দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসে গোলাগুলি চলার সময় আচমকা কোথা থেকে যেন একটা গুলি এসে লাগল রাশিয়ার এক সৈনিক আরখিপ মেকসিমেং কোঁ-র মাথায়। গুলিটা লাগতেই তিনি তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তড়িঘড়ি তাঁকে একটি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যান শুধুমাত্র আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী ভাবে তৈরি হওয়া নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ডাক্তারেরা চেকআপ করে বলেন, তিনি বেঁচে আছেন ঠিকই, তবে সংজ্ঞাহীন। কবে জ্ঞান ফিরবে বা আদৌ কোনও দিন ফিরবে কি না এক্ষুনি কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের এক বড় হাসপাতালে।
যখন জ্ঞান ফিরল, তিনি তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এবং তাঁর নাকে-মুখে নল গোঁজা। এর মধ্যেই পার হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। জ্ঞান ফিরল ঠিকই, কিন্তু তখন তিনি একেবারে বধির। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন আর তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ে জল। মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন। বহু ডাক্তার-বদ্যি করেও যখন কিছু হল না, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, দেশকে রক্ষা করা গেছে এই সংবাদ শুনলে হয়তো আনন্দে চিৎকার করে উঠবেন তিনি। কিন্তু শুধু রক্ষা করা নয়, শত্রুদেশ নির্মম ভাবে পরাজিত হয়ে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, দখলে এসেছে একটা বড় দ্বীপ, এ সংবাদেও তাঁর কোনও হেলদোল লক্ষ্য করা হল না। তিনি ভ্রূক্ষেপহীন।
এই ভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল দীর্ঘ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর দু’মাস। যখন তাঁর সেরে ওঠার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ঠিক তখনই উনিশশো সাতাশি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন গভীর রাতে তিনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। সেই যে তিনি মুখ খুললেন, তার পর থেকে তাঁর মাতৃভাষা ইউক্রেনীয় ভাষায় আগের মতোই অনর্গল কথা বলতে লাগলেন তিনি। তাঁর বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে। না, তাঁর কথা বলার যেন আর কোনও বিরাম নেই। খালি বকবক আর বকবক।
কিন্তু দীর্ঘদিন মূক ও বধির হয়ে পড়ে থাকার পরে কী এমন ঘটল যে তিনি আবার বাগ্মী হয়ে উঠলেন?
তিনি নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। সে দিন রাতে তিনি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের স্বপ্ন দেখছিলেন। যুদ্ধের সৈনিক তিনি, তাই তাঁর হাতেও ছিল রাইফেল। দল বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনে। শত্রু শিবিরের দিকে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন অনবরত ছুটে আসতে লাগল গোলাগুলি। সঙ্গীদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য তিনি চিৎকার করে উঠলেন। চিৎকার মানে, একেবারে বিকট চিৎকার। গলা ফাটিয়ে। সেই চিৎকার শুধু স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে এল।
আর সেই চিৎকার এতটাই জোরে হল যে, নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। বিছানা থেকে উঠে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আর পাঁচজনের মতোই তিনি শুরু করলেন কথা বলা। ব্যস।
মূক-বধির হয়ে যাওয়া কোনও মানুষের এই ভাবে, বিয়াল্লিশ বছর বাদে ফের বাগ্মী হয়ে ওঠা নজির সম্ভবত এই প্রথম।