১৮৯৮ সালের ১ এপ্রিলে নিউ ইয়র্কের মানহাটানে জন্মানো এক আশ্চর্য প্রতিভার মানুষ ছিলেন উইলিয়াম জেমস সিডিস। কেউ কেউ অবশ্য ‘সিডিস’ না বলে ‘সাইডিস’ও বলেন। আইকিউ পরিমাপের ভিত্তিতে তিনি ছিলেন পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান, এমনকী আইনস্টাইন, নিউটনদের থেকেও বেশি। হিসেবে দেখা গেছে, আইনস্টাইনের আইকিউ ছিল ১৬০, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১৮০, নিউটনের ১৯০। এঁরা সবাই বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তি। কিন্তু সিডিসের আইকিউ ছিল এঁদের সবার থেকে বেশি— ২৬০! অথচ… আসলে ইউক্রেন থেকে শরণার্থী হিসাবে আমেরিকায় এসেছিলেন তাঁর বাবা-মা। তাঁর বাবা বরিস ছিলেন একজন মনোবিদ আর মা সারা ছিলেন চিকিৎসক। তাই বুদ্ধিমত্তা ছিল তাঁর রক্তে।
তিনি জন্মেছিলেন আমেরিকার বস্টনে।
মাত্র ছ’মাস বয়সেই তিনি বর্ণমালার পাঠ শেষ করেন। তাঁর বয়স যখন সবে দেড় বছর, মানে ১৮ মাস, তখনই তিনি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইস’ সংবাদপত্র গড়গড় করে পড়ে ফেলতেন।
দু’বছর বয়স হতে না-হতেই ব্যাকরণ ও তার নিয়ম-কানুনগুলোকে এমন ভাবে আয়ত্ব করেছিলেন যে, যখন তিনি কোনও কিছু লিখতেন, তাতে একটা বানানও ভুল থাকত না। মাত্র চার বছর বয়সেই দু’-তিনটে ভাষায় বেশ পরিস্কার ভাবেই অনর্গল কথা বলতে পারতেন। আর তাঁর বয়স যখন আট বছর, তখন তিনি ইংরাজি, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, হিব্রু, তুর্কিশ ও আর্মেনিয়ান ভাষাও আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন
শুধু ভাষাতেই যে দক্ষ ছিলেন তা নয়, স্কুলের পাঠও শেষ করেছিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। তাঁর এ রকম পড়াশোনার বহর দেখে তাঁর বাবা মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাঁকে ভর্তি করে দেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। হ্যাঁ, স্কুল-কলেজে নয়, একেবারে সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানে ইউনিভার্সিটিতে। তিনিই হলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সব থেকে কম বয়সে ভর্তি হওয়া একমাত্র ছাত্র।
হার্ভার্ডে ভর্তি হয়েই চমক দেখাতে শুরু করলেন তিনি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অঙ্কে তাঁর মুন্সিয়ানা বুঝতে পারেন সেখানকার অধ্যাপকেরা। তাঁদের অনুরোধে ওই বয়সেই বিভিন্ন বিষয়ে লেকচার দিতে শুরু করেন তিনি।
তার থেকেও বড় কথা, কোর্সটি ছিল চার বছরের। কিন্তু সেটা মাত্র ছ’মাসেই শেষ করে ফেললেন তিনি। তখনই তাঁর নাম ‘বিস্ময় বালক’ হিসেবে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
মাত্র ষোলো বছর বয়সেই আর্টসে স্নাতক কোর্স সম্পূর্ণ করেন তিনি। তার পরেই টেক্সাসের রাইস ইনস্টিটিউটে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি বছর।
কিন্তু সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রই তাঁর থেকে বয়সে বড় হওয়ায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এই সময়েই, নিজের নামে নয়, তিনি একটি ছদ্মনামে একের পর এক বই লিখেতে শুরু করেন।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কারণ, এ রকম কাহিনির হদিশ খুঁজলে হয়তো আরও অনেক মিলবে, কিন্তু তার পরবর্তী জীবনের মতো মর্মান্তিক ঘটনার নজির সত্যিই বিরল।
অধ্যাপক-জীবন শুরু করার মাত্র এক বছর পরে, যখন তাঁর বয়স সবেমাত্র একুশ, তখন তিনি এমন একটা অঙ্কের ফর্মুলা আবিষ্কার করার জন্য মেতে ওঠেন, যে ফর্মুলায় ফেললে পৃথিবীর যত কঠিন অঙ্কই হোক না কেন, তা অনায়াসেই সমাধান করা যাবে। ঠিক ছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই এই অভিনব সমাধান-সূত্র তিনি বের করে ফেলতে পারবেন এবং তার পরেই সেটা বই আকারে প্রকাশ করবেন। প্রকাশকের সঙ্গে প্রাথমিক কথা বলাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা শুরু করার মাত্র কয়েক দিন পর থেকেই তাঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। বছর কয়েকের মধ্যেই এমন হয়, তিনি যে কোনও দিন লেখাপড়া করেছেন বা স্কুল-কলেজে গেছেন, সেটাও ভুলে গেলেন। এর পরের জীবন আরও বেদনাদায়ক।
সিডিস সব ছেড়েছুড়ে চলে যান নিউ ইয়র্কে। সেখানে অতিকষ্টে জুটিয়ে নেন একটা মেকানিকের কাজ। অধ্যাপক থেকে একেবারে মেকানিক। দিন-আনা দিন-খাওয়া। এর পরেও তিনি বহু দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি আর ফিরে আসেনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাউথ বস্টনে একজন অতি সাধারণ, আর পাঁচজন খেটে খাওয়া মানুষের মতোই অত্যন্ত ছাপোষা একজন মেকানিক হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দেন তিনি। এবং ১৯৪৪ সালের ১৭ জুলাই মাত্র ৪৬ বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি চলে যান।