জেটিকে টোল ঘরের সাথে সংযুক্ত করা কাঠের সেতুর উপর কবি মিজান মনিরকে দেখা গেল ঘর্মাপ্লুত ও লজ্জিত। ঘর্মাপ্লুত, কেননা গুগলের আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সূর্য উঠেছে পূর্ণরূপে। লজ্জিত, কেননা তার দেরি হয়েছে আসতে। দেরির কারণও বোঝা গেল হাতের ভারি ব্যাগ দেখে। বড়ো বাক্সটি যে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিনের কেক তা শিশুও বুঝতে পারবে। ব্যাগের ভিতর বেলুন ও অগ্নি শলাকা দেখে কৌতুক অনুভব করি। বুড়ো খোকার জন্মদিন তাহলে বেশ জমজমাট ভাবেই পালিত হবে।
ভেবেছিলাম মিজান মনির দেরী করে আসার ঘাটতি মেটাতে তড়িঘড়ি আমাকে নিয়ে একটি স্পিড বোটে উঠবে। কিন্তু হা হতোম্মী! তার দেহভাষা বিপরীত, সেখানে কোনো তাড়া নেই, রয়েছে অধীর অপেক্ষা। আরেকজন আসবেন। একই সাম্পানের ছবি কয়েকবার তোলা হয়, তবু তিনি আসেন না। এদিকে বেলা বাজে আড়াইটা, দুপুর চলেছে তার উত্তপ্ততম সময়ের দিকে। কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু ফোন করে জানতে চায় আমরা কোথায় আছি। যখন শোনে আমরা ঘাটে, পরের অংশ বলা হয়নি, সে ভেবে নেয় আমরা মহেশখালি ঘাটে। আমরা যে এখনো এই পারে পড়ে আছি, সে ভাবতেও পারে না। আমি ভাবি, মনিরও চিন্তিত, এই উত্তাপে জন্মদিনের কেক নিজের শরীরের বাঁধন ধরে রাখতে পারবে তো?
‘এত মাছ ধরার ট্রলার তীরে কেন?’ আমি মিজান মনিরকে জিজ্ঞেস করি। সেকথা শুনে ফেলে হাসেম নামের এক ইলিশ ব্যবসায়ী। উত্তরটা আসে তার দিক থেকেই। সরকার সমুদ্রে ইলিশ মাছধরা নিষিদ্ধ করেছেন ৬৫ দিনের জন্য। এসময় মা ইলিশ ডিম ছাড়ে সমুদ্রে। তাই ওই নিষেধাজ্ঞা। ‘ট্রলারগুলোর দাম কেমন?’ পুরনো ছোটো ট্রলার ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা; বড়োগুলো ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ। এক কোটি টাকা দামের ট্রলারও আছে, সেগুলো নতুন। ‘সমুদ্রের ইলিশের স্বাদ কেমন’ হাসেমকে জিজ্ঞেস করি। ‘খুবই সুস্বাদু,’ তার উত্তর। আমার ধারণা ছিল সামুদ্রিক ইলিশ নোনতা স্বাদের, স্বাদু হলো নদীর ইলিশ। হাসেম তো সেই ধারণা পাল্টে দেবার জন্য সচেষ্ট। সে বল্ল, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ডালা বা জো, সে সময়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে।
যার জন্য এত অপেক্ষা অবশেষে তিনি এলেন। তার নাম জি এম সামদানী, কক্সবাজারের একটি মাদ্রাসায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক। বিলম্বের জন্য তিনি আরও বেশি লজ্জিত। তার বিলম্ব যে ঢের বেশি। আমরা যদিও কারণ জানতে চাইনি, তিনি নিজেই কারণ জানাতে উদগ্রীব, অপরাধ বোধ থেকে উদ্ধার পেতে তার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। ইজিবাইক তাকে ৬ নম্বর ঘাট ছাড়িয়ে, বিমানবন্দর ছাড়িয়ে চলে গেছে নুনিয়ার ছড়ায়, পথটির শেষপ্রান্তে, কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে। তিনি টের পাননি বা খেয়াল করেননি (ঘুমন্ত মানুষ অবশ্য টের পায় না)। অথচ ওই সড়কের গোড়ার দিকটায় তার বাসা, তিনি সেখানে থাকছেন বহু বছর ধরে। বাতাস বইছে প্রাণ জুড়ানো, সেই বাতাসে গান ধরেছে কয়েকজন যুবক। তাদের গানের ভেতর ডুবে গেল নুনিয়ার ছড়ার কাহিনী। আমরা একটি স্পিড বোটের দিকে এগুই, পাশের গান বোটে এক নতুন বৌ এসে চড়েছে, সাথে আত্মীয়-স্বজনেরা। যেটা খুবই লক্ষ্যণীয় সেটা হলো কারো মুখে কোনো মাস্ক নেই।
বাঁকখালি নদীর ওপারে দরিদ্র মানুষদের জন্য নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ম্যাচ বাক্সের মতো দেখতে দালানগুলো গত ছয়মাসে তৃতীয়বার দেখলাম। প্রশংসনীয় এ উদ্যোগ। স্পিড বোট যখন চ্যানেল পাড়ি দিচ্ছিল তখন নীলাকাশে সাদা মেঘের দৃশ্য ঢেউয়ের বিরুদ্ধতার ভয় কাটাতে সাহায্য করছিল। স্পিডবোট চলে এঁকেবেঁকে, বিপরীত বোটগুলো সৃষ্ট ঢেউ এড়াতে, সাগরের ঢেউ কাটাতে। দেখি ভূমি অনেকদূর তার জিহ্বা প্রসারিত করে রেখেছে, জি এম সামদানী জানালেন ওই অংশটির নাম চৌফলদন্ডী। কুরুশকুল ও চৌফলদন্ডীর মাঝে একটি সংযোগ সেতু আছে। আমি ভাবলাম কবি হাফিজ রশিদ খান কি ওই সেতু পেরিয়েই মহেশখালি গেলেন নাকি না? জি এম সামদানী বল্লেন, না, তিনি চকরিয়া থেকে বদরখালি সেতু পার হয়ে এসেছেন।
আমরা বেলা তিনটায় মহেশখালি পৌঁছাই। ওখানেও বাঁকখালি নদী। অর্থাৎ মহেশখালি চ্যানেলের নিচে একটি নদী রয়েছে লোনা জলের অতলে তলানো। সিমেন্টের সংযোগ সেতুটির উপর কবি নিলয় রফিককে দেখি পানের দোকানে পান কিনছে। মিজান তাকে অনুরোধ করে, সোনাদিয়ার দলে যোগ দিতে। তার উত্তর শুনে স্তম্ভিত হই। সে বলে, ‘আমি কোনো ধর্ম-কর্ম করি না।’ ধর্ম-কর্মের সাথে অসাম্প্রদায়িক কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালনের কী সম্পর্ক ভেবে পাই না। যা হোক তার সাথে বাৎচিত চালিয়ে কোনো লাভ হবে না জেনে চলে আসি। আমাদের ইজিবাইক এসে থামে আল আমিন হোটেলের সমুখে। এর কাছেই বড়ো দীঘিটি তেমন সুন্দর নয় মহেশখালি সদরের বৃহত্তম সৌন্দর্য জল পরিধি। এখানে সুব্রত আপনের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কবি হাফিজ রশিদ খানের দেখা পাই। তিনি এসেছেন আগেই, অভুক্ত অপেক্ষা করছিলেন আমার সাথে দুপুরের আহার করবেন বলে।
মাছের জন্য বিখ্যাত ‘আল আমিন’ হোটেলে মাছ নেই, কারণ বেলা তখন সাড়ে তিনটা, সব মাছ চলে গেছে ভোক্তাদের পেটে। মাছদের প্রতিনিধি হয়ে, যদিও অনেকে তাকে মাছ বলতে রাজী নন, চিংড়ি এলো। আর মাছের প্রতিদ্বন্দ্বী মুরগী। মুখোমুখি বসে দুই কবি, আশির দশকের দুই কবি প্রতিনিধি, প্রতিদ্বন্দ্বী তারা কখনোই নন, চিংড়ি ও মুরগীকে কব্জা করেন আর আক্ষেপ করেন কতকাল দেখা হয়নি। একটু আগে দেখেছেন আমি ছোটো নোটবুকে নোট নিচ্ছি। বল্লেন, ‘এটা ভালো। স্মৃতিকে বিশ্বাস নেই। স্মৃতি বড়ো প্রতারক।’
(চলবে)