সন্তর্পণে চারদিক দেখল সুখী। সুখী সিং। লোকমুখে সুখা। বুকভরা একটা শ্বাস নিল। কিসের একটা গন্ধ! নাকে ঢুকতেই তাড়া খাওয়া হরিণীর মত পা চালিয়ে জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেল।
একটু আগে মেচী নদীর ঠাণ্ডা জল ওর হাঁটু অবধি দু-পা কামড়ে ধরেছিল। অনেকক্ষণ সাড় ছিল না। টালমাটাল পায়ে শুকনো বালির ধু ধু চর ডিঙিয়েছে ও। নেপাল পেড়িয়ে এখন ইন্ডিয়ায়। দু-পাশে চোখা চাহনি বুলিয়ে জঙ্গলটা পার হল। সামনেই চা-বাগান। একটু দম নিল সুখা। আঁচল দিয়ে মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বড় পেটটায় হাত বুলাল। তল থেকে উপর, শুকনো স্তনের খাঁজ থেকে বস্তীদেশ। ন-মাসের পোয়াতির মত বড় পেট। পেটের ভারে এখন ধীর চলন সুখার। পোয়াতির মত আড়ষ্ট পায়ে থপ থপ হাঁটছে। দ্রুত চলতে পারলেও এভাবেই হাঁটবে সুখা। অসাবধানে জোরে হাঁটলেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাবে।চা-গাছে ছায়া সোহাগী জারুল, শিরিষ, মনজিরি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুলিশ বুট পায়ে লাথি মারবে পেটে। মাথা-ছাটা মজবুত চা-গাছের উপর ছিটকে পড়বে সুখা। শিরদাঁড়ায় চোট লাগবে। কোমরও ভাঙতে পারে। সেটা ভাঙ্গুক। ভাবছিল সুখা। কোমর ভাঙলেও পেটের মালটা যেন ঠিক থাকে। কত হাজার দাম কে জানে! নেপালের ধুলাবাড়ি বাজারে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে মালটা তুলে দিয়েছিল প্রদীপের মহাজন। ধুলাবাড়ি থেকে বাসে করে নেপালের চেকপোস্ট, কাঁকড়ভিটা। চেকপোস্টের আগে নেমে জঙ্গলে ঢুকে মালটা ভালো করে বাঁধল পেটে। পোয়াতি মেয়ের মত ফোলা পেট। গর্ভবতী মেয়েদের গায়ে দু’পারের কোন পুলিশই হাত দেয় না। তবু ধরা পড়ে যাবার ভয়! দামি মালটা চোর-বাটপারের কেড়ে নেবার ভয়। তার চেয়ে বেশী ভয় ওয়াংদিকে। ইন্ডিয়া চেকপোস্টের বড় অফিসার। একবার ধরতে পারলেই লাঠির বাড়ি মেরে হাজতে ঢুকিয়ে দেবে। তারপর জেল। বিড়বিড় করল সুখা, ‘শালা ওয়াংদি, হারামির বাচ্চা। খালি আং সাং করিচে। মাল ঢুইবার সব কটা পথ বন্ধ করি দিচে। শালা মরিব নাকি হামরা?’
মারবার জোগাড় করেছে ওয়াংদি। লাইনে এত দিনেও ওয়াংদির মত একটা কড়া অফিসার দেখেনি সুখা। ওর নাম শুনলেই বুক ঢিব ঢিব করে। অবশ্য স্মাগলিঙের চেনে ঢুকবার পর ওকে সাহস জুগিয়েছিল প্রদীপ। ‘দিদি, আমরা হলাম পুলিশের জামাই। শালা কে কী করে? মাসে মাসে মাইনা দিই ওদের। পূজায় কাপড়-জামা, বুঝলি? চেক পোস্টে আমার নাম বললেই মাল ভর্তি ট্রাক ছেড়ে দেয়। টিপির কাগজ পত্তর দেখবে না।’প্রদীপের চেনে ঢুকে একটু সাহস পেয়েছিল সুখী। সাবধানে বর্ডার পার হয়ে অল্প মাল আনছে। কিন্তু বাকী পাচারকারীদের কারবার ওয়াংদির ভয়ে একদম শেষ। সাত দিন ধরে নদীর চড় আর এপারটা শুনশান। চুলা জ্বলেনা এপার ওপারের অনেক ঘরে। কাজ কাম ছেড়ে মানুষগুলো ঘরে বসে আছে। ওদের কথা ভেবে ঠোঁট নড়ল সুখার। ‘সব শালা ভদ্দরলোক বনি গেচে। ভাত নাই প্যাটে। অ্যালায় ঘরত বসি মাল টানে চোঁ চোঁ’। ‘মাল টানে চোঁ চোঁ’ কথাটা কি একটা সিনেমায় শুনেছিল ও। আজকাল সিনেমা দেখছে খুব। নেশা ধরে গেছে। সপ্তাহে একটা সিনেমা না-দেখলে মনটা ফিকা লাগে। হলে টিকিট কেটে সিনেমা দেখার পয়সা না-থাকলে বাসস্ট্যান্ডে পরিমলের ঘুপচি মদের দোকানের পাশে বিনা পয়সায় ভিডিও দেখে ও। সিনেমা দেখে আর দু’বছর লাইনে কাজ করে কথায় জেল্লা এসে গেছে। সিনেমার ডাইলগ আর লাইনের খিস্তি ঠোঁটের ডগায় হুটহাট এসে যায়।হঠাৎ কী একটা আওয়াজে চা-গাছ গুলোর ফাঁকে খরগোসের মত মাথা গুঁজল ও। পেটের বড় জিনিসটা খোঁচা মারল বুকে। কিছুক্ষণ মাটিতে থেবড়ে পড়ে থাকলো। শুকনো পাতায় হালকা আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলল ও। খাকি পোষাকে থ্যাবড়া মুখো ওয়াংদির বদলে একটা হুলো বিড়াল। খস খস আওয়াজ তুলে নিরীহ জানোয়ারটা চা-বাগানের সবুজ সমুদ্রে হারিয়ে গেল। ওদিকে তাকিয়ে থুতু ফেলে খিস্তি ঝাড়ল সুখা, ‘হৈ শালা, হারামি বিল্লি’। তারপর নিজের মনে খুক খুক হাসতে লাগলো। ধীরে ধীরে ভারি পেটটা বাঁ-হাতে ধরে উঠে দাঁড়াল ও। ডান কনুইয়ের ছড়ে যাওয়া অংশটা সবুজ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছল। তারপর আকাশের নীলে মিলমিশ সবুজ বাগিচার আনাচ কানাচে ঘাড় ঘুরাল। কোথাও মানুষ নেই। জমিদারগুরির রুপালী, মুংলি, সাত ভাইয়ার আবু, আরতি কেউ আসেনি। ভয়ে শিটিয়ে গেছে মেয়ে গুলো।
সুখাও তিন দিন বাড়িতে বসে ছিল। কিন্তু আজ রাগে জ্বলতে জ্বলতে ঘর ছেড়েছে। মেয়েটার উপর রাগ। বুড়া মানুষটার উপর গুসসা। দিমাক খারাপ করে মরদটাকে আজ হান্টারবালির মত খুব ঠুসেছে।
-ভাত কাপড় দিবার না পারিস আবার লেকচার?
-কিষাণের বৌ তু। ঘরত কাম কর। রাগী মুখে হুঙ্কার ছেড়েছিল কদম সিং।
-বালাসনের পারত তো পাথর ভাঙতিস। পার্টী ভেস জমি দখল নিল তো চাষি হোল। আবার কিষাণের দিমাক দেখাচুস?’ রাগে জ্বলতে জ্বলতে কথা গুলো ছুড়ল সুখা।
-উসব ধান্দা বাজিত আমার পার্টীর সায় নাই। চাষের কাম তোক করতে হব্যাক।‘ পিঠ সোজা করে রুখে দাঁড়াল বুড়ো মানুষটা।
কেউটে সাপের মত ফনা তুললো সুখা, ‘চাষ করিয়া বউ-ছাওয়াল তো ভাত-কাপড় দিবার না পারিস। এক দিনত লাইন থাকি মোর তিন-কুড়ি কামাই। মুই মরিযাম, কিন্তু কাম-ধান্দা ছাড়িব নাই।’
নিঃশব্দ দ্রুততায় পাথুরে পথ ভাঙতে ভাঙতে কথার জাবর কাটছিল সুখা। ‘ঘরত কি কম লাগে? একটা ছাওয়াল, দুইটা মাইয়া। বড় মাইয়া তো সমত্থ মাগী। বিদ্যাধরী হবার তনে ইস্কুলৎ যাচেন। বড় পরীক্ষা নাকি দিবেন ইবার। ছোট মাইয়াটার নেকাপড়ায় মন আছিল। ইস্কুলৎ আর যায় না। বাপ তো জনমখান দিয়াই খালাস। কিছু করিবার মুরাত নাই। গেলা বচ্ছর যাইলে (যখন) লোকটা পাট মারছিল, ছোট ছাওয়ালটা হইছিলা। বাচ্চার শরীরে শীতের ত্যানাটাও মুই দিম?’
বড় একটা শ্বাস ফেলে মাড়ির খাঁজ থেকে এক দলা খৈনি থু থু করে ফেলল ও। প্রচণ্ড পিপাসাতে ঠোঁট আর থুতনির ঘাম চাটলো।বড় মেয়ে বিনার উপর গর্জাতে গর্জাতে আজ তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়েছিল সুখা। মাষ্টারের বাড়ি পড়ে এসে বুকে সাঁটানো বই-খাতা ফেলে মেয়েটা বলেছিল, ‘মা ভাত দে। খিদা নাগছে খুব।’ রাতের রান্না করা ভাত থালায় তুলছিল সুখা। তেল বাদে পেঁয়াজ-লবণ সবই ছিল ঘরে। তখন মুখ সোয়াদি করে বিনা বলল, ‘জামার বগলটা ফেসি গেছে মা। মাষ্টারের সামনে যাতি লজ্জা করিছে। শাড়ি জামা সব ফুটিফাটা।’
মেয়ের কথায় চড় চড় করে রাগ উঠে গেছিল মাথায়। বড় একটা মুখ ঝামটা মেরে গলা চড়াল, ‘তোর বাপক ক। মুরাত নাই তো বাপ হচিলা ক্যানে। জামার তনে পূজায় মুরগি বেচনু। এ্যালায় কি নিজক বেচমু?’ ‘খারে মাগী’ বলে হাতের থালাটা মেয়ের দিকে ঠেলে উঠানের দড়িতে টাঙানো শাড়িটায় টান দিল। ধাপে ধাপে গলা উঠছিল সুখার, ‘মুই কাম না করিলেই সনসার শ্মশান। ধিঙ্গি মাইয়া গুলান হামাক শেষ করি দিল্।’ছোট ছেলে রতনকে কোলে নিয়ে পিছু ডেকেছিল কদম। সুখা ফেরেনি। চিন্তা সিং জোত থেকে দু’ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে চেকপোস্ট, বর্ডার, মেচী নদীর লম্বা ব্রীজ পেড়িয়ে কাঁকড়ভিটা। বাসে চেপে সোজা ধূলাবাড়ি বাজার। প্রদীপের মহাজন, বালিরাম চিৎলাঙ্গিয়ার বাহারি দোকান। ওখান থেকে মালটা সঙ্গে নিয়ে মেচী নদীর বরফ গলা জল ভেঙে এখন ইন্ডিয়াতে। আরেকটু হাঁটলেই বাঁধানো বড় রাস্তা। ওখান থেকে চেনা বাসে উঠে সোজা শহরে চম্পট দেবে ও।
বাস রাস্তার ধার ঘেঁষে ফুদনের দোকান। দোকানের পিছনে চাটাইয়ের নামানো ঝাঁপ। ঝাঁপের আড়ালে ছায়ায় দাঁড়াল সুখা। উত্তেজনা বুকে চেপে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে এখন ঘাম ঝরছে শরীরে। টলমল করছে সুখার শরীর। শীতের তিরতিরে বাতাস ক্লান্ত শরীরে আরামের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আরামের ঘুম নামছে শরীরে। কিন্তু চোখ বন্ধ করবার ফুরসত নেই। চোখ খোলা রেখে বাসের আওয়াজ শুনতে কান খাড়া করল সুখা। ঠিক তখন খিদের যন্ত্রণা টের পেল। পেটের নাড়িভুঁড়ি মোচড় দিয়ে উঠছে। বিড়বিড় করে সুখা, ‘পোয়াতি সাজিয়া মাইল মাইল ঘুরি মুই খাবার জোগাড় করিচে। সেদিখত কারুর হুঁশ নাই। মা-খোয়াকি বিটির আবার জমিদার মাইয়ার নাকাম হুকুম। জামা দ্যাও, টাকা দ্যাও। ধিঙ্গি মাইয়া শালা। বেজন্মা। মর মর…।’কানে একটা শব্দ ঢুকতেই মুহূর্তে বদলে গেল সুখা। হুসস করে পুলিশের একটা জিপ ফুদনের দোকানের সামনে এসে থামল। দু’পা থর থর কেঁপে উঠল সুখার। ভয়ের হিমস্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে। ঢিপ ঢিপ বুকটা দেয়ালে সাঁটিয়ে ঝাঁপের ফুটোয় চোখ রাখল ও। আধো অন্ধকার ঘর। টর্চ জ্বেলে মাচার নীচটা তন্ন তন্ন করল পুলিশ। তিনটে আপ্সু রামের বোতল পেয়ে বেঁটে পুলিশটা ঝাঁপিয়ে ফুদনের চুলের মুঠি ধরে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল, ‘হারামির বাচ্চা শালা, আর কি ফরেন মাল আছে, দেখা।’
কান ধরে দুপাশে মাথা নাড়ল ফুদন, ‘আরকো চিজ ছই না।’ মদের বোতল গুলো হাতে নিয়ে দোকানের বাইরে এক পুলিশ। নিশ্বাস বন্ধ করে শালের খুঁটির মত দাঁড়িয়ে রইল সুখা। এ মুহূর্তে পুলিশের হাতে পরলে দীপালির মত অবস্থা হবে তার। ডাণ্ডা মেরে জেলে চালান করে পেটের মালটাও গায়েব করবে শালারা। পালাতে পারবেনা। মুরগির মত জবাই হতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঠাই দাঁড়িয়ে রইল সুখা। হঠাৎ খিস্তির তুবড়ি ফাটিয়ে হুস-মুস করে দোকানের পিছন দিকে পা বাড়াল দুজন পুলিশ। মুহূর্তে দরজার ঝাঁপ সরিয়ে ফুদনের দোকান ঘরে সেঁধিয়ে গেল সুখা। একটু পরে মহল্লা কাঁপিয়ে জিপের ইঞ্জিন চালু হল। জিপটা চলে জেতেই মাচার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা দেখলো সুখা। হঠাৎ বাঁ’হাতে হ্যাঁচকা টান। মাথা ঘুরে গেল সুখার। চোখ বন্ধ করে শরীর এলিয়ে দিল ও। সুখা পড়ে যাবার আগে ওকে জাপটে ধরল ফুদন। চোখ বড় করে একটানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সুখা। খিল খিল হেসে উঠল ফুদন, ‘দিদি, রূপয়া দিনুস’। সুখার মুখেও গাল ছড়ান হাসি, ‘আজ তুই মোক বাচালু ফুদন’। বুকের খাঁজ থেকে ঘামে ভেজা দু’টাকা বের করে সুখা বলল, ‘আর নাই। শহর যাবার ভাড়াটা আখিয়া বেবাকটাই তোক দিয়ে দিনু।’ গলা একটু নরম করল ফুদন, ‘দিদি চা খানে?’ বাসের শব্দে দু’কান খাড়া সুখার। পেটে আঙুল রেখে দ্রুত উত্তর দিল, ‘অ্যালায় চা খামু না। মালটাক আগে খালাস করিয়া আসু।’
প্রদীপের নোতুন ঘরে পেটে বাঁধা জিনিসটা খালাস করল সুখা। ঝিকিমিকি কাগজের বড় একটা বাক্স। বাক্সের নম্বর মিলিয়ে প্রদীপ বলল, ‘ঠিক আছে’।
-সব ঠিকঠাক দেখে লিয়েছু তো পদিপ দা।’
মাথা নাড়ল প্রদীপ, ‘হু’।
প্রদীপের গদির বাঁদিকে ঝিকমিক কাগজে মোড়া বাক্সটার দিকে একবার তাকাল সুখা। বাক্সের ভিতর কী আছে জানেনা সুখা। জানে ওটার অনেক দাম। প্রদীপের মুখে সদ্য শুনেছে দামটা – তিন হাজার দুশ টাকা। দাম শুনে চোখ কপালে উঠে গেছিল সুখার। এই দামের তিন পারসেন্ট ওর কমিশন! মানে চার টাকা কম একশ। দুটো শাড়ির দাম!
মুখে হাসি ছড়িয়ে নিজের কমিশনটা চাইল সুখা।
গম্ভীর মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াল প্রদীপ, মালিক এলে টাকা পাবি। আজ যা।’
পেটের খিদা সব শক্তি নিঙরে নিয়েছিল সুখার। এখন কলজেটাও শুকিয়ে কাঠ। পাকা মেঝেয় বসে দরজায় পিঠ দিল সুখা। গলায় জোর আনল, ‘আজি তোক দিবার নাগবে। মুই নগদা নগদি কাম করি।’
-খুব তেল বাড়ছে, না? মারব এক ঝাপট।‘ লালচে চোখ দুটো ছোট করে প্রদীপ বলল।
সুখির কপালের ভাঁজে ক্রোধ। আগেও একবার রেগেছিল প্রদীপের উপর। বর্ডারের ওপার থেকে আনা সামান পৌঁছে দিয়ে কমিশন চেয়েছিল সুখা। কমিশন সুখার হাতে গুঁজে দিয়ে চকচকে চোখে প্রদীপ বলেছিল, ‘দিদি, তোদের ওদিকে ঘর ভাড়া মিলবে? একটা মেয়ে ঠিক করেছি।’ প্রশ্নটা শুনে সেদিন প্রচণ্ড রাগে কাঁপছিল সুখা। প্রদীপের চোখে চোখ রেখে কেউটে সাপের মত ফোঁস করে উঠেছিল, ‘এ ধান্দা সুখা করে না। মাল এপার-ওপার মোর কাম। মুই কুরিয়ার। এটা মনে আখবি পদীপ।’
প্রদীপের কথায় আজকেও সুখা রুখে উঠল। দু’কোমরে শক্ত কব্জি রেখে সুখা টানটান। বলল, ‘মারবি ক্যানে মোক? মুই তোক মালটা দিচু। এল্যায় তুই পয়সা দিবি।’
কাঠের বদ্ধ ঘরের কোণায় সরু করে থুথু ফেলল প্রদীপ। গুমোট বাতাস মদের গন্ধে ভারি। প্রদীপের ভারি গলায় ঝাঁজ, ‘ভাগ শালি। কাজ করতে হবে না তোকে।’
সুখার গলা নরম হয়ে এল, ‘কাম ছাড়াস না পদীপ। মোর কথাটা বুঝি দ্যাখ।’
প্রদীপের চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল, ‘কিসের বাঙ্গি ফাটাবি অত পয়সা নিয়ে।’
হঠাৎ গোটা শরীর দুমরে কেঁদে উঠল সুখা, ‘মোর দুঃখ তোরা কি বুঝবু? দিনত মদ-মাইয়ার পিছত তো দুশ-পাঁচশো টাকা ঢালচু। মোর টাকাটা তুই আজি ধরি দে। খুব দরকার।’
ভালো মানুষের মত প্যান্টের পিছন পকেট থেকে পার্স বেড় করল প্রদীপ। মুখে হাসি খেলিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর সুখার হাতে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট তুলে দিয়ে বলল, ‘সবটা রেখে দে। ফেরত লাগবেনা’।
প্রদীপের মন-মর্জির হদিস পায় না সুখা। কৃতজ্ঞতায় ঘাড় নেরে ডান হাত কপালে তুলে প্রদীপ কে সেলাম করল সুখা। তারপর রাস্তায় নেমে এল। অবাক চোখে বাজারটা দেখল। চোরাই মালের বাজার। হংকং মার্কেট। অগের মত জমজমাট। বিদেশী-বেআইনি জিনিসের উপচে পরা কারবার।
হঠাৎ প্রদীপের ডাকে পিছন ফিরল সুখা। কয়েক পা এগিয়ে গেল প্রদীপের দিকে। বিদেশী লাইটারে লম্বা সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল প্রদীপ, ‘শোন্, ভয় করিস না কাজে। মার্কেট চাঙ্গা। ওয়াংদি বাইরে আছে। ফিরতে দেরি হবে। থানা থেকে আমার লোক সকালে খবর দিয়েছে।’
-ভালো খবর শুনালি মোক। ওয়াংদিটা বহুত হারামি আছে।
প্রদীপের ঘোলাটে চোখ দুটো আচমকা চকচক করে উঠল। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি, ‘ওঅয়াংদি খালি তিন মাল বোঝে, বুঝলি। নোতুন নোতুন মাল চায়। তোর বেটিকে লাইনে দিবি? ডবল কামাবি, মাইরি।’
প্রদীপের পা থেকে মাথা জরীপ করল সুখা। জিভ ঘুরিয়ে ঠোঁটের খৈনি ওয়াক থু করল। ঘরের কোণে থুথু ফেলল দুবার। বুকের ধড়াস ধড়াস বেড়েই চলল। প্রদীপের রাগ জানে সুখা। মারোয়ারী মালিকরাও ওকে ইজ্জৎ দেয়। পুলিশও সমঝে চলে। কত ইসমাগলার ফিনিশ করেছে ও। ওকে চটিয়ে এ-লাইনে কাজ করা যায় না। সুখা জানে।
সব জেনেও আগুন চোখ তুলল সুখা। একটা ঢোঁক গিলে প্রাণপণ শক্তিতে ছুড়ে মাড়ল কথাটা, ‘শালা হারামির বাচ্চা’।
চোরাই মালের রঙিন বাজারটা দ্রুত পেড়িয়ে এল ও। শেষ বারের মত। ওর রুদ্ধশ্বাস দৌড়ের পিছনে আছড়ে পড়ল প্রদীপের হুঙ্কার।
সেবক মোড়ে বাস স্টপে এসে দাঁড়াল সুখা। উল্টো দিকে ঝলমলে কাপড়ের দোকান – ‘কাজল এম্পরিয়াম’। বাস স্ট্যান্ডের গা ঘেঁসে ‘জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। গরম পান্তুয়া আর সিঙ্গারা খাবে, ভাবল ও। কোমরে গোঁজা টাকায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলল। তারপর দ্রুত পায়ে উল্টোদিকের কাপড়ের দোকানটায় ঢুকে পড়ল। নোতুন শাড়ি-জামা-কাপড়ে ঠাঁসা বড় দোকান। অনেক সওদা করতে হবে। এক মাস পর ইস্কুলের বড় পরীক্ষা দিতে যাবে সুখা আর কদমের বড় মেয়ে – বীণা সিং। নোতুন পোষাক ছাড়া মানাবে নাকি?
পছন্দ করে জামা কিনল, টেপ-জামা আর ইজেরও। সাবধানে রাস্তা পার হয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মেয়ের সদ্য কেনা জামাটার গায়ে হাত বুলাল সুখা। আকাশী নীলের জমিতে সাদা ফুল। একপেট খিদার মধ্যেও সুখার ঠোঁটের কোণে মুক্তা ঝড়ল। আধুনিক শহরের রাজপথে ভয়ঙ্কর ব্যস্ততার মধ্যেও মায়ের মুখে অনাবিল নিশ্চিন্ত হাসি। -০-
খুব মানান সই ছবি।