আমি যতবার কক্সবাজার গিয়েছি, সংখ্যাটি সংখ্যাতীত নয় অবশ্যই, তবে অনেক, মহেশখালী দ্বীপ আমাকে টেনেছে। প্রতিবারই যে আমি মহেশখালী চ্যানেল পার হয়ে মূল ভূখণ্ড পেরিয়ে দ্বীপটিতে যেতে পেরেছি, তা নয়, তবে আকাঙ্ক্ষা পুষেছি। শতবাঁকের বাঁকখালি নদী, তার তীরে বা বুকে মাছধরার সমুদ্রগামী ট্রলার বা সাম্পান, বঙ্গোপসাগরের প্রশস্তমুখ, চ্যানেলে সামুদ্রিক ঢেউয়ের দোলা, ওপাড়ে দ্বীপটির জলমগ্ন বৃক্ষসারিতে তৈরি সবুজ পটভূমি আমাকে টেনেছে। যা আমাকে টানেনি তা হলো মহেশখালী বাজারটি। এই আধুনিকযুগে অমন একটি অপরিকল্পিত বাজার, এর নাম গোরকঘাটা, থাকতে পারে, ভাবা যায় না। সরু পথ, তার অর্ধেকটা জুড়ে যাত্রী অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ইজিবাইক ও রিকশার সারি, রাস্তার গায়ে লেগে থাকা একতলা শ্রীহীন দোকানপাট, মানুষের ভীড় ও ট্রাফিক জ্যাম বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। এসব পেরিয়ে আপনি যখন বড় দীঘির প্রশস্ত জলপরিধি দেখবেন, মন ভালো হয়ে যাবে। আল আমিন হোটেলে ঢোকার আগে ও পরে আমি একমিনিট পায়ে হাঁটা দূরত্বে থাকা দীঘিটি দেখে আসি। এর পশ্চিম পার্শ্বে উপজেলা অফিসগুলো, শহীদ মিনার। কবি হাফিজ রশিদ খান যান পান খেতে। হেসে বলেন, ‘আমি পানাসক্ত।’ আমরা হেঁটে সেই মোড়টিতে যাই যেখানে ইজিবাইকের চালকরা সড়কপথে মহেশখালী থেকে চকরিয়া যাবার সেঁতু পর্যন্ত যাওয়ার প্রলোভনে জড়ায়। সময় নেই, নইলে যেতাম দ্বীপের স্বাতন্ত্র্য আর জলবেষ্টিত থাকার অহঙ্কারকে হুমকিতে ফেলা সেঁতুটি দেখতে। চা পানের প্রস্তাব ওঠে, আমরা ওপাশের দ্বিতল ও স্লিম মার্কেটটির সেই চা-দোকানে গিয়ে বসি, যেখানে মহেশখালীর তরুণ কবিরা (দীপাঞ্চল সাহিত্যগোষ্ঠী) আমাকে ‘মৈনাক সম্মাননা’ প্রদান করেছিল। দুজন নতুন যুবকের সাথে পরিচিত হই, এরা হলেন শাফায়াত জামিল দিদার এবং আর. করিম। প্রথমজন গানের শিল্পী, দ্বিতীয়জন চিত্রের শিল্পী।
সুব্রত আপনের আপণের সমুখে ততক্ষণে এসে গেছে সোনাদিয়া যাওয়ার ইজিবাইক (এরা বলে টমটম)। স্থানীয় তরুণ কবিরা অনেক বোঁচকাবুচকিসহ সেটি ভরে ফেল্ল, মুরগী যেমন আছে, মুরগীর ডিমও তেমনি আছে। সুব্রত আপন বসেছিল ডিমের পাশে, সে যেন সুযোগ বুঝে কাঁচা ডিমই না খেয়ে ফেলে বলে মজা করলেন কবি জাহেদ সরওয়ার। তিনি এদের মাঝে সিনিয়র। বলশালী গঠন আর দীর্ঘদেহী এই কবিকে দেখলে সাহস বাড়ে। ঝড়-ঝাপটা সামলানোর হিম্মত তার আছে, দলের ভিতর তার মাথাটিই সবার উপরে। তার ব্যক্তিত্বের চমৎকার দিকটি হলো নিজ দ্বীপের তরুণ কবিদের যে কোনো সাহিত্যিক উদযোগে পাশে থাকেন, সমর্থন দেন। তরুণ কবিকুলের অঘোষিত নেতা কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু এসেছে লুঙ্গি পরে, পায়ে চপ্পল। ঢাকা থেকে সোনাদিয়ার জন্য আমাকে যে তিনটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিষ আনতে বলেছিলেন কবি হাফিজ রশিদ খান লুঙ্গি ও চপ্পল তার অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়টি হলো ছাতা। সাইয়্যিদ মঞ্জু এসেছে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার পারফেক্ট ড্রেসকোডে। যিনি লুঙ্গি আর চপ্পলের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই হাফিজ রশিদ খান কিন্তু পরে আছেন সবুজ রঙের প্রিন্ট শার্ট আর ট্রাউজার।
প্রথম টমটম চলে গেছে, আমরা অপেক্ষা করি তখনো অনুপস্থিত একজনের জন্য। কোর্ট রোড থেকে বড় দীঘির পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে সেই ভীড়বহুল, সরুরাস্তার গোরকঘাটা বাজারের দিকে যাই। যিনি আসবেন তার নাম জাহাঙ্গীর, তিনি একজন গায়ক। যেখানটায় দাঁড়াই সেখানে বেশ ভীড়, দুটি নবনির্মিত দালান চোখে পড়ে। পেছনে এক দোকানে পেয়াঁজু ভাজা হচ্ছে, জাহেদ সারওয়ার প্রস্তাব দিল খাওয়ার। আমরা সবে দুপুরের আহার করেছি, এখম পেয়াঁজু হোক কিংবা চিকেন (আবার চিকেন?) ফ্রাই – কিছুই মুখে রোচবে না। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি পেছনে জাহেদ সরওয়ার নেই। সে গিয়ে বসেছে সেই দোকানে, দেহের সমানুপাতে এক বড় বাটিতে পেয়াঁজু মুড়ির সাথে মিশিয়ে আরামছে খাচ্ছে। দোকানটি সাদামাটা, ভালো লাগে তার বসার বাক্স টাইপ বেঞ্চিগুলো আর টেবিল চেয়ারের ঘন সমাবেশ। ঘন হলেও এখানে আমরা আমরাই, জনতা থেকে দূরে, করোনার সামাজিক দূরত্ব মানা যাচ্ছে। বসেছি যখন তখন পেয়াঁজু খাওয়াই সৌজন্যবোধের পরিচয় আর পেয়াঁজু হলো এমন খাবার যে ভরপেটেও গোটাদশেক (এগুলোর সাইজ ছোটো) সাবার করে দেওয়া যায়, বিশেষ করে সঙ্গে যদি জোটে পেয়াঁজ ও মরিচ। পেয়াঁজু খেতে পেয়াঁজ? খেয়েই দেখুন না কী দারুণ স্বাদ, বিশেষ করে যদি কাঁচালঙ্কার ঝাল মেশে। এই রত্নভাণ্ডারের সন্ধান দেওয়ার জন্য কবি জাহেদ সরওয়ারকে ধন্যবাদ জানাই।
বিকেল চারটা গড়িয়ে সাড়ে চারটার দিকে যাত্রা করেছে, প্রথম দলটি সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার ঘাটে পৌঁছে গেছে, আমরা এখনো যাত্রাই শুরু করতে পারলাম না। মূল আয়োজক সাইয়্যিদ মঞ্জু অবশ্য এখনো জোয়ার লাগেনি বলে প্রবোধ দিতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে সেও উদ্বিগ্ন। কেননা, সে জানে এই দলটি সোনাদিয়ার সৈকতে সূর্যাস্ত দেখতে আগ্রহী। দোকানের বাইরে এসে আমি অবাক। কোন অবসরে মঞ্জু লুঙ্গি আর গেঞ্জি চেঞ্জ করে প্যাট শার্ট পরিধান করেছে কে জানে। তবে কি অরিজিনাল ড্রেসকোড বলে কিছু রইল না। আমি তাকে পাশ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি, মঞ্জু কখন পোষাক পাল্টালেন? দেখি মানুষটি মঞ্জু নয়, মঞ্জুর মতো দেখতে। তার নাম রাসেল উদ্দিন। হুবহু এক হয়তো নয়, তবে দুজনের মিলটি চমকপ্রদ। যার জন্য অপেক্ষা সেই জাহাঙ্গীর এসে পড়ে। সেও একজন গায়ক, আইয়ুব বাচ্চুর এতটা গভীর ভক্ত যে নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছে ব্যান্ড মিউজিকের প্রখ্যাত গায়কের নাম। এখন তার নাম জাহান এ, বি। এ, বি, হলো আইয়ুব বাচ্চুর সংক্ষিপ্তরূপ। দেরির কারণ তার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। শুনে হাফিজ রশিদ খান বল্লেন, এরকম পরিস্থিতিতে আমি স্ত্রীকে রেখে সোনাদিয়া যেতাম না। এতে বোঝা গেল আমরা তাকে যতই বোহেমিয়ান ভাবি, সে তত বোহেমিয়ান নয়, ভেতরে ভেতরে অনেকখানি সংসারি। তবে জীবনের অনেকটাকাল তিনি বোহেমিয়ানই ছিলেন। সংসার নামক চৌম্বকক্ষেত্র তাকে কেন্দ্রাতিগ বলে আঁটকে রেখেছে সংসারে। আমি জানি কবি হাফিজ রশিদ খান খুব স্নেহশীল বাবা।
জাহান এসে গেলে জোয়ারও এসে যায়, আমরা টমটমে চড়ে বসি। গোরকঘাটা বাজারের অদেখা সব গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে এক আকাশ উদ্ভাসিত বিরাট জলপরিধির কাছে এসে পড়ি। আমি ভেবেছিলাম অন্য আরেক দীঘি। রাসেল উদ্দিনকে যেমন মঞ্জু ভেবেছিলাম। তখন মনে হলো টমটমের অত বাহাদুরি, অত কোমরদোলানো ছুট, শেষে সেই বড় দীঘি? তাহলে তো কেচে গণ্ডুষ, বা ইংরেজি বর্ণমালার A এবং B।
(চলবে)