‘ভাল বাড়িতে থাকছস যখন, আমারে নিয়া চল’, চায়ে শব্দ করে বড় একটা চুমুক দিয়ে কথাটা ঝন্টুর দিকে ছুঁড়ে দিল গিরিবালা। ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে আসা কথাটা কানে ঢুকতেই মায়ের মুখে পলক তাকাল ঝন্টু। চায়ের কাপটা ভাঙা টুলের উপর রাখলো। খট করে ওঠা আওয়াজটায় একটু চমকে গিয়ে মিয়ানো গলায় মা বলল, ‘ক’দিনের লগে থাইকতাম ওহানে। অবশ্যি তর অমত হইলে যাইব না।’
ঝন্টুর কপালে ভাঁজ। ওর ভাবনায় ডুবে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে মা বলল, ‘উত্তর দিছস না যে বড়! কইলি ভালো বাড়ি পাইছি। অহন মুখে রা নাই। মিছা কথা কইসিস তুই?’
ঝন্টু কাচু মাচু মুখে বলল, ‘বাড়িটা সত্যিই ভালো মা। তুমি আরামে থাকতে পারবে।’ ঝন্টুর মুখের ভাষায় শহুরে ছোঁয়া। চায়ে সুরুত করে একটা চুমুক দিয়ে কলকাতিয়া বুলিতে আবার বলল, ‘দালান কোঠায় থাকি। ঝক ঝকে মেঝে। মাটির বাড়ির মত নিকানো কারবার নেই। সপ্তাহে একদিন লোক এসে মেশিনে ঝাড়পোঁছ দিয়ে যায়।’
‘তাইলে তো রাজার বাড়িতে থাকছস তুই’।
-হ্যাঁ মা। ঘরে দু’টো খাট বিছানা। সাঁটানো বাথরুম। কল খুললেই জল। যত খুশী চান কর, কাপড় কাচ। ভেজা শাড়ি গামছা বেলকনিতে মেলে দাও। ঝুট-ঝামেলা নেই।
‘উরিব্বাস।’ বড় বড় চোখে ঝন্টুর দিকে তাকিয়ে থাকল মা। একটু পরে বলল, ‘তাইলে মালিক তরে দেখভাল করার লগে রাখসে। মানে দারোয়ান গিরি।’
ঝন্টু দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না মা, মালকিন খুব ভালো মানুষ।’
-বুঝলাম। হা রে! তোর অনেক টাকা হুইছে, না! কথাটা তাইলে ঠিক। কলকাতার বাতাসে টাকা উড়তিছে!
-কি জানি! কথাটা অনেকে বলে বটে। তবে আমি তো টাকা উড়তে দেখি নি মা।
-একবার আমারে নে যাবি না! কলকাতা দেখসি তোর বাপের আমলে। কতকাল হইল ভাব। এহন একবার দিখা আইতাম।’
‘কি দেখবে তুমি?’ একটু বিরক্তি ঝরল ঝন্টুর গলায়।
-দেখবার লগে তো মেলা কিসু আসে। তবে…কলকাতার বাতাসে নাকি টাকা ওড়তেসে। দেখতে বড় সাধ হয় রে!
-আমারটা কিন্তু কলকাতা না। নিউটাউন। তবে কলকাতার ঘাড়েই। এক ঘন্টায় হাওড়া ষ্টেশন। শিয়ালদা আরও কাছে।
-তাইলে তো কলকাতাই হ’ল।
-তা বলতে পার। ওখানে থেকেই তো আমি কলকাতায় চাকরি করতে যাই।
-কি কাম করস তুই? বলেসিলি বটে। আবার বল।
-টাকা কেনা-বেচার কাজ।
-এইডা আবার কেমন ধারা কাম?
-তুমি বুঝবে না। এই ধর একটা লোক যাবে ইংল্যান্ড। বিদেশ। ওকে তো সে দেশের টাকা নিতে হবে। আমাদের দোকান, প্যাটেল মানি এক্সচেঞ্জ’-এ এলে ওরা সেই টাকা কিনতে পাবে, বুঝলে!
-বুঝে কাম নাই আমার। কইসি তর বাড়ির কতা। সেখেনে আমারে নি যেতে চাস না ক্যান, সত্যি করে ক।
অল্পক্ষণ চুপ থেকে ঝন্টু বলল, ‘একটা অসুবিধা আছে মা। তোমার কষ্ট হবে।’
‘রাজার বাড়িতে আমার কষ্টটা কি হইব?’ চোখ কপালে তুলে বলল গিরিবালা।
-কষ্ট আছে মা।
-কী কষ্ট ঠিক করে ক তুই
-ওখানে রান্না করবার হুকুম নাই।
-সে কী,’ আঁতকে উঠল গিরিবালা। একটু থেমে বলল, ‘তবে তুই কী খাস?’
-বাড়িতে রুটি মিষ্টি খাই আর অফিসে গিয়ে… ডাল ভাত।
পাশের বাড়ি থেকে গোপালের মা কখন উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ খেয়াল করে নি। ঝন্টুর দিকে তাকিয়ে গোপালের মা বলল, ‘তোর মাকে নিয়ে যা রে! ক’দিন থেকে আসুক।’
ঝন্টু ব্যাজার মুখে ওদিকে তাকাতেই গোপালের মা বলল, ‘দিন রাত শুধু তোর কথা ভাবে। ক’দিন না হয় গিরিবালা রান্না করবে না। মুড়ি চিড়ে ফল মিষ্টি খেয়ে তো থাকতে পারবে।’
শেষমেশ গোপালের মা’র জোরাজুরিতে মাকে নিয়ে কলকাতা ফিরল ঝন্টু। বাড়িঘর গুছিয়ে কাজের জায়গায় পৌঁছাতে দু’দিন দেরি হল। দেরি হবে, কথাটা মালকিনকে জানিয়েছিল ঝন্টু। মিসেস প্যাটেল আপত্তি করেন নি। অফিস এবং ঝন্টুর বাসস্থান, দুটিরই মালকিন মিসেস রুপা প্যাটেল। ছেলের সাথে মা তার বাড়িতে ক’দিন থাকবে, আপত্তির কী আছে!
হাওড়া স্টেশনে নেমে পেল্লায় একটা বাসে চেপে সন্ধ্যার মুখে বাড়িতে পৌঁছাল ঝন্টু। ঘরের আলো জ্বেলে মাকে নরম বিছানায় বসিয়ে বলল, ‘তুমি আরাম কর মা। আমি খাবার ব্যাবস্থা করছি। তবে চা হবে না কিন্তু।’
-আচ্ছা।’ মা ঘাড় নেড়ে বলল
রাতে অসুবিধা হয় নি কোন। ক্লান্ত শরীরে পাখার হাওয়ায় মা ঘুমিয়ে পড়েছে তাড়াতাড়ি। একটু পরে মুড়ি রসগোল্লা খেয়ে মায়ের পাশের খাটটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল ঝন্টু। গদিওলা খাটে শরীর লম্বা করতেই গাড় ঘুম ঝাঁপিয়ে নামল দু’চোখে। কখন রাতটা কেটে গেল বুঝতেই পারে নি। ঘুম ভাঙতেই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে চোখ। সকাল ছ’টা। ধড়মড় করে উঠে বসল ঝন্টু। মা তখনও ঘুমে।
সুন্দর কাটল রাত্রিটা। কিন্তু একটু পরে বাজারের ব্যাগ হাতে নিতেই একটা অসুবিধা খচ্ করে উঠল মাথায়। পকেটে মাত্র সাতচল্লিশ টাকা! এ দিয়ে মুড়ি মিষ্টি ফল অফিস যাওয়া সব হবে কি করে? বুকটা ধক করে উঠল।
স্নান সেরে সাবান-কাচা শাড়ি গায়ে দিয়ে ব্যালকনিতে গামছা মেলতে মেলতে মা বলল, ‘কি হইসে তর? মুখ খান ব্যাজার ক্যেন? আমি কি বিপাকে ফেললাম তরে?’
মা’র কথার উত্তর না দিয়ে ‘দরজাটা বন্ধ করে দাও’ বলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল ঝন্টু। লিফট থেকে নেমে ঘড়ি দেখল। হাতে সময় আছে। বাজার যেতে দশ মিনিট হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল ঝন্টু। অল্প ক’টা টাকায় চলবে কি করে? অফিস যাবার বাস ভাড়া রেখে একটু ফল মিষ্টি মুড়ি চনাচুর কি কিনতে পারবে?
পেছনে গাড়ির হর্ন শুনে রাস্তার বাঁদিকে সরে এল ও। এখানে রাস্তায় ফুটপাথ তৈরি হয় নি এখনও। সাবধানে চলতে হয়। ডিবি ব্লকের মোড়ে এসে একটু থামল। ঘাড় ঘুরিয়ে দু’পাশ দেখে রাস্তা পার হল। এখান থেকে সাত মিনিট হাঁটলে পর আঠের তলা বাজার।
সকালের রোদ গায়ে লাগছে। জ্যৈষ্ঠ মাস কিন্তু তেমন গরম নেই এখানে। হওয়া আছে। ভালোই লাগছে হাঁটতে। শুধু পকেটের সাতচল্লিশ টাকাটার ভাবনাটা খচ খচ করছে মাথায়। মাইনে পেতে এখনও পাঁচ দিন বাকী। অফিসে ধার চাইতে পারে দু’একশ টাকা। কিন্তু সঙ্কোচ হয়। মালকিন যদি বিরক্ত হয়ে বলে, ‘টাকা হবে না এখন!’
মালকিন বিরক্ত হোক, কোন কারণে তার উপর রাগ করুক, ঝন্টু চায় না। চায় না বলে মালকিনকে খুশি রাখতে প্রাণ ঢেলে কাজ করে। মালকিন খুব ভদ্র নরম-সরম কিন্তু কাজে সামান্য এদিকওদিক দেখলেই গোখরো সাপের মত ফোঁস করে ওঠে। মালকিনকে চটাতে চায় না ঝন্টু। হাসিখুশি গুজরাটি মহিলা। বাংলা বলেন ভালো। ঠিক সময়ে মাইনা দেন। নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছেন।
মালকিন ভালো তবুও একটা ভয়ে বুকটা ঢিবঢিব করে ঝন্টুর। চাকরি চলে যাবার ভয়। অনেক কষ্টে চাকরিটা পাওয়া। কলকাতায় চাকরি করতে যায় গ্রামের দীপকদা। মাসে দু’দিন গ্রামে আসে। অনেক দিন ধরে ওঁকে বলতে বলতে এই চাকরির সন্ধানটা মিলেছিল। দীপকদা বলেছিল, ‘চাকরি পেলে মন দিয়ে কাজ করিস। আর মনে রাখিস এ লাইনে সৎ না হলেই বিপদ!’
ঝন্টু সৎ ছেলে। অল্প কম্পিউটার জানে। ইংরাজি ভালোই লিখতে পারে। এ সব দেখে মালকিন পছন্দ করেছিল ঝন্টুকে। চাকরির কাজ শিখিয়ে দিয়েছিল নিজের হাতে। মালকিন এমনিতে ভালো তবু ঝন্টুর বুকে ভয়ের কাঁটা মাঝে মাঝেই খোঁচা মারে। চারদিকে কাজ জানা অনেক ভালো ছেলে মেয়ে। কোন করণে তার উপর চটে গিয়ে মালকিন যদি অন্য লোক ঢুকিয়ে দেয়!
ঝন্টুর ভাবনার সুতো কেটে গেল। পিছন থেকে একজন ডাকল, ‘স্যার, গ্রিনফিল্ডে থাকেন?’
ফাঁকা রাস্তায় হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে ছেলেটার দিকে তাকাল ঝন্টু। কালো রঙ, চোখ মুখ উজ্জ্বল। বয়স আন্দাজ চব্বিশ-পঁচিশ। মানে ঝন্টুর থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোট। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ঝন্টু বলল, ‘এখানে না, থাকি দূরে। শীতল-জল স্টপ’।
-কাছেই তো থাকেন স্যার।
‘তুমি থাকো কোথায়’? হাঁটার গতি কমিয়ে ওর দিকে তাকাল ঝন্টু।
-আমি স্যার, রঙের কাজ করি। যে বাড়িতে কাজ হয় সেখানেই থেকে যাই।
-কি নাম তোমার?
-বিজয়। …স্যার একটা কথা বলবো?
ঝন্টুর মুখের কথা সরবার আগেই বিজয় বলল, ‘কুড়ি টাকা খুচরো হবে স্যার?’
সাতচল্লিশ টাকার মালিক ঝন্টু বলল, ‘দু’টো দশ দিতে পারি’।
প্যান্টের পেছন পকেট থেকে টাকার ব্যাগ বের করল বিজয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে ‘যা দেবেন’ বলে একটা নোট বাড়িয়ে দিল।
টাকাটার দিকে চোখ পড়তেই কেঁপে উঠল ঝন্টু। নিমেষে গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটল। চোখ কপালে তুলে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা তো কুড়ি ডলার! এর দাম জানো?’
-দাম তো অনেক স্যার। শিয়ালদার এক দোকানে ভাঙিয়ে একদিন হাজার টাকা পেয়েছিলাম। পরের দিন ভাঙাতে গেলে লোকটা থাপ্পর মেরে বলল, ‘চোরাই মাল এনেছিস। ভাগ শালা।’
একটু ভেবে ঘড়ির দিকে পলক তাকিয়ে ঝন্টু বলল, ‘কোথায় পেলে ডলার?’
-স্যার, আমার মাসি দিয়েছে পাঁচ-ছটা। সল্টলেকে এক বাড়িতে রান্নার কাজ করে তো! ওখানেই পেয়েছে।
নিজের সাথে কথা বলল ঝন্টু। বাতাসে সত্যিই টাকা ওড়ছে রে! চল্লিশ টাকা দিয়ে নিয়ে নেব নাকি চল্লিশ ডলার? বাজারটা ভালো করে করতে পারি তাহলে। ভিতর থেকে কে একজন বলল, সুযোগ পেয়েছিস, নিয়ে নে ঝন্টু। অফিস পাড়ায় চেনা দোকানে গিয়ে ভাঙিয়ে নিবি। আরেকটা ভাবনাও উঁকি দিল। মালকিন যদি কোন ভাবে জেনে যায়? ভাবে অফিসের লকার থেকে ডলার চুরি করেছে ঝন্টু! তারপর চোর অপবাদ দিয়ে চাকরি নট। জীবনটা বরবাদ! মায়ের কাছে ভালো ভালো পাত্রীর সন্ধান আসছে। এসব ভাবনার মধ্যে দীপকদা কানের কাছে গমগমে গলায় বলল, ‘এ লাইনে কিন্তু খুব সৎ থাকতে হয়। নইলে টিকতে পারবি না ঝন্টু।’
একটু কেঁপে উঠে এক কাঁড়ি টাকার লোভ পায়ে ঠেলে বাজারের দিকে হাঁটতে লাগল ঝন্টু। পিছন ফিরে বিজয়ের দিকে চোখ তুলে বলল, ‘চোরাই মাল আমি ছোঁব না। তুমি পার্ক স্ট্রিটের ওখানে চলে যাও। অনেক দোকান পাবে। দু’চারটে ডলারের নোট ভাঙিয়ে নাও।’
চটপট বাজার সেরে ফেলল ঝন্টু। মায়ের হাতে ছোট্ট প্যাকেটে একটু মুড়ি কলা আর বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে স্নান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘তুমি খেয়ে নিও মা। আমি অফিসে গিয়ে খাবো।’
অল্প সময়েই অফিসের পোশাক গায়ে চাপিয়ে তৈরি ঝন্টু। কালো প্যাট, সাদা হাফ শার্ট আর কালো জুতো। অফিসে পৌঁছে আলমারি থেকে বের করবে কালো কোট আর নীল টাই। ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে হয়। ওকে দেখে দারোয়ান শাটারের তালা খুলবে। দারোয়ান রাম যাদব আবার ব্যাস্ত লোক। ছ-সাতটা দোকানে ডিউটি করে। রাম যাদব এয়ার কন্ডিশন মেশিন চালিয়ে বাইরে গেলেই ফিটফাট হয়ে নেবে ঝন্টু। এক দেড় ঘন্টা পড় ম্যাডাম ঢুকবেন ঘরে। ঝন্টুর দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে বলবেন, ‘গুড মর্নিং’। চেয়ারে বসা ঝন্টু দাঁড়িয়ে উঠে ঘাড় নামিয়ে বলবে, ‘গুড মরনিং ম্যাম।’
আজ চেয়ারে বসে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঝন্টু মনে মনে বলল, ‘ম্যাডামের আসতে একঘন্টা দেরি তো হবেই। দারোয়ানকে দোকান দেখতে বলে একটু চা-বিস্কুট খেয়ে আসতে হবে। পেটের খিদেটা তাহলে চাপা পড়ে যাবে।
কাচের দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই ফুটপাথের কোনায় মধুদাকে দেখতে পেল ঝন্টু। ছোট টেবিলে চায়ের কেটলি আর বিস্কুটের বয়াম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় লোকজন কম। একটা-দুটো করে দোকানের শাটার উঠছে। মধুদার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্কুটে আলতো কামড় দিল ঝন্টু। চোখে পড়ল ফাঁকা রাস্তায় এদিকওদিক দেখছে একটা ছেলে। মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা। কাঁপা পা ফেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ছেলেটা। এবার মনে পড়ল মুখটা। নামটাও। বিজয়। সকালে বাজারের মুখে দেখা।
কপালে ভাঁজ পড়ল ঝন্টুর। বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলল, মা লক্ষ্মীর কৃপা, এবার আার হাতছাড়া করিস না ঝন্টু। চায়ে বড় একটা চুমুক মের ঝন্টু হাত নাড়িয়ে ডাকল বিজয়কে।
সম্মোহিতের মত বিজয় এগিয়ে এল। ওকে অফিসে ঢুকিয়ে ইশারায় চেয়ারে বসতে বলল ঝন্টু। কোট-টাই পড়া অফিসের বাহারি চেয়ারে বসা ঝন্টুকে চিনতে পারেনি বিজয়। ওর চোখের দিকে তাকাল ঝন্টু। বলল, ‘ডলার ভাঙাবেন? কত আছে?’
-ষাঠ ডলার।
-আজকের দাম জানেন?
-আপনি যা দেবেন।
-পাসপোর্ট আছে?
-না।
-তাহলে তো মুশকিল!
-কম সম করে যা হয় দিয়ে দিন স্যার।’ একটা ঢোঁক গিলে বিজয় বলল।
এক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে চেয়ারে হেলেন দিল ঝন্টু। খানিক চুপ থেকে বলল, ‘মালকিনের সাথে কথা বলি। দু’মিনিট বাইরে দাঁড়ান।’
ল্যান্ড লাইন একবার বাজতেই মালকিন রিসিভার তুলল। নরম গলায় ঝন্টু বলল, ‘ম্যাডাম, একটা বাচ্চা ছেলে ষাঠ ডলার বিক্রি করতে চাইছে। কমে দিয়ে দেবে। পাসপোর্ট নেই কিন্তু। নিয়ে নেব?’
টেলিফোনের ওপারে মালকিনের মোলায়েম গলা শুনল ঝন্টু ‘আজকের দামতো আছে একাত্তর টাকা। তুমি পঞ্চশ বল।’
-ঠিক আছে ম্যাডাম।
-শোন, আলমারির লকারে ছোট বড় নোটে পাঁচ হাজার রাখা আছে। রাজী হলে নিয়ে নাও।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বড় একটা শ্বাস ছাড়ল ঝন্টু। মনে মনে বলল, মা লক্ষ্মী আর ফেরাবো না গো। এস মা লক্ষ্মী, বস মা লক্ষ্মী। পেটে বড় খিদে মা গো। দীপকদা কানের কাছে ফাটা রেকর্ড বাজাল, ‘এ লাইনে সৎ থাকাটা খুব জরুরী, বুঝলি!’
খিদেটা চাগিয়ে উঠল। পেট জ্বলছে, মাথাটাও ঘুরছে। মনে মনে বলল ঝন্টু, ‘পেট পুরে খাবো আজ। কব্জি ডুবিয়ে পাইস হোটেলে মাংস ভাত। বিকেলে কফি আর পকোড়া। মায়ের জন্য হাত খুলে ফল মিষ্টি কিনবো।
ঠাণ্ডা ঘরে বসেও ঝন্টুর শরীরে একটু ঘাম ফুটল। চেয়ারে বসে কপালের ঘাম মুছে টাইয়ের গিঁট আলগা করল। ফুসফুস খালি করা বড় একটা শ্বাস ছেড়ে মাথার ভাবনা গুলো উড়িয়ে দিল ঝন্টু। পেট ভরে খাবার আনন্দ। ঠোঁটের কোনায় একটু একটু করে মুচকি হাসি ফুটল।
চেয়ার থেকে উঠে কাচের দরজা ফাঁক করে বিজয়কে ডাকল ঝন্টু। বলল, ‘দাও ষাঠ ডলার। দেড় হাজার পাবে কিন্তু।’
হাসি মুখে বিজয় এগিয়ে দিল কুড়ি ডলারের তিনটে নোট। পনেরশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে আনন্দে গলে গেল বিজয়। কোমর অনেকটা বেঁকিয়ে নমস্কার ঠুকল ঝন্টুর দিকে তাকিয়ে।
হাত ঘড়িতে সময় দেখে ডলারগুলো লকারে তুলে রাখল ঝন্টু। আর নিজের পকেটে ঢোকাল দেড় হাজার টাকা। একটু পরে ম্যাডামকে খুঁটিনাটি হিসেব বুঝিয়ে লাঞ্চে গেল ঝন্টু। মাংসের ঝোল মাখা ভাত এক গ্রাস মুখে তুলে মনে মনে বলল, সত্যি টাকা উড়ছে কলকাতায়।
আজ ফল কিনবে অনেক রকম। সে সব কোনদিন চোখে দেখেনি মা। তারপর ব্যাগ ভর্তি ফল আর সন্দেশের ভারি প্যাকেট মায়ের হাতে তুলে দেবে ঝন্টু। মায়ের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে অনেকক্ষণ। বলবে, সত্যি মা কলকাতার বাতাসে টাকা ওড়ে।
মা বলবে, ত আমারে একবা দেখা।
ঝন্টু বলবে, দেখাবো। তবে দেখতে গেলে বুদ্ধি লাগে মা। বোকার মত চোখ কান বন্ধ রাখলে হবে না কিন্তু।
গল্প: বাতাসে টাকা ওড়ে
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026.
প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)।
পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন