রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমার মতন সবার মনে হবে মাঝ সমুদ্রে জাহাজ ডুবি হল। এমন একজন মানুষ সম্বন্ধে লিখতে গেলে,না লেখাই উত্তম উপায়। কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় যাব ভাবলেই একটা অনিশ্চিত ভয় হয়। তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। তিনি নেই,তার মানে কি নেই! না, তিনি আছেন প্রতি মুহূর্তে। শয়নে, স্বপনে, জাগরনে। যিনি এতটাই আপন তবে এই সুযোগে আবার নতুন করে স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট কবি, সুরকার, গীতিকার, উপন্যসিক, গায়ক, নাট্যকার, অভিনেতা চিত্রশিল্পী, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক এবং দেশপ্রেমিক। তিনি ছিলেন সকল দেশের সকল কালের এক বিরাট পুরুষ। তা তিনি নিজেও জানতেন। বলেছিলেন, আমার বীণায় এতো বিচিত্র তার যে আমার মতো একজন ছাড়া ওপরের পক্ষে জীবনী লেখা কঠিন। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সমস্যা আমার কবি-প্রকৃতি।
মহাকবি আপনাতে আপনি ভরপুর। একান্ত একাকী।তাঁদের শিষ্যের অভাব হয় না,শত্রুরও অভাব হয় না। অভাব হয় অন্তরঙ্গ বন্ধুর। তবু “তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।
“গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থের জন্য (১৯১৩) নোবেল পুরস্কার লাভ। ‘গীতাঞ্জলি’র ১০৩টি কবিতার মধ্যে ৫৩ টি কবিতা বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে নেওয়া, বাকিগুলি অন্যান্য গ্রন্থ থেকে নেওয়া। শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন অসামান্য পরিশ্রমে। আবার জমিদারের কাজকর্মও করেছিলেন।
আমরা শেষের দিকে যাওয়ার আগে তাঁর কথা আগে বলে যাই। রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেছিলেন বাইশ বছর বয়সে সেই যশোহরের মেয়ে ভবতারিণী দেবীর সঙে। পরে মৃণালিনী নাম হয় । রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর পাঁচ সন্তান। মাধুরীলতা( ভালবেসে বেলা,কখনো বেলি), রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা (রেণু,রাণী), মীরা ও শমীন্দ্রনাথ। এবার আমরা দেখব তাঁর জীবিতকালে কে চলে গেছে। মৃণালিনী উনত্রিশ, রেণুকা তেরো, মাধুরীলতা বত্রিশ, শমী এগারো বছর বেঁচেছিলেন। আর যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন কাদম্বরী দেবী। মানে বৌঠান ১৮৮৪ সালে আত্মহত্যা করেন। কবির তখন তেইশ বছর।বৌঠান ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা। কঠোর সমালোচক এবং প্রিয় বন্ধু। প্রায় প্রথম লেখারই প্রথম পাঠিকা বা শ্রোতা ছিলেন বৌঠান। এতো শোক নিয়েও যে অমর শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ আছেন কিনা আমার জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথ নিজে বেঁচে ছিলেন আশি বছর তিন মাস।বাইশে শ্রাবণ,তেরোশো আটচল্লিশ (৭ই অগাস্ট, ১৯৪১)
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টি যদি একদিন লোকে ভুলে যায় তবে তাঁর গান বহুদিন থাকবে।তাঁর গান তিনটে দেশের জাতীয় সঙ্গীত।
ভারত,বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা।সত্যি কথা বলতে একজন মানুষকে যদি দশবার নোবেল পুরস্কার দেবার প্রচলন থাকত তবে সেটা রবীন্দ্রনাথ পেতেন।
আমরা শেষের দিনে যাবার আগে দেখি দু একটি কথা এবং রসিকতা।’ যে ব্যক্তি কবি হইবার জন্য কবিতা লেখে সে আসলে কবি নয়। সত্যকার কবিরা লেখে জীবন সম্বন্ধে তাহাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য।’
‘ কে বোঝে কে না বোঝে সে কথার বিচার আমি করতে যাব কেন।কবিতা লিখেছি মানে তার করণ সম্পূর্ণ বুঝেছি এমন কথা মনে করবার কোনো হেতু নেই। মন থেকে কথাগুলো যখন সদ্য উৎসারিত হচ্ছিল,তখন নিশ্চয় একটা মনের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল সেই অন্তর্যামীর কাজ সারা হতেই সে দৌড় মেরেছে।’
‘এই জন্য কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে, বুঝিলাম না,তখন বিষম মুশকিলেই পড়িতে হয়। কবি তো বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক বা রাষ্ট্রনীতিবিদ নহে।’
রবীন্দ্র সাহিত্যে হাস্যরসের চরম প্রকাশ ব্যঙ্গ এবং উইটি কিন্তু তিনি নিজে কি রসিক ছিলেন তা না লিখলে শান্তি পাচ্ছি নে।
তখন তিনি ভাতে শুকনো নিমপাতা খেতেন। একদিন একজন ভদ্রলোক নিমন্ত্রিত হয়ে কবির সঙে খেতে বসেছেন দুজনকেই সব খাবার ভাগ করে টেবিলে দেওয়া হয়েছে। ঠিক তখন চাকর এসে কবিকে এক গ্লাস সবুজ রঙের শরবত দিয়ে গেল। সঙ্গী ভদ্রলোক তা দেখে কৌতূহলী হলেন। ভাবলেন একটা না জানি কি জিনিস। নিশ্চয়ই সিদ্ধির শরবত বা তেমন কিছু নেশার জিনিস হবে।কবি কপট গাম্ভীর্যের সাথে বললেন, এই তো দেখো,কী ভীষণ পক্ষপাতিত্ব। আমি এসব পছন্দ করি না। একসঙে খেতে বসেছি,অথচ দেখো ,রবীন্দ্রনাথ বলে খাতির করে আমাকে এক প্রস্থ বেশি দেওয়া হল।ওরে দে, দে বাবুকেও এক গ্লাস শরবত এনে দে।
দ্বিতীয় গ্লাস খেয়ে ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। বাটা নিমপাতা।
I am struggling on my way through wilderness–my feet are bleeding and I am toiling with panting breath.wearied I lie down upon the dust and cry and call upon his name–I knew that I must pass through death. God knows it is that the death pang that is hearing open my heart.
রবীন্দ্রনাথ এণ্ড্রুজ কে লিখছেন এই আশ্চর্য চিঠি।তখন রবীন্দ্রনাথ 54,খ্যাতির তুঙ্গে অবস্থান।সুস্থ সবল শরীর। আগের বছর পেয়েছেন পেয়েছেন সবচাইতে বড় পুরস্কার। তবু কেন মরতে চাওয়া ! নৈনিতালে রামগড় পাহাড় থেকে পুত্র রথীকে লিখছেন। আমার conscience এ কেবলি ভয়ংকর আঘাত করছে যে বিদ্যালয়, জমিদারি সংসার দেশ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমার যে ধর্তব্য আমি কিছুই করিনি। আমার উচিত ছিল নিসঙ্কোচে আমার সমস্ত ত্যাগ করে একেবারে রিক্ত হয়ে যাওয়া এবং কেবলি মনে হচ্ছিল যখন এজীবন আমার ideal কে realise করতে পারলুম না তখন মরতে হবে।
তিনি ব্যথা পথের পথিক,জীবনটাই তাঁর কাছে ব্যথার পুজা। এ জীবনের যত মহোত্তম দান, সবই তিনি পেয়েছেন বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনায়। দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করছে।মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি। হবেও না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ।
——– রথীন্দ্রনাথ কে লিখছেন কবি।
যে মানুষটা উল্লাসের শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছে , তাঁকে যে স্পর্শ করতেই হবে অতল বিষাদ খাদের নিম্নতম বিন্দুও,না হলে যে কাজ সম্পূর্ণ হবে না। সামগ্রিক পরিক্রমনে পড়বে বাধা।
‘হেথা যে গান গাইতে আসা আমার
হয়নি সে গান গাওয়া
আজো কেবলি সুর সাধা আমার
কেবল গাইতে চাওয়া।’
আবার বললেন, আরো আঘাত সইবে আমার
সইবে আমারো ….
প্রতিমা দেবীর গদ্যের: আজ শ্রাবণ পূর্ণিমার রাত আকাশ স্তব্ধ,লেগেছে রাখি বন্ধনের লগ্ন।সন্ধ্যা থেকেই সকালে জানতো আজকে তাঁর জীবন সংশয়, বারান্দায় মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছি ,ডাক্তারদের অনেকগুলো গাড়ি নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে..বুঝলুম মহাপুরুষ আজ মহপ্রয়ানের পথে।আজ তাঁর মৃত্যুর সঙে রাখি বন্ধন-লগ্ন।পাশে বসে বুকের উপর হাত রাখ্লুম ,তখনো দেহের অণু-পরমাণুর সঙ্গে চেতনার নিবিড় দ্বন্দ চলছে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য।মুখ দিয়ে আপনি বেরিয়ে এলো যে মন্ত্রে ত্রিশ বছর আগেই বাড়িরই ঠাকুর দালানে দীক্ষিত করেছিলেন তাঁর মা -মণিকে–‘ অসতো মা সদগময় তমসো মা জয়তীর্গময় ।'( নির্বাণ)
তারপর কবি খুব অসুস্থ,কলকাতায় নিয়ে আসতে হবে। সেদিন ছিল শন্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রা ।দুধারে কাতারে মানুষ রাস্তায়, ঘরের কাছে ।মানুষ বুঝে গেছে,এই শেষ। কবি তিনি আরো আগে মনে মনে ভাবছেন,এই আকাশ, গাছপালা, সাধের আশ্রম সব ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। রাস্তায় নতুন লাইট বসেছে ।সব তাকিয়ে দেখছেন।ভিতরে কেঁদে যাচ্ছে মন। কলকাতায় অপারেশন হবে। ডাক্তার বিধান রায় ,নীলরতন সরকার আরো দুতিনজন অপেক্ষায়। কবি রাজি নন। আগের দিন তিরিশে জুলাই, 1941সালে রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা। মুখে বলছেন শুয়ে। শুনে তা লিখে নিচ্ছেন। জোড়া সাঁকোর বাড়িতেই সকাল বেলায়।তরপরেই অপারেশনের প্রস্তুতি। শেষ সৃষ্টি।রানী চন্দর মাধ্যমে।সকলেই রাখি নিলেন।পরে ঠিক করে নেবেন।কিন্তু সে আর হয়নি।
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী ।
……………….
……………….
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষর অধিকার।
শেষ তিন লাইন জুড়ে দেওয়া হয় কবির ইচ্ছানুসারে । সকাল সাড়ে নয়টা।
তারপরের দিন বাইশে শ্রাবণ, কবি চলে গেলেন এই বিশ্বসংসার ছেড়ে চিরদিনের মতো।
তার সাত দিন পর বাইশে শ্রাবণ ..
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ণ এই বাটে ..