কবি অবশেষ দাসের ছ’টি কবিতা

অবশেষ দাস
অবশেষ দাস
8 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

ভালবাসার ঘরবাড়ি

ভালবাসা দেহে বাঁচে, না মনে বাঁচে
তোমরা কী জানো?

একপ্রকার ভালবাসা মাটি ধরে বেঁচে থাকে।
একপ্রকার ভালবাসা নাড়ী ধরে বেঁচে থাকে।

ভালবাসা কখনও কখনও
নদীর হাওয়ার মতো দৌড়েও বাঁচে।
শরতের ঝলমলে রোদ কিংবা আকাশের মতো স্বাধীনতা হয়ে ভালবাসা নির্ভয়ে বেঁচে যায়।

ভালবাসা কবিতায় বেঁচে যায়,
অনন্ত জীবনের মতো।

- বিজ্ঞাপন -

একপ্রকার ভালবাসা শৈশবের দিনগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে।
কৈশোরের লাইব্রেরী ও যৌবনের অলকানন্দার কাছে ভালবাসা বেঁচে থাকে, অফুরন্ত হয়ে

হাত বাড়ালেই যে সময় শালিকের মতো পা ফেলে চলে
তার কাছে ভালবাসা বেঁচে থাকে, নিভৃতে

ভালবাসা বেঁচে থাকে , আচ্ছন্ন জ্যোৎস্নার কলাবতী রাগে , বুভুক্ষু ময়ূর-হৃদয়ে
দেহ ও মনের কথা তোমরা কী জানো?

গাছ হতে চাই

মানুষে মানুষে দুর্বোধ্য লড়াই দেখে ভয় হয়।

সহস্র বিছিন্নতা , আস্ফালন কাটাকাটি ,
পরমাণু অস্ত্রের থাবা
চলিষ্ণু নাড়ী ও নারীর গোপন দহন
নির্বোধ সন্ত্রাস….

- বিজ্ঞাপন -

অসহায় পৃথিবীর সমব্যথী নেই।

সঞ্জীবনী সন্ধ্যার আকাশে ক্ষুধার্ত চিল
অপঠিত ঈর্ষার রঙ তার শূন্য
কেউটের স্পর্ধাকে ছিঁড়ে দিয়ে
পরিতৃপ্ত আত্মার মতো সে ঘুমিয়ে পড়ে ।

মানুষের ঘুম নেই ,
অজস্র অজস্র খিদে তার
চোখে মুখে অন্তরে

- বিজ্ঞাপন -

দিনে দিনে বিষ হয়ে ওঠে।
কিংবা বিষের চেয়েও গুরুতর কিছু

মানুষের মতো নৃশংস হওয়ার
স্পর্ধা কারও নেই।
সারাক্ষণ ভয় হয়, নৃশংসজীবী
মদে ও আর্তনাদে

গাছপালার ভেতরে বসে কতদিন
গাছ হয়ে গেছি।
পতঙ্গের প্রত্যাশা ধরে উড়ে গেছি মউলে পাড়ায়।
মানুষ তো ফুরিয়ে গেছে, কখনও মানুষ নয়, এইবার গাছ হতে চাই।

প্রেম শূন্য

স্তব্ধতার ঋত্বিক জানে , তোমার মৌনতা ভাঙার কৌশল আমি শিখিনি
তোমার গাঙচিল-হৃদয়ের পাশে রেখেছি, কলাবতী নদী, অক্ষরবৃত্ত
আমার গ্যালাক্সি প্রেম …

প্রাগৈতিহাসিক মাছরাঙা লেটার প্রেসে
বসে বসে প্রুফ সংশোধন করে ,
প্রেম শূন্য প্রেমের কাব্যগ্রন্থ

শোচনার শীর্ষ চূড়া থেকে মৌনতার ময়ূর কালিদাসী মেঘদূত খোঁজে,
ভালবাসা স্বজনের মতো সুন্দর কিংবা
উৎসবের আনন্দ কোলাহল
শূন্যতা ভেঙে ভেঙে চলে

কালপুরুষ ও নীল নদ দুজনেই সুপুরুষ
দুজনেই নারী ভালবাসে

প্রেম শূণ্য প্রেমের কাব্যগ্রন্থ কার হাতে লেখা, মহাকাল জানে
মাছরাঙা উড়ে গেছে , দূরে বহুদূরে

ছিঃ

কৃষ্ণবর্ণ কাকের চোখের বৈরাগ্য হলুদ চোখের কাছে অসহায়
অশোকের তরবারি বুদ্ধের ছায়া ধরে দুর্মর চন্ডাশোক হলেও পাণিপথে বিন্দুমাত্র বাধা আসেনি
পলাশীর মাটি জানে, হলুদ চোখের খেলা নৃশংস দাবানলে পোড়া
অমৃতের সন্তান সক্রেটিস হলুদের বিষে ফালাফালা
রাজপথে গুলি খায়, মার্টিন লুথার কিং

ভিয়েতনামের কাছে উনিশের ইতিহাস আছে।
সিরিয়ার আকাশে বারুদের গন্ধ শাসায়
বাগদাদে স্বাধীনতা নেই, আগুনের গৌরব নতজানু

গাজা জানে, জন্ম ও মৃত্যুর ব্যবধান ইজরায়েল লেখে , বেমালুম পুতুল খেলার ছলে।
হলুদ চোখের পানি ঝরে না, কখনও
রক্তের হোলি খেলা চলে।

মাটি ও নাড়ীর কবিতা

উপড়ে যাওয়া বৃক্ষ রাতের বাতাসকে ডেকে বলল, কোথায় যাচ্ছ , দাঁড়াও।
মাটির কান্না শুনতে পাচ্ছ
দাঁড়িয়ে যাও।

বাতাস বলল, মাটির জন্যে কে দাঁড়ায়
সবাই তো নিজের জন্যে দৌড়ে যাচ্ছে।

মৃতপ্রায় বৃক্ষ বলল,
সবাই দৌড়চ্ছে মাটির জন্যে

আলো নিভে গেলেও মাটি থেকে যায়, নাড়ীর মতো।

দু’হাত মাটিতে রেখে ,
একজন প্রবাসী ঝলমলে হেমন্ত-দুপুরে আমার ছায়ায় এসে বলে গেছে,
একমুঠো মাটি নিয়ে উড়ে গেছি, পাখির মতো
দূর প্রবাসে, পরবাসে
আমার শাখায় বসে ঘরকুনো শালিকের জোড়া শুনেছে, সে কথা

রাষ্ট্রের জাঁতাকলে
দেশ ছেড়ে পালাতে তো হয়,
মাটি ছেড়ে পালানো কী যায়?

পিতামহ, মাতামহ কিংবা পূর্ব নারী
জন্মের সূত্র ধরে দিয়েছে সে মাটি

তৃষিত আকাশ জানে,
মায়ের মতো গভীর সত্য এই মাটি
রাষ্ট্র নয়, জন্মভূমি মাটি।

অনন্ত জীবন, পরবাসে ভিটে মাটি চায়।
আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও লড়াইয়ে পুণ্যভূমি চায়।

বাতাস ভারী হয়ে
মাটির কাছে নেমে এলো, ক্রমে
বাতাস বলল, আমি নতজানু হলাম।

রবির মা ও তেঁতুল তলার জ্যোৎস্না

রবির মায়ের নড়বড়ে একটা তক্তপোশ, ইঁটের ওপর বসানো তার চারটে পায়া
তক্তপোশের তলায় সংসারের অর্ধেক জিনিসপত্র, কিছুই তো নেই।
না থাকলেও গৃহস্থের যা যা থাকে, সেসবের মধ্যে নুনের কৌটো, বেলেন চাকতি, মসলা রাখার ডিবে, রবির বাঁটুল, ভাঙা লাটাই ঘুড়ি, জামা কাপড় রাখার ট্যাংক, লাফান দড়ি, অল্প কিছু থালা-বাসন, কাস্তে কাটারি আরও কত শত জিনিস নিয়ে রবির মায়ের অগোছালো সংসার…

রবির বাবা পাঁচু কাওড়া মনের আনন্দে ভ্যান চালায়। সারাবছর চুপড়ি ঝোড়া তৈরি করে। ঝাঁতলা বোনে।
মায়ের পূজাতে বাজনা বাজাতে যায়। ওপর ওপর নেশা করে। কোনও পাড়ায় কালীপূজা হলেই রবির বাবার বাজনা ছেলেবুড়ো সবাই শোনে।
রবির বাবা শুধু সংসারের কোন কথা শোনে না।

রবি সবার বড়। ওর ছোট ভাইয়ের উপরে এক বোন রয়েছে।
একেবারে রাস্তার ধারে ওদের বাড়ি। গা খোলা যুবকের মত ওদের ঘরদোর।
সব দেখা যায়। উঠোনের উনুন পলিথিনে ঢাকা দেওয়া। উঠোনের একপাশে মনসা গাছ মাথা উঁচু করে আছে।
তার গায়ে গায়ে প্রতিবেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে নারায়ণ তুলসী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলো পায় ।

রবির মায়ের ভরা সংসার। লেখাপড়া শেখার চাহিদা এদের নেই। এদের ভাতকাপড়ের স্বপ্ন।
রবির মা তক্তপোশে শুয়ে স্বপ্ন দেখে ছেলেমেয়েরা বড় হবে। খড়ের চালে টালি হবে। দু’মুঠো ভাত বেশি খাবে।
গরু পুষে সংসারের সবাই মিলে দুধ ভাত খাবে।

তেঁতুল গাছের তলায় রবিদের কুঁড়েঘর। জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে রবির মা ছেলেমেয়েদের বড় করে।

গরু পোষা সম্ভব হয়নি , ঘরের পিছনে একটা সজনে গাছ হয়েছিল।
বাঁশ গাছের মতো লম্বা। রবির মায়ের স্বপ্নের মতো লাগামছাড়া ।সজনে ফুলে ভরে যেত সেই গাছ।
লিকলিকে সজনে দখিন হাওয়ায় দোল খেত রবির মায়ের স্বপ্নের মত।
সজনে গাছের ডাল বড় মড়কা। রবির বাবা সামান্য জ্বরে চলে গেল।
ভিতরে ভিতরে চাপা জন্ডিস হয়েছিল। জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে স্বপ্ন দেখার দিন ফুরালো।
আয়নার সামনে দাঁড়ালেই রবি মা কেমন ভয় পেয়ে যায়। দাওয়ায় বসে কত কেঁদেছে।
মেয়েটা বারে বারে চোখ মুছে দিয়েছে।

রবির বোনের পাশের গ্রামে বিয়ে হল। খেটেখুটে খেতে হয়। সংসারে ভালোবাসা আছে।
কুড়ি বছর বয়স হয়নি, রবি ঘরে পনেরো বছরের বউ নিয়ে এলো। ফুটফুটে মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি মা হয়ে গেল।
রবির মা মেয়ের ঘরে নাতনী পেল। ছেলের ঘরে নাতি পেল। রবির ছোটভাইটা সোনার কাজে দিল্লি গেল।
সে নাকি অনেক দূর। রবির মা পাড়ার লোকের মুখে শুনেছে।

উঠানের পাশেই ছাদ দেওয়া ঘর করে একদিন রাতে নতুন বউ আনলো ,রবির ভাই ; মাহিষ্য পাড়া থেকে।
দুটো ছেলের দুটো বউ। লাউ গাছ মাচায় উঠলে ফুলে ফুলে ভরে যায় ।
রবির মা এখন মাচায় ওঠা লাউ গাছ। নাতি নাতনিতে সংসার ভরে গেছে। দুই ভাই আলাদা। দুই বউয়ের ধরণ আলাদা। রবির মা আলাদা।
তক্তপোশে রবির মা একলা ঘুমায়। ঘুম না এলে জেগে কাটায়। তক্তপোশটা মস্ত বড় যেন নদী মনে হয়।
মেয়ে এলে ফাঁকা আকাশে মেঘ দাঁড়ানোর মতো কিছুটা শূন্যতা ঢাকা পড়ে।

সিঁথি থেকে নেমে যাওয়া সিঁদুরের মত ছেলেমেয়েরা নেমে চলে গেছে, রবির মায়ের বুকের ভেতর থেকে, অনন্ত দূরে
মায়ার বাঁধন বলে যদি কিছু থাকে, সেইটুকু অবশেষ রবির মায়ের বুকে জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে স্বপ্নের হাত-পা-নাক-চোখ আঙুলকে দেখে।
মা আজ এক মুঠো ভাত পায় না। প্রতিদিন দুইবেলা মুখ নাড়া পায়। পাঁচু কাওড়ার বউ হাত পাতে। মেয়েটার মায়া দয়া থাকলেও সামর্থ্য নেই।
সব আছে কিছু নেই রবির মায়ের। বউগুলো মাঝে মাঝে গ্লাস ধরে হাতে। রবির মায়ের আজ কুকুরের দশা। ছেলেরাও ধরে ধরে মারে।
ঘরের ঝুলের মত ঝেড়ে ফেলে দিতে ছেলে , বউ কারও দ্বিধা নেই।
একবেলা রোদ মাড়িয়ে একমুঠো চাল নিয়ে আসে। দানের কাপড় ঘরে আনে।
পাঁচু আর ফিরে আসে না। ছেলেদুটো কাছে আসে না।
রবির জনম দুঃখী মা কোনোভাবে টিকে আছে। বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই, রবির মা।
বেঁচে আছে স্বপ্নেরা রূপকথা হয়ে।
নিহত সজনে ফুলের মত অসহায় রবির মা।

রবির মায়ের সংসার ভেসে গেছে, ভরা জ্যোৎস্নায়।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। বাবা গৌরবরণ দাস এবং মা নমিতা দেবী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। দুটোতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এছাড়া মাসকমিউনিকেশন নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিদ্যানগর কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রথম লেখা প্রকাশ 'দীপশিখা' পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই: মাটির ঘরের গল্প ( ২০০৪), কিশোরবেলা সোনার খাঁচায় (২০১৪), হাওয়ার নূপুর (২০২০) সহ অজস্র সংকলন ও সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি একজন প্রতিশ্রুতিমান কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কবিতা চর্চার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের চর্চা সমানভাবে করে চলেছেন। কবি দুই দশকের বেশি কাল ধরে লেখালেখি করছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সংকলনে। বেশকিছুদিন সম্পাদনা করেছেন ছোটদের 'একতারা' সাহিত্য পত্রিকা। এছাড়া আমন্ত্রণমূলক সম্পাদনা করেছেন বহু পত্র-পত্রিকায়। তিনি গড়ে তুলেছেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক দুটি অন্যধারার প্রতিষ্ঠান 'বাংলার মুখ' ও মেনকাবালা দেবী স্মৃতি সংস্কৃতি আকাদেমি।' তাঁর গবেষণার বিষয় 'সুন্দরবনের জনজীবন ও বাংলা কথাসাহিত্য।' পাশাপাশি দলিত সমাজ ও সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী। ফুলের সৌরভ নয়, জীবনের সৌরভ খুঁজে যাওয়া কবির সারা জীবনের সাধনা। সবুজ গাছপালাকে তিনি সন্তানের মতো ভালবাসেন। সুন্দরবন তাঁর কাছে আরাধ্য দেবী। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার ও সম্মান: সুধারানী রায় স্মৃতি পুরস্কার (২০০৪), বাসুদেব সরকার স্মৃতি পদক (২০০৬), রোটারি লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ১০০ ডায়মণ্ড গণসংবর্ধনা (২০০৮), পাঞ্চজন্য সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), শতবার্ষিকী সাহিত্য সম্মাননা (২০১১), এশিয়ান কালচারাল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৪), ডঃ রাধাকৃষ্ণন সম্মাননা (২০১৫), ডি.পি.এস.সি. সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮), আত্মজন সম্মাননা (২০১৯), বিবেকানন্দ পুরস্কার (২০১৯), দীপালিকা সম্মাননা (২০১৯), সংহতি সম্মাননা (২০২০), সুকুমার রায় পুরস্কার (২০২০)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!