে! শ্রেণীভেদ আছে।…….. মানুষ যেখানেই মানুষকে পীড়িত করবে সেখানেই তাঁর সমগ্র মনুষ্যত্ব আহত হবেই, সেই আঘাত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। “
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধের উন্মত্ততার অবসানই মানব চিত্তের সদর্থক দিক। অর্থাৎ শান্তি, প্রীতি এবং সাম্যবোধের দিক আত্মপ্রকাশ করবেই। মানুষের নৈতিক ও আত্মিক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটবেই। আসলে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি ছিলেন আশাবাদী। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্বশান্তি, ঐক্য ,সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব।
এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবেই রবীন্দ্রনাথ রুশ বিপ্লব সংগঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেদেশের বিপ্লবীদের অভিনন্দন জানিয়েছে।
যুদ্ধোত্তর কালে জেনেভায় একটি বক্তৃতায় মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপীয় কোন কোন জাতির মানবতাবিরোধী নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণনা করেন।
নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় মুসোলিনি ১৯৩৫ সালে আবিসিনিয়া আক্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন সরব। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার লেখনি ধারালো হয়ে ওঠে। বেরিয়ে আসে তার কবিজীবনের অন্যতম অবিস্মরনীয় সৃষ্টি “আফ্রিকা”৷
“উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তার সেই অধৈর্যে ঘন ঘন
মাথা নাড়ার দিনে রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে আফ্রিকা।”
অতঃপর স্পেনই হোক, চীনেই হোক সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ট দস্যুদের দানবীয় অত্যাচারের কাহিনী কবি যখনই জানতে পেরেছেন তখনই দারুন মর্ম পীড়ায় পীড়িত হয়েছেন। তার উত্তরকালের কোনও কোনও কবিতায় তার সংগ্রামী চেতনা যে ঝলকিত দ্যুতি লাভ করেছে তা অজানা নয়। সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার বাণী তার রোমান্টিক সৌন্দর্যবাদী কবি জীবনে নতুন সুরের সংযোজন করেছে।
“শতাব্দী সূর্য আজি রক্ত মেঘ মাঝে অস্ত গেল।”
নাৎসী বাহিনীর ঘৃন্য মানবতাবিরোধী বর্বরতার বিরুদ্ধে বহু স্থানে লেখনি ধারণ করেছেন মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ।
জাপানি কবি নয় নোশুচির কাছে প্রেরিত পত্রে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখছেন,
“মানব ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না। সবচেয়ে বেদনা পাই চীনের জন্য, কেননা সাম্রাজিকদের অফুরন্ত অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে —আর সহায় শূণ্য চীন লড়ছে প্রায় শূন্য হাতে ৷কেবল তার নির্ভীক বীর্যে ভর করে।”
১৯৪১ সালের জুন মাসে হিটলারের সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। তখন রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ৷ যুদ্ধের খবরে কবি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বলেন যে— “খুবই চিন্তার বিষয়, তবে আমার আশা, সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হবে না।”
“নাই নাই ভয় হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।”
“এমন সময় দেখা গেল সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতা কিরকম নখদন্ত বিকাশ করে, বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। ….আজ মানবতার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে। “
“নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”
ভগ্নহৃদয় কবি লিখলেন , “আজ দ্বারের দিকে যাত্রা করেছি। পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ। কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত। রক্ষা করবো। আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়ত আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।”
“ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হোক জয়।”