শুরু হল কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহের কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস মহাশূন্যে জুরান। শরিকি বিবাদে পূর্বপুরুষের কড়িবরগার প্রকাণ্ড পাঁচ মহলা বাড়িটা বিক্রি করে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিলেন জুরানের বাবা। আসার সময় ওই বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি ইট আর দুটো সেগুন কাঠের খড়খড়িওয়ালা জানালা লাগিয়ে নিয়েছিলেন এই ফ্ল্যাটে। সেই জানালা দিয়ে যখন ফুরফুর করে হাওয়া ঢোকে, তখন নাকি সেই হাওয়ার মধ্যে তিনি তাঁর পুরনো বাড়ির গন্ধ খুঁজে পান। সেই গন্ধই তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ছোটবেলায়। তিনি খুঁজে পান তাঁর ছেলেবেলাকার সঙ্গী-সাথীদের। পাঁচ মহলা বাড়ির কানাঘুঁজি অলিন্দে তিনি তখন ছোটাছুটি করেন। চোর চোর খেলেন। একদিন রাত্রিবেলায় লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় সেই জানালা দিয়ে তাকাতেই জুরানের জীবনে এক ঘটল বিপত্তি। কী কী ঘটল? তা জানতে হলে আপনাকে পড়তেই হবে কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক এই উপন্যাস- মহাশূন্যে জুরান।
চোখ খুলতেই জুরান দেখল ঘুটঘুটে অন্ধকার। কখন লোডশেডিং হয়েছে ও জানে না। সারা শরীর ঘামে জ্যাবজ্যাব করছে। বিছানা পর্যন্ত ভিজে গেছে।
কিছু দিন আগে ওদের বাড়িতে যে ইনভার্টারটা ওর বাবা নিয়ে এসেছেন, পাওয়ার কাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অটোমেটিক্যালি সেটা চালু হয়ে যাওয়ার কথা। এ ক’দিন তা হয়েওছে। কিন্তু আজ যে সেটা কেন হল না, ও বুঝতে পারল না।
ক’টা বাজে এখন! মাথার কাছে বালিশের পাশেই ছিল মায়ের মোবাইল। রোজই রাত্রিবেলায় খাওয়াদাওয়ার পরে এ ঘরে আসার আগে মায়ের মোবাইলটা ও নিয়ে আসে। প্রথম প্রথম যখন ওর মা জিজ্ঞেস করতেন, কেন নিচ্ছিস? ও কোনও দিন বলত, স্পেলিং চেক করার জন্য। আবার কোনও দিন বলত, সামনেই পরীক্ষা তো, শুধু রাত্রিবেলায় পড়লেই হবে না। খুব ভোরে উঠতে হবে। তাই তোমার মোবাইলটা নিচ্ছি। অ্যালার্ম দিয়ে রাখব। মুখে এ কথা বললেও ঘরে এসেই ক্লাস ফোরের পড়া যত না পড়ত, তার চেয়ে মোবাইলে গেম খেলত বেশি।
মায়ের সেই মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল, রাত একটা পঁয়তাল্লিশ। একবার কারেন্ট গেলে যে কখন আসবে তার কোনও ঠিক নেই। দরদর করে ঘামছে। আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না। ও উঠে বসল। গা-টা একটু মুছতে পারলে হত। কিন্তু গামছাটা তো বাথরুমে। ঘরে ওর মা, বাবা আর ও, মোট তিন জন থাকলেও ডায়নিং স্পেসের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জুড়ে রয়েছে ডিম্বাকৃতি ঢাউস একটা খাবার টেবিল। সে রকম লোকজন তাদের বাড়িতে না এলেও ওই টেবিল ঘিরে কেন যে ছ’-ছ’খানা চেয়ার, ও কিছুতেই মেলাতে পারে না।
এই অন্ধকারের মধ্যে গামছা আনতে গেলে খুব সাবধানে হাতড়ে হাতড়ে পা টিপে টিপে ওখানে যেতে হবে। না-হলেই পায়ে চেয়ার বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে কিংবা ধাক্কা খেতে পারে ফ্রিজের সঙ্গে। একটু অসাবধান হলেই কনুইতে লেগে টিভিটাও পড়ে যেতে পারে। একটু গা মোছার জন্য অত কষ্ট করে পা মেপে মেপে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। শুয়ে থাকার সময় গরম লাগছিল ঠিকই, কিন্তু খাটে উঠে বসার পর থেকে যেন গরমটা আরও বেশি লাগছে। না। গরম নয়। গরমের চেয়ে বোধহয় আর্দ্রতাটাই বেশি। তাই এই ভাবে ঘামছে সে। বড় অস্বস্তি লাগছে। মা দেখলেই খিচখিচ করে উঠবে। কিন্তু মা তো ওই ঘরে শোয়। এখনও নিশ্চয়ই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ফলে এখন আর দেখার কেউ নেই। তাই বালিশের ঢাকনাটা চট করে তুলে নিয়ে ভাল করে বুক, পিঠ, হাত, মুখ মুছে নিল সে।
অন্যান্য জায়গার তুলনায় ওদের বাড়িতে কারেন্ট খুব কমই যায়। সে যাক। কিন্তু কারেন্ট যাওয়ার আর দিন পেল না! আজ সকাল থেকে যা গরম পড়েছে, তার উপর এতটুকু হাওয়া নেই। কোনও রকমে চোখ দুটো একটু বুজে এসেছিল। আর তার মধ্যেই এই অবস্থা!
এই ঘরে আগেকার দিনের মতো খড়খড়ি দেওয়া বড় বড় দুটো জানালা। আট বন্ধু মিলে কো-অপারেটিভ পদ্ধতিতে এই ফোর প্লাস বাড়িটার প্রতিটি তলায় একই আয়তনের দুটো করে, মোট আটটি ফ্ল্যাট বানালেও, যে যার ফ্ল্যাট নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। কেউ মেঝেতে মার্বেল বসিয়েছে তো, কেউ দুটি শোবার ঘরের একটাকে বড় করে অন্যটাকে একটু ছোট করে আলাদা একটা ঠাকুরঘর বানিয়েছে। ডোরবেলের জায়গায় সাবেকি আমলের মতো কেউ দড়ি টানা পেতলের বিরাট একটা ঘণ্টা লাগিয়েছে, তো কেউ একই ঘরের এক-একটা দেয়াল, উপরের সিলিং, এ দিক ও দিককার বিট এক-এক রং দিয়ে রাঙিয়েছে।
জুরানের বাবা তিতার মনে-প্রাণে, কাজে-কর্মে এবং চিন্তা ভাবনায় চূড়ান্ত আধুনিক হলে কী হবে, তাঁর ছোটবেলাটা কিন্তু কেটেছে গত ছ’পুরুষের মতোই, পূর্বপুরুষের তৈরি করে যাওয়া, ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকা কড়িবরগার প্রকাণ্ড একটা পাঁচ মহলা বাড়িতে। যে বাড়ি শরিকি বিবাদে কোনও দিনই সে ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। এ কার্নিশ সে কার্নিশ থেকে বট-অশ্বত্থের চারা একটু একটু করে ক্রমশ মাথা তুলছে। কিন্তু কেউই ভ্রুক্ষেপ করেননি। চুন-সুরকি খসে খসে দাঁত-মুখ বেরোলেও এক দলা সিমেন্টের প্রলেপও দেননি কেউ। বনেদিয়ানার চিহ্নস্বরূপ প্রধান ফটকের সামনে যে বিশাল তোরণটা ছিল, এক সময় আশপাশের লোকেরা যাতায়াতের পথে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখতেন। পরিচর্যার অভাবে সেটাও এখন শুধুমাত্র একটা লোহার কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। কেউ ভুল করেও ফিরে তাকায় না।
তিতার জানেন যত টাকাই থাকুক না কেন, আজকের দিনে ও রকম একটা বাড়ি বানানো আর কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। টাকা থাকলেও কেউ বানাবেন না। এটা জেনেও, সেই বাড়ির গন্ধটা এই বাড়িতে বজায় রাখার জন্য, তাঁদের সেই বাড়িটা যখন এক প্রোমোটার বিপুল টাকা দিয়ে কিনে নিলেন, তখন তিনি প্রোমোটারের কাছ থেকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ওই বাড়িটার একটা ইট আর এই জানালা দুটো চেয়ে নিয়েছিলেন।
কো-অপারেটিভের লটারিতে যখন তাঁর ভাগে চার তলার এই দিকটা পড়েছিল, তখন এই শোবার ঘরের কাজ শুরু হয়েছিল ওই ইটটা দিয়ে। আর এ ঘরেই লাগানো হয়েছিল সেগুন কাঠের তৈরি প্রায় দরজা-সমান খড়খড়িওয়ালা এই জানালা দুটো।
বাবার কাছে জুরান শুনেছে, এই জানালা দুটো এত ভারী ছিল যে, দূর থেকে ওই জানালা দেখে রাজমিস্ত্রিরা তাঁর মুখের উপরেই বলে দিয়েছিলেন, এ রকম পলকা দেওয়ালে অত ভারী জানালা কিছুতেই বসানো যাবে না। তখন তাঁদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁদের দিয়েই, ওই জানালা দুটোকে ধরে রাখার জন্য বিশেষ ভাবে পাকাপোক্ত করে গাঁথিয়ে নিয়েছিলেন এই দেয়াল।
ওর বাবা এখনও বলেন, এই জানালা দিয়ে যখন ফুরফুর করে হাওয়া ঢোকে, তখন নাকি সেই হাওয়ার মধ্যে তিনি তাঁর পুরনো বাড়ির গন্ধ খুঁজে পান। সেই গন্ধই তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ছোটবেলায়। তিনি খুঁজে পান তাঁর ছেলেবেলাকার সঙ্গী-সাথীদের। পাঁচ মহলা বাড়ির কানাঘুঁজি অলিন্দে তিনি তখন ছোটাছুটি করেন। চোর চোর খেলেন। দল বেঁধে হইহই করে পুকুরে যান। পুকুরের পার থেকে হেলে ওঠা খেজুর গাছে উঠে ঝপাং ঝপাং করে জলে ঝাঁপান।
একবার জলে ঝাঁপ দিতেই কে নাকি তাঁর একটা পা ধরে টানতে টানতে জলের অতলে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়। এই পুকুরে বাইরের কেউ নামে না। তা হলে কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে উনি টের পেলেন, তাঁর পাশ দিয়ে কী যেন সাঁ করে এসে তোলপাড় করতে লাগল জল। সাঁতার জানলেও এতক্ষণ জলের তলায় থাকার অভ্যেস ছিল না তাঁর। তাই দম নিতে গিয়ে কয়েক ঢোক জলও খেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। যখন আর পারছেন না, মনে হচ্ছে আর কোনও দিনই পারে উঠতে পারবেন না। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, ঠিক তখনই তাঁর পা ধরে যে এতক্ষণ টানছিল, সে ছেড়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন তাঁকে কোলপাঁজা করে তুলে দিয়ে গেল জলের উপরে। বুক ভরে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে যখন তিনি আশপাশে তাকালেন, দেখলেন কেউ কোত্থাও নেই।
এটা শুনে তিতারের বাবা থম মেরে গিয়েছিলেন। হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন তাঁর মা। বলেছিলেন, শরিকি শত্রুতা আজ এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, বাচ্চাদের প্রাণ পর্যন্ত নিতে চাইছে! আমি আর এখানে থাকব না। এক মুহূর্ত না।
বাবা বলেছিলেন, ঠিক আছে, কেউ না-হয় মারতে চেয়েছিল। কিন্তু ওকে বাঁচাল কে!
স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে জুরানের বাবা এখনও সেই গল্প করেন। আর একবার তাঁর ছোটবেলা নিয়ে গল্প শুরু করলে, তিনি আর কিছুতেই থামতে পারেন না। এই জানালা, জানালার সূত্র ধরে সেই পাঁচ মহলা বাড়ি, বাড়ি থেকে গ্রাম, গ্রামের মানুষ জন, ওখানকার বটবাবার পুজো… বাবাদের সেই বটবাবা নাকি এতটাই জাগ্রত ছিল যে, ওই বটগাছের কোনও ডালে লাল সুতো দিয়ে ছোট্ট একটা ইটের ঢেলা বেঁধে মানত করলেই, মাসও নাকি গড়াত না, হাতে-নাতে ফল পাওয়া যেত।
বাবাই বলেন, সেই পুজো নাকি টানা এক সপ্তাহ ধরে চলত। পুজো ঘিরে বসত বিশাল মেলা। মেলায় কত রকমের দোকান বসত। নাগরদোলা থেকে ইলেকট্রিক কন্যা, কিছুই বাদ যেত না। শুধু তাঁদের গ্রামই নয়, আশপাশের সব ক’টা গ্রামও ভেঙে পড়ত। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনেরা আগে থেকে এসে হাজির হত এর-ওর বাড়িতে। ও রকম উত্সব নাকি এখন আর কোথাও হয় না।
কেন হয় না? জুরান একবার জিজ্ঞেস করেছিল ওর বাবাকে। ওর বাবা বলেছিলেন, কী করে হবে? যে বটগাছটাকে ঘিরে ওই উত্সব হত, সেই গাছটাই যে একদিন প্রচণ্ড ঝড়ে উপড়ে গেল। গ্রামের লোকেরা ওটাকে বাঁচানোর জন্য কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। ফলে যাকে ঘিরে ওই উত্সব হত, সে-ই যখন নেই, কাকে ঘিরে মেতে উঠবে লোক?
তবু গ্রামের কয়েক জন মিলে গাছের ওই জায়গাটাকে গোল করে ঘিরে, ইট-টিট দিয়ে বাঁধিয়ে একটা বেদির মতো করে দিয়েছিলেন। কয়েক বছর ওই বেদিটাকে ঘিরে উৎসবটাকে চালু রাখার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু লোকজনের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। আস্তে আস্তে মেলাটাই উঠে গেল।
জুরান বলতে চেয়েছিল, যে-গাছ নিজেকেই বাঁচাতে পারে না। সামান্য একটু ঝড়েই উপড়ে যায়, সে গাছে লাল সুতো দিয়ে ইট বাঁধলেই লোকজনের মনস্কামনা পূর্ণ হত, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমার তো মনে হয় সবটাই কাকতালীয়।
কিন্তু এ সব কিছুই বলতে পারেনি সে। ওর বাবা যখন যা বলেন, জুরান মন দিয়ে সব শোনে। কিছু বলে না। বলতে পারে না— তোমাদের সময় ওটাই ছিল একমাত্র রিক্রিয়েশন। ওটার জন্য তোমরা সারা বছর ধরে মুখিয়ে থাকতে। আর ওটা শুরু হলেই, সবটুকু চেটেপুটে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগতে। অন্য কোথায় কত বড় মেলা হচ্ছে তা দেখার ফুরসতও পেতে না তোমরা। তোমাদের মনে হত, ওটাই বুঝি সব চেয়ে বড় মেলা। আর এই ধারণাটা তোমাদের মনের মধ্যে এমন ভাবে গেঁথে গেছে যে… তার উপরে ছোটবেলার স্মৃতি বলে কথা! তাই তোমার মনে হয়, অত বড় উৎসব আর কোথাও হয় না। এখন যদি তার থেকেও হাজার হাজার গুণ বড় কোনও উৎসবও হয়, দেখবে, তোমার ঠিক মনে হবে, না, এটা নয়, ওটাই অনেক বড় ছিল।
আসলে সময় পাল্টে গেছে। এখন যত বড় উৎসবই হোক না কেন, লোকেদের মধ্যে কিন্তু অত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায় না। কারণ, লোকের হাতে এখন আর অত সময় নেই। সমস্ত কাজকর্ম সেরে, সময় পেলে কেউ আর কোনও উৎসব-টুৎসবের ধার ধারে না। যে যার মতো করে বিনোদন খুঁজে নেয়। কেউ টিভি দেখে। কেউ ফেসবুক খুলে বসে। কেউ আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলে যায়।
ঘরেই এখন বিনোদনের এত ব্যবস্থা হয়ে গেছে যে, কেউ আর কোনও মেলা কিংবা কোনও উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে না। দেখো না, এখন আর ক’জন চৈত্র মাসের গাজনের মেলা নিয়ে মাতামাতি করে? ক’টা লোক কাঁটার উপর ঝাঁপ দেয়? ক’টা লোক মাছ ধরার বঁড়শি বুকে ফুঁড়ে চড়কিতে বনবন করে ঘোরে? রথের মেলাও কি আর আগের মতো অত জমজমাট করে হয়? দোল খেলার রমরমাও কি অনেক ফিকে হয়ে যায়নি?
না। বাবাকে সে এ সব কথা বলতে পারে না। বললে, বাবা হয়তো দুঃখ পাবেন। বাবা দুঃখ পাবেন, এমন কোনও কথাই সে বাবার সামনে উচ্চারণ করতে পারবে না। বাবার ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে বাবা থাকুন। থাকুন তাঁর জানালা নিয়ে। জানালা দিয়ে আসা ছেলেবেলার গন্ধ মাখা ফুরফুরে সে-ই হাওয়া নিয়ে।
জুরান যখন এই সব ভাবছে, তার পিঠ দিয়ে তখন দরদর করে ঘাম নামছে। ও বালিশের ঢাকনাটা নিয়ে আবার বুক, পিঠ, হাত, মুখ মুছে নিল। উফ্, আর পারা যাচ্ছে না। কারেন্টই গেছে তো, নাকি ফিউজ উড়ে গেছে! জানালা দিয়ে একবার দেখি তো, আশপাশের বাড়িতে লাইট জ্বলছে কি না।
জুরান খাট থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালার বিশাল বিশাল কপাট দুটো হাট করে খোলা। কিন্তু সেখান দিয়ে এক ফোঁটাও বাতাস ঢুকছে না। বাতাস যে বইছে না, তা নয়। জানালার কাছে এসেই বাতাস যেন থমকে দাঁড়িয়ে অভিমান করে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু না। এ রকম তো হওয়ার কথা না।
এই ক’বছরে তাদের বাড়ির আশপাশে, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বড় বড় বাড়ি মাথা তুললেও, তাদের এই জানালাটা কী করে যেন বারবারই ছাড় পেয়ে গেছে। আসলে এ জানালার মুখোমুখি যে ক’টা বাড়ি আগে ছিল এবং পরে হয়েছে, সেগুলি সব ক’টাই হয় দু’তলা নয়তো তিন তলা। সে জন্য এই জানালার সামনেটা একেবারেই ফাঁকা। ফলে আশপাশের বাড়ির তো বটেই, এই বাড়িরই অন্য ফ্ল্যাটের লোকদের দিনের বেলাতেও অনেক সময় লাইট জ্বালাতে হয়। কিন্তু ওদের তা কখনওই করতে হয় না। অন্তত এই ঘরে তো নয়ই।
কিন্তু এখন তো গভীর রাত। চার দিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। অথচ লাইট যে জ্বালাবে তারও উপায় নেই। লোডশেডিং। তাই জানালা দিয়ে যতটা দেখা যায়, ও দেখার চেষ্টা করল। দেখল, একটা-দুটো বাড়িতে শুধু আলো জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো ইনভার্টার বা জেনারেটারে জ্বলছে। তার মানে, শুধু তাদের বাড়িটাই নয়, গোটা এলাকাটাই অন্ধকারে ডুবে আছে। অর্থাৎ লোডশেডিং-ফেডিং নয়, নিশ্চয়ই ম্যাসিভ কোনও ম্যাসাকার হয়েছে।
জুরান এ দিক ও দিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ চোখ আটকে গেল সামনের তিন তলা বাড়িটার ছাদে। সে চার তলার ঘরে। ফলে তিন তলার ছাদটা খুব ভাল করেই দেখতে পাচ্ছে সে। তিন তলার ছাদে বিশাল বড় একটা সিমেন্টে বাঁধানো কেটলি। কেটলির মুখের কাছে বড় একটা প্লেটের উপরে মানানসই মাপের কারুকাজ-করা একটা কাপ। না। কেটলি না। ওটা আসলে একটা জলের ট্যাঙ্ক। আর কাপ-প্লেটটা এমনিই বানানো। ওই বাড়ির ভদ্রলোক বড় শখ করে ওটা বানিয়েছেন। ও সেটা জানে। কিন্তু তার পিছনে ওটা কী? একটা গোলাকার আলোক পিণ্ড না! হ্যাঁ, তাই তো! ওটা আবার লাইটের কোনও কারসাজি নয় তো! লোকটার যা মতিগতি, সব পারে। কিন্তু ওটা তো ঠিক লাইটের আলো নয়। ভারী অদ্ভুত এক মায়াবী আলো। মাঝে মাঝেই কেটলিটার পাশ দিয়ে একটু উঁকি মেরেই আবার লুকিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, তার সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলছে। কী ওটা? কী?
চলবে…