বাস যাবে কলাতলি পর্যন্ত, আমি তবে আগেই কেন নামলাম? গুগল দেখাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গেস্ট হাউজ কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের কাছেই। ‘হিলটপ’ শব্দটি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল; মাহমুদ হাফিজও বলেছিলেন কিছুটা পাহাড়ে চড়তে হয়। স্থানীয় লোকেরাও টিলার চূড়ায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কোনো গেস্টহাউস আবিস্কার করতে পারলেন না, কেননা সেটা আছে সমতল ভূঁয়ে। কক্সবাজার শহরে ইজি বাইকের ছড়াছড়ি, তবে সকাল সোয়া সাতটায় বিরল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে একটি এলো, স্থানীয় গাইডদের পরামর্শ মেনে চলে আসি মোটেল রোডে। ডলফিন মোড় (আসলে হবে হাঙর মোড়, কারণ হাঙর দুটি, ডলফিন একটি। মানুষের নিরীহ ডলফিন পছন্দ, হিংস্র হাঙর নয়, কেবল ভাস্করের দ্বিগুণ পছন্দ হাঙর) থেকে যে রাস্তা শহরের দিকে গেছে, সেটি নতুন; নতুন কক্সবাজার এই সড়ক ঘিরে গড়ে উঠেছে; পাঁচ, চার, তিন তারকা হোটেলগুলো এ অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে। এর শেষপ্রান্ত থেকে যে সংযোগ সড়ক মোটেল রোডে গেছে তা সোজা সমুদ্রে গিয়ে লাবণী পয়েন্ট (সৈকত) হয়েছে, কেননা সেখানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের সর্বশেষ মোটেল লাবণী রয়েছে। একপাশে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, অন্যপাশে দেয়াল, সড়কটি নতুন করে নির্মাণাধীন, তাই মাটি ও কাদা ভরা। মোটেল রোডের প্রায় শেষপ্রান্তে, উপল, প্রবাল, শৈবাল ছাড়িয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কমপ্লেক্স। এটি একটি বিতরণ কেন্দ্র, দোতালা দালানটির একপাশে ট্রান্সফরমারের স্তূপ। সোজা চলে গেলে পূর্ব দিকে অতিথিশালাটি, একটি গেট বলে দেয় তা ভিন্ন জোন। দূর থেকেই ভালো লেগে যায় সমুখে বাগানশোভিত পরিপাটি অতিথিশালাটি। নাম গেস্টহাউজ নয়, রেস্টহাউজ। ভাবি, নামে কী বা আসে যায়?
তিনভাঁজ সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে অভ্যর্থনা কক্ষটি বন্ধ পাই। দরোজার উপর দুজন কেয়ারটেকারের নাম ও মোবাইল ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। আমি প্রথম নাম আকাশকে ফোন করি, ফোন বাজে, কেউ ধরে না। দ্বিতীয় চেষ্টায় পেলাম, একটি ঘুম জড়ানো কণ্ঠ বলে, সে ছুটিতে। আমি যেন দ্বিতীয় জনকে ফোন করি। এরশাদকে প্রথম কলেই পেলাম, সে বল্ল, আসছি। প্রথমে ভেবেছিলাম আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখাই ভালো হবে, কিন্তু আমাকে উদ্ধার করে (জেনারেল) এরশাদ। সে এসে অভ্যর্থনা কক্ষটি খুলে দেয় আর বলে, একটু বসুন। বড় কক্ষটির তিনপাশে পুরনো নকশার লাল কাপড়ে মোড়ানো ফোমের সিটের কাঠের সোফা, চতুর্থ পার্শ্বে সাদা রেকসিনে মোড়ানো এ যুগের সোফা। দেয়ালে সমুদ্র সৈকত, সাম্পান প্রভৃতির ক্যালেন্ডারের মুদ্রিত ফটো বাঁধাই করা। কোণার টেবিলে একটি টেলিভিশন।
এরশাদ এসে জিজ্ঞেস করে, আপনার রেফারেন্স? আমি বলি জনাব সাইফুল হাসান চৌধুরী, পরিচালক। এখানকার বিদ্যুৎ বিতরণ অফিসটির দায়িত্ব একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর হাতে। পরিচালক তাকে বলে দিয়েছেন আমার কথা। নির্বাহী প্রকৌশলী এই রেস্ট হাউজেই থাকেন, সমুখের যে বারান্দাটি ত্রিশ ডিগ্রি কোণে চলে গেছে, তার শেষেরটিতে। এরশাদ রেফারেন্স চেক করে আমাকে নিয়ে গেল অভ্যর্থনা কক্ষটির পেছনে। সেখানে দুপাশে দুটি করে চারটি রুম, পেছনের সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় একইরূপ চারটি রুম। আমাকে দেওয়া হলো প্রথম রুম ৩০১। ঘরে ঢুকে ভালো লাগলো, বেশ বড়ো একটি কক্ষ, তাতে নকশাতোলা জমিদারবাড়িসুলভ কাঠের ডাবল খাট, একটি নিরীহ দর্শন আধুনিক ড্রেসিং টেবিল, একটি মধ্যবিত্ত চেহারার ওয়ারড্রব, তার উপরে কম্পিউটার স্ক্রিন সাইজের একটি ছোটো টিভি। দেয়ালে একটি ঘড়ি ব্যাটারিহীন। কারণ, তখন বাজে আটটা, ঘড়ি দেখাচ্ছে সাড়ে ছয়টা। এরকম ঘড়ি ভালো লাগে, সময়কে ধরে রাখে। বাথরুমটি বেশ বড়ো এবং পছন্দসই। সবচেয়ে অবাক হলাম একটি চৌকোণো বারান্দা দেখে, ভারী ও লাল রঙ পর্দা সরাতেই তার দেখা পেলাম, আরও আনন্দ পেছনে একটি ছোটোখাটো উদ্যান, তাতে দীর্ঘদেহী গর্জনের আভিজাত্য। আমি কবি ও ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ ও পিডিবির একজন পরিচালক জনাব সাইফুল হাসান চৌধুরীকে শুধু মনে মনে নয়, টেক্সট মেসেজ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
স্নানঘরে গিয়ে গতরাত্রির সব ক্লান্তি ও ময়লা ধুয়ে ফেলি আর মুখমণ্ডলের ঘাস কেটে মসৃণ করে তুলি গালগুলো। মনে পড়ে জর্জ বার্নার্ড শ’র কথা যিনি হিসাব করে দেখিয়েছিলেন শেভ না করে এক জীবনে কত সময়ঘণ্টা (যা কয়েক বছরের সমান) বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর দাঁড়ি রাখার পক্ষে সে ছিল এক অকাট্য যুক্তি। এরপর প্রাতঃরাশের খোঁজ। এরশাদকে জিজ্ঞেস করি, রেস্ট হাউজে ব্রেকফাস্ট মিলবে কি না। উত্তর নেগেটিভ হলে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। কোনদিকে যাব ঠিক করতে না পেরে মেইন রোডের দিকে যাই। দেখি সড়কের ওপাশে একটি পুরনো দিনের বাড়ি, নাম ‘শৈবাল’। এর পাশের প্লটটি গাছ-গাছালিতে ঢাকা নির্জন, রহস্যময়। কিছু অসমাপ্ত স্থাপনা চোখে পড়ে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ থানার বিপরীতে এই পোড়োবাড়ি। অনেক দামী জায়গা এটি। কার কে জানে, নাকি উত্তরাধিকারীহীন? আমি বিমানবন্দরমুখী সড়কের মুখটায় যার বিপরীতে ডলফিনের দুটি ঝাঁপরত মূর্তি আছে সেখানে একটি সাদামাটা রেস্তোরাঁয় নাস্তা (ব্রেকফাস্ট বলা ঠিক হবে না) খাই। আমার বিপরীতে একটি দম্পতি বসেছে, পোষাক আষাক বলে দেয় এরা দরিদ্র, রূপও নেই। আমি তো এটা-ওটা অর্ডার করছি, তারা স্রেফ ডাল দিয়ে দুপ্লেট ভাত খেয়ে নিল। একবার ভাবলাম কিছু অফার করি, পরে ভাবলাম তাদের আত্মসম্মানে লাগতে পারে। দরিদ্র হলেই অপরের অনুগ্রহ নিবে কেন?
প্রাতঃরাশের আগে আমি মেইন রোডের লেজের দিকটায় যাই। গিয়ে হতবাক হয়ে দেখি কোথায় সমুদ্র, কোথায় সৈকত? ধাতুর তার দিয়ে ঘেরা বাধার ওপাড়ে এক মাঠ। ‘এখানে সৈকত ছিল না?’ পাশের চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি। সে মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ ছিল।’ চল্লিশ বছর আগে আমি প্রায় প্রতিদিন বিকেলে এপথ দিয়ে সৈকতে নামতাম। সমুদ্র সরে গেছে দূরে, ঝাউবনসারির ভেতর দিয়ে প্রভাত রৌদ্রে সে ঝিকমিক করছিল। সমুদ্র সরে গিয়ে যে পলি উপহার দিয়ে গেছে তার উপর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছে বিয়াম, তবে মাঠের মধ্যিখানে নয়, একপাশে। মাঠটি নিয়ে হয়ত প্রশাসনের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে।
রুমে ফিরে এসে বিশ্রাম নেই, রাতে ওই আধি ভৌতিক রহস্যময় বাস জার্নিতে ভালো ঘুম হয়নি। কিন্তু আমি ঘুমাই না, আমার যা স্বভাব, মোবাইলে ভ্রমণকথা লিখতে থাকি। সকালেই কবি সাইয়্যিদ মঞ্জুর ফোন পেয়েছিলাম, সে আমার কক্সবাজারে আসা (পদার্পণ বলা কি ঠিক হবে?), রেস্ট হাউজে ওঠা – সব খবর নখদর্পণে (এটা ঠিক আছে) রাখছিল। কাল মধ্যরাতে কবি হাফিজ রশিদ খান ফোন দিয়েছিলেন, আমি টের পাইনি। সে আসবে চট্টগ্রাম থেকে, আমায় জানাল রওয়ানা হয়েছে চকরিয়াগামী বাসে। আমাকে ট্রাকিং করছিলেন মাহমুদ হাফিজ। রেস্টহাউজ কেমন ইত্যাদি জেনে নিচ্ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য না আসতে পেরে তিনি বেদনাবোধে আক্রান্ত। পায়ের তলায় সর্ষে দানা তারও। বললেন, এমন সুযোগ আর কি পাব? মহেশখালির এক তরুণ কবি সুব্রত আদিত্য ফোন করে আমার কুশল জেনে নেয়। আমাকে যে মহেশখালি দ্বীপে নিয়ে যাবে সে আরেক তরুণ কবি (আমার যা বয়স, তাতে প্রায় সবাই তরুণ) মিজান মনির জানায় আমি সরাসরি ঘাটে যেতে পারব কি না, নাকি তাকে রেস্টহাউজে আসতে হবে? বল্লাম, ‘ওটুকু পারবো।’
মিজান মনিরের কথামতো দুপুর ১টায় রওয়ানা হই। মহেশখালি দ্বীপে যাওয়ার ঘাটের নম্বর ৬, আমি চিনি। বিমানবন্দরগামী সড়ক থেকে সরু হয়ে রাস্তা গেছে ডানে, এরপরে আরও সরু হয়ে ফের ডানে। সেই সরু পথের অর্ধেকটা জুড়ে আবার রিকশা, ইজি বাইক দাঁড় করিয়ে রাখা। সমুখে একটি জটলা দেখি, প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে শুনলাম ওই সড়ক প্রশস্তকরণে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিবাদ। এখানে ঘাটের কড়ি পাঁচ টাকা। সেটা পরিশোধ করে কাদার ভেতর পোঁতা কাঠের স্লাব দিয়ে তৈরি সাঁকো পার হয়ে নীল টিনের ছাদঢাকা জেটিতে যাই। সাঁকোর দুপাশে কাদার ভেতর, যেন চরা, অনেকগুলো স্পিডবোট ও ছোটো লঞ্চ গায়ে গায়ে লেগে আছে। জেলা প্রশাসকের দুটি বোটও আঁটকে আছে চরায়। বাঁকখালি নদী পুব থেকে পশ্চিমে এসেছে কয়েকটি বাঁক নিয়ে। এমনি এমনি তো ওই নাম হয়নি। জানি না উজানে তার কত শত বাঁক। জেটির দুপাশে নদীর জলে নোঙর করা সমুদ্রে মাছ ধরার জেলে নৌকা বা সাম্পানগুলো তাদের ঐরাবতের শুঁড় হয়ে ওঠা অগ্রভাগ আর পৃথুলা নারীর মতো ভারী পশ্চাদদেশ। বেশিরভাগ সাম্পানের রঙ আলকাতরা কালো। বস্তুত পানির অবক্ষয় থেকে কাঠকে রক্ষা করতে আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়। সাম্পানগুলোর নকশার ভেতর সাযুজ্য রয়েছে। যেসব সাম্পানের দুদিকেই বাঁকা চাঁদের মতো মাস্তুল, সেগুলো সমুদ্র তীরের কাছাকাছি মাছ ধরে। আর এই সাম্পানগুলো গভীর সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। এদের বলা হয় ট্রলার।
জেটিতে স্পিড বোট ও গান বোট (নেভির গানবোট নয়, বড়ো তরমুজের খোলের মতো বোট, বন্দুক ও কামানহীন) দু ধরণের জল পারাপারের তরী আছে। স্পিড বোটে ভাড়া ১২০, গতির কারণে, চ্যানেল পার হতে সে সময় নেয় ২৫ মিনিট। যাত্রী আগে নিত ৮ জন, করোনা বিধি-নিষেধে দুজন কম। গান বোটে ভাড়া এক চতুর্থাংশ, মানুষ সংখ্যা অনেক, আগে ৬৫, এখন ষাট, সময় লাগে ৪৫ থেকে ৬০ মিনিট। গান বোটে করোনার বিধিনিষেধ স্বল্প, বা থাকলেও মানা হচ্ছে বলে মনে হলো না। ৬ যাত্রী নিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়ে স্পিড বোটগুলো, গান বোট অপেক্ষা করে যাত্রী ভরার। করোনা না মানলেও গান বোটগুলো নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন, লাইফবয় আছে, লাইফ জ্যাকেট আছে। স্পিডবোটে কিছু দেখলাম না। অনুসন্ধান করে জানলাম, স্পিড বোটের এক চালক বল্ল, লাইফ জ্যাকেট আছে পাটাতনের নিচে।
মিজান মনিরের দেখা নেই, তাতে আমার আফশোসও নেই, কারণ এই জেটি এক অনুপম ফটো স্টুডিও। এর চারপাশে এত কিছু আছে ছবি তোলার, সাম্পানগুলো, নদী, নদীর ওপার, এই জেটিতে এত দৃশ্যভোজ যে আমি শুধু ছবি তুলে যাই, আর দেখি স্পিড বোটগুলোর ঘাট ছেড়ে যাওয়া আর ঘাটে এসে লাগা, গান বোটগুলোর যাত্রী ভরার অপেক্ষা। জেটিতে তিনফালি কাঠের বেঞ্চিতে বসে ওপারের নারকেল বীথির এক গ্রাম দেখি। ‘কী নাম ওই গ্রামের?’ একজন বৃদ্ধ বলেন, ওটা কুরুশকুল। ওখানে যাবার নৌকা যেমন আছে, এক সেতুও আছে। তিনি আঙুল তুলে দূরে উজানে সেতুটি দেখালেন। আরে তাই তো! আমার চোখ যে দূরবীন নয়, তাও বুঝলাম। কাছেই চার যুবক জেটির মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে কী যেন খেলছে, দেখতে পাইনি কারণ তাদের উপর ঝুঁকে আছে আরো কিছু লোক। তারাও খেলাটা দেখছে সোৎসাহে। খেলারত যুবকদের একজন থেকে থেকে চীৎকার করছে, ‘শাবাশ! শাবাশ!’ শুনে এগিয়ে দেখি মোবাইলে লুডু খেলছে চারজন। হায়, খেলাধুলা!
(চলবে)