‘দাদী, দিন ভর পানি ভরলু। ভাত খাইলু না?’
খিল খিল হাসির সাথে কথাটা কানে ঢুকতেই মেজাজ টঙ। জলভরা বলতিটা বারান্দায় নামিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে গলার চেটানো ঘামে আঁচল ঘসলেন সরলা। কপালের ভাঁজে এক থোকা বিস্ময় – ভাত খাবো না, ছোঁড়াটা জানলো কী করে! একটু দম নিয়ে পিছন ফিরে গলা চড়ালেন, ‘থাপ্পড় খাবি কালা। ইস্কুল নাই, পড়া নাই। কে পানি খাল্লু, কে ভাত খাল্লু তোর তাতে কি রে?’
‘পরীক্ষা হইলু, আজ ছুট্টি’, রাস্তার ওপার থেকে মিহি গলায় উত্তরটা ছুঁড়ে দিয়ে সুরুত করে দাওয়া থেকে এক লাফে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো কালা। সরলাও নিজের বাড়িতে ঢুকে খিল আঁটলেন। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে ভাবছিলেন, বকা ঠিক হয়নি। কাজে লাগাতে হবে ছেলেটাকে। সময় মত ওকে ডাকবেন। এসময় কালার বাবা সুকেশ থাকে বাড়িতে। কালার বেরোবার কথা শুনলে সুকেশ আবার চোপা করবে ছেলেটাকে। সুকেশ কর্পোরেশনের পিওন। সকাল দশটায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মেট্রো রেলে চেপে অফিসে যায়। আজকাল নাকি ওদের হাজিরায় খুব কড়াকড়ি। সকালের দিকে ওর মেজাজ খুব গরম থাকে। গরম ভাত খেয়ে ও বেরোলে পর মালা এক কাঁরি কাপড় নিয়ে ঘাটে যাবে। স্নান-কাপড় কেচে শিবের মাথায় বোতল ভর্তি গঙ্গা জল ঢেলে বাড়ি মুখো হতে পাক্কা দু’ঘণ্টা। ততক্ষন এপাড়া ওপাড়া জুড়ে দাপিয়ে খেলে বেড়াবে ছেলেটা। মালা বেরোলেই ধরতে হবে কালাকে। ভাবছিলেন সরলা।
সকালে বাপের সাথে লাইন দিয়ে জল ভরেছে কালা। সারে দশটা অবধি তির তির করে রাস্তার কলে জল পড়বে। কালাকে দিয়ে তাড়াতাড়ি আরো দু’বালতি জল ভরিয়ে নিতে হবে। ওর নানিটা পাক্কা জাঁহাবাজ। দিন রাত শুয়েই থাকে। কালাকে কেউ কিছু বললেই হলো! বাড়ির বাইরে এসে দু’পা ফাঁক করে ঢাকের মত পেট বের করে চিল চিৎকার জুড়বে। নানির খরখরে গলায় চিৎকার কানে ঢুকলে কালা চমকে গিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। কিন্তু তবুও কালাকে পটানোর ওষুধটা জানা আছে সরলার।
আরেকটু ভেবে বারান্দায় এসে নরম গলায় ডাক পাড়লেন সরলা, ‘কালা, আমার কালো রে, ভাগলি কোন চুলো?’ খালি পেটে বেশি চেঁচাতে পারেন না সরলা। রাস্তার কলে টিপটিপ জলধারার দিকে তাকিয়ে কালার অপেক্ষায় চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
এক পেট খিদে চাগিয়ে উঠেছে। সকালে চা-বিস্কুট খেলে খিদেটা কমতো। কিন্তু সুযোগটা মিললে তো! ঘুম ভাঙতেই হা-জল হা-জল। কান্নাকাটি অবস্থা। বাড়ির কলে সরু ফিতের মত ফোঁটা ফোঁটা জল ঝড়েছে ভোরবেলা। বেলা বাড়তে তা-ও বন্ধ। তিন-চার দিন ধরে শুধুই জলের জন্য হাপিত্যেশ। ওয়ার্ডের অর্ধেকটা জুড়ে জলের আকাল। গোপী মোহন দত্ত লেনে টানা খরা চলেছে। আজ একদম নির্জলা। দশ নম্বর ওয়ার্ডে মেন রাস্তার উপর বড় পাইপটা ফেটে চৌচির। বহু দিন আগে পুরসভার নজরে আনা হয়েছিল। সম্পূর্ণ ওয়ার্ড জুড়ে জলাভাব হবে ভেবে পুরসভা তখন সারাতে ভরসা পায়নি। এখন এত লোককে ভুগিয়ে সেই কাজটাই করছে। পাড়া শুদ্ধ লোক উপায়ন্তর না দেখে জল নিতে রাস্তায় নেমে এসেছে। রান্না বান্না আর পিপাসার জলটা তো দরকার!
সরলাও দুটো বালতি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে লাইনের প্রান্ত সীমায় এসে দাঁড়য়েছিলেন। রাস্তার কলে স্বভাবিক ধারায় না-হলেও বেশ কল কল করে জল পড়ছিল। ওয়ার্ড কমিশনারের তোরজোরে অন্য সরবরাহ লাইনে এক্সট্রা পাইপ গোঁজা হয়েছে। জল নিতে তেরাব্যাঁকা তিরিশ হাত লাইন। একটার বেশী বালতি ভরা নিষেধ। কড়া নিয়ম। একটা বালতি ভরা হলে ব্যাজার মুখে আবার লাইনের শেষ মানুষটার পেছনে দাঁড়াতে হবে।
সরলা তাই করলেন। দশ লিটারের লাল বালতিটায় জল ভরে নীল রঙের খালি বালতিটা লাইনের শেষে দাঁড়ানো বলাই মাস্টারের রাঁধুনির পেছনে রেখে বললেন, ‘শোভা তোমার জিম্বায় রেখে গেলাম।’ উত্তরের অপেক্ষো না-করে ভরা বালতিটা ডান হাতে তুলে নিয়ে পিঠ অর্ধেক বেঁকিয়ে এক-পা এক-পা করে বাড়ি মুখো হাঁটলেন। শীত কাল হলেও মাথার উপর চনচনে রোদ। ঘামে মাখামাখি শরীর নিয়ে প্লাস্টার খসা বাড়ির বারান্দায় উঠতেই কালার বেয়ারা সাওয়াল, ‘খালি পানি খাইলু, ভাত খাইলু না?’
প্রথমে রেগে গজগজ করছিলেন সরলা, ‘আমি ভাত খাল্লু না, তো তোর কি? তুই জানলি কী করে হারামজাদা?’ এসব বললেও এখন প্রয়োজন বুঝে নিজের তিরিক্ষি মেজাজটা ঠান্ডা করলেন সরলা। সামনে চোখ মেলে বাতাসে কান পেতে কালাকে খুঁজছেন। কোন গলির আড়াল-আবডাল থেকে যদি ওর মিহি স্বর ভেসে আসে। কিন্তু কেবলই কলতলার গাঁক গাঁক ঝগড়া ঘিঞ্জি বাড়িগুলোর দেওয়ালে লাট খেতে খেতে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। কলতলায় নিজের বালতির অবস্থান একবার দেখে এলেন সরলা। কলের নীচে ঠাই পেতে আরো পনের মিনিটের ধাক্কা। ততক্ষণ জল থাকলে হয়! ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানায় একটু বসতে যাবেন, তখনই কানে এল, ‘দাদী, ওদাদী’?
কালাকে ঘরে ঢুকিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে গলা খাদে নামালেন সরলা। বললেন, ‘এক বালতি জল জলদি এনে দে বাবা। জলদি।’
কালার গলায় প্রতিবাদ, ‘দিন ভর তো পানি ভরলু, পানিসে ক্যায়া করলু।’
সরলার গলায় কাতর অনুরোধ, ‘যা বাবা চটপট কর। কাল রিনি আর পিঙ্কি আসবে।’
-দাদী আণ্ডা খিলাও।
সরলা সম্মতি জানাতেই দুটো বালতি নিয়ে ছুট লাগালো কালা। একটু পরে আধ বালতি জল এনে চৌবাচ্চায় ঢেলেই ডান হাত বাড়ালো, ‘দাদী পানি খতম, আর মিলবে না। অন্ডা খিলাবে না?’
দুশ্চিন্তার মেঘে ঝপ করে ঢেকে গেল সরলার ক্লান্ত মুখ, ‘অন্ডার কথা ছাড়। জল ছাড়া চলবো কি করে, বলতো? বড় বিপদে পড়লাম রে!’
বিজ্ঞের মত গম্ভীর মুখ কালার, ‘দাদি, ভাত খাইলু না?’
ম্লান মুখ সরলার, ‘খাল্লু, মাল্লু বলবি নাতো। স্কুলে বাংলা বলিস তো। শোন, ভাত খাবো না। বাইরে যাবো এখন, কাল তো রিনিরা আসবে। এখন অনেক কাজ। বিকালে খাওয়াবো তোকে। হাত ধোবার জল, খাবার জল পাবিনা কিন্তু।’
বাইরে যাবার আগে পকেট থেকে পাতাসুদ্ধ চকচকে একটা পেয়ারা বের করলো কালা, ‘দাদী, মিঠা আমরুধ, খায়লু।’
ফলটা হাতে নিয়ে এক মুখ হেসে দরজা বন্ধ করলেন সরলা। জংলি ছাপ শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজ পরে চটা ওঠা ড্রেসিং টেবিলে ডিম-ছাঁচ আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে রুক্ষ কাঁচা-পাকা চুলে চিরুনি বুলালেন অনেকক্ষণ। থুঁতনিতে তিলটা আছে কিন্তু সেই কাটা কাটা মুখের আদলটা তছনছ। চোখের নীচে গাড় কালি। দুমড়ানো গাল। গালে পাউডারের হাল্কা পোঁচ বুলিয়ে ঝাপসা চোখে চশমা আঁটলেন। এরপর ডান কাঁধে কালো ব্যাগ, পায়ে কাপড়ের জুতো। ধীর পায়ে এগোলেন সরলা। জোরে হাঁটলে ডান হাঁটুটা মচ মচ করে।
মোড়ের মাথায় দোকানটার মাঝখানে খালি চেয়ারে বসলেন। শঙ্করও মাঝের সিটে বসতে ভালোবাসতো। মাথার উপর ফট ফট করে পাখা ঘুরছে। ঘরের মধ্যিখানে হাওয়াটা ভালো খেলে। সারা বছরই পাখা ঘোরে দোকানটায়। বিয়ের একমাস পর, তখন শহরে জাঁকিয়ে নেমেছে শীত। কফি স্যান্ডুইচ খাওয়াতে শঙ্কর নিয়ে এসেছে। বনবন পাখার দিকে তাকিয়ে দু-পাশে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানে ঢুকতে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে সরলা। অফিস ফেরত তিন-চার জন বন্ধু নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারত শঙ্কর। বিনয় রমেশ আর স্মরজিত। সঙ্গে দোকান ভর্তি অচেনা মানুষ। সবাই লাল শাড়ি, চাদর আর গয়না ভর্তি যুবতী সরলার বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসছে। এখানে এলেই মনে পড়ে ঘটনাটা। এখন ওরা কে কোথায়! বিনয় মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে। শঙ্কর হৃদরোগে আচমকা মরে গেল। রমেশ মরল পথ দুর্ঘটনায়। স্মরজিত গলা ঠিক রেখে এখনও গান করে। পিঙ্কির বিয়েতে জান লড়িয়ে খেটেছে স্মরজিত। অনেক দিন ওর কোন খবর নেই। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে ঘাড় উঁচু করলেন সরলা। পঁয়ত্রিশ বছর আগের বেঢপ ফ্যানটা ফট ফট শব্দে এখনও ঘুরছে।
জলের গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে রেখে গেল কালার মত ছিপছিপে একটা ছেলে। বৃদ্ধ মালিক টেবিলের কাছে এসে খাটো গলায় সুধালেন, ‘বৌদি কী খাবেন?’
-এগ-স্যান্ডউইচ আর চা।
এক নিশ্বাসে চোঁ চোঁ করে জলটা খেয়ে নিলেন সরলা। স্নান-বিহীন শুকনো শরীর জল টানে বেশী। আজকে স্নানের জলটা জমিয়ে রাখলেন সরলা। বিকেলে জল এলে রিনি-পিঙ্কির জন্য আরো তিন-চার বালতি ধরে রাখতে হবে। দু’দিন আগে বারাসাতে শ্বশুর বাড়ি এসেছে পিঙ্কি। সকালে জামাই ওদের এখানে রেখে আর জি কর হাসপাতালে এক মরমর আত্মীয়কে দেখে ডালহাউসিতে অফিসের কাজ সারবে। সন্ধ্যে বেলা আবার জামায়ের সাথে চলে যাবে পিঙ্কি-রিনি।
আজকেই সব কেনাকাটা সারতে হবে। বাজারে ঢুকলেই হাতের কাছে উপচে পড়া পণ্য –খাদ্য, সাজ-শয্যা, মনিহারি, জুতো, জামা। সঙ্গে হকারদের গলা ফাটানো চিৎকার। মাল গছিয়ে দিতে যুদ্ধের কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সব দোকানদার। চোখ কান খুলে দরদাম করে কিনতে হবে। আর ওতেই বুকে চাপ ধরে যায়। অবশ্য আসল চাপ তো বুকে নয়, ট্যাঁকে। টের পাচ্ছেন সরলা।
ট্যাঁকে উইডো পেনসনের সরু এক ফালি অনুদান। গত এক মাস দিনের বেলা ভাতের বদলে এগ-স্যান্ডউইচ আর চা ঢুকছে পেটে। পঁচিশ টাকায় পেট ভর্তি। রাতে চা-এর সাথে একপিস পাঁউরুটি। ভাতে অনেক খর্চা। পুষিয়ে যেতো। কিন্তু রিনির ছোট্ট আবদারটাই চাপের হয়ে গেল। নাতনির আবদার তো রাখতে হবে।
গত পূজার ছুটিতে মা-র সাথে এসেছিল। সরল মেয়ে। পলাশ ফুলের মত গায়ের রং। ওরকমই টান টান চোখ-মুখ। ফুল ফুল গোলাপি জামাটা পরে মোড়ের মাথায় যখন ঠাকুর দেখতে গেছিল, সবার নজর হামলে পড়ছিল ওর মুখে। কোন শখ বায়নাক্কা নেই মেয়েটার। নতুন শপিং মল থেকে ওর একটা জামা কিনে দিতে চাইলে বলেছিল, ‘দিদা, তার চেয়ে একটা জুতো কিনে দাও’। দেখিয়েওছিল বাসস্ট্যান্ডের ধারে দোকানটায় ওর পছন্দের ফিতেআলা জুতো। জামার সাথে মানানসই লাল-নীল স্ট্র্যাপের জুতো। আর ওটাই সরলার ঘাড়ের উপর এক-পাহাড় চাপ হয়ে বসে গেল। জুতোর দামটা দোকানদার বলেছিল, চার হাজার। দামটা দড়াম করে বুকে একটা ধাক্কা মেরে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুত-কেবল-টেলিফোনের বিল ভরবার পর মাস গেলে ওটাই তো থাকে পড়ে।
টেবিলে অনেকক্ষণ খাবারটা পড়ে ছিল। সকাল থেকে না-খেয়ে খিদেটা বার দুয়েক চাগার দিয়ে মরেই গেছে। স্যান্ডউইচে ছোট একটা কামড় বসাতেই ক্ষিদেটা চাগিয়ে উঠলো। মন মাতানো ডিমের স্বাদ! কালাটা এজন্যই ডিম এত ভালোবাসে! পিঙ্কি আবার ডিম ভক্ষণের খবর জানলে হুলুস্থুল করবে। ওর শ্বাশুরি কট্টর নিরামিষাশী। বৈধব্যের খুঁটিনাটি অক্ষরে অক্ষরে মানে। মনে মনে কথা বলছিলেন সরলা। জলের জন্য উৎকণ্ঠা, একা থাকবার কষ্ট, অল্প টাকার পেনশন, দুর্বল শরীর। তার উপর আমিষের বিধিনিষেধ চাপলে তো মেট্রো রেলের লাইনেই ঝাঁপাতে হবে। আমিষ খাবারটা জুত করে খেয়ে আবার এক গ্লাস ভর্তি জল পেটে ঢুকালেন সরলা। তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে চায়ে ছোট্ট চুমুক মারলেন। মনে মনে বললেন, ‘সত্যিকারের কথা এটা। ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না।’
ভরা পেট। শীতের দুপুরে হাল্কা বাতাস গায়ে মেখে বাড়ি মুখো ঠুক ঠুক হাঁটা ভালোই লাগছিল। হাতের ব্যাগটা তেমন ভারি নয়। রিনির কায়দার জুতো আর মুখরোচক কিছু খাবারের কতইবা ভার! বিকেলে জল আসবার আগেই পৌঁছাতে হবে বাড়ি। ভাবতে ভাবতে বাড়ির অনেকটা কাছে। মুখ তুলতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। গলির মুখে বটগাছ তলায় শিব মন্দিরের পেছনে ফুটপাথ ছাড়িয়ে রাস্তাতেও জমাট ভির। আরেকটু এগোতেই শ্লোগান কানে এল, কয়েকটি ছেলে-মেয়ের গলা ফাটানো চিৎকার, ‘বিকেলে জল এলোনা কেন, কমিশনার জবাব দাও’। ভিরের কাছকাছি আসতেই মুখগুলো একে একে চেনা গেল। অসুস্থ শরীরে সস্ত্রীক বলাই মাষ্টার এসেছেন, পশু চিকিৎসক দুবে বাবু ছুটি নিয়ে জমায়েতে সামিল। পুড়ানো এক বাড়ির লাল দাওয়ায় বসে বলাই মাষ্টারের সাথে নিচু গলায় পরামর্শ করলেন সরলা।
-এখন উপায়?
লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকলেন বলাইবাবু, ‘উপায় আর কি? সব ফক্কা। কবে এদের মেরামতি, তারপর টেস্টিং। শেষ হবে কে জানে! এখন ভগবান ভরসা। যদি অকাল বৃষ্টি নামে আর কি! ঘটি-বাটি যা আছে বাড়িতে, ভরে রাখতে হবে।‘
-সর্বনাশ! জলের অভাবে শুকিয়ে মরবো নাকি?
-আর কী করবে? বয়স হয়েছে, মিটিং-মিছিলে নেতাদের মুণ্ডুপাত করবে? একবার ভাবো, এদল ওদল সবাই উন্নতির জোয়ার আনছে। হায়রে উন্নতি! গঙ্গা পাড়ে সভ্য মানুষের জালাভাব! কোথাও আগুন লাগলে নেভানোর জল পাবে না।‘
বাড়িতে ঢুকে রিনির জন্য কেনা বোতলের দামি জল এক ঢোক গলায় ঢাললেন সরলা। তৃষ্ণা খানিক মিটতেই বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। তারপর কথার ভুরভুরি। একা থাকার এই এক অভ্যাস। নিজের সাথে যখন-তখন বাক্যালাপ। আর কত যুদ্ধ করবে লোক! খানা-পিনা-পাযখানা-পেচ্ছাপ চেপে মরবে নাকি? পয়সা বিনা তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে টেঁসে যাবে!
বলাই মাষ্টার বলছিলেন, সরকারি নিয়ম, শহরের প্রতি মানুষকে রোজ দেড়শ লিটার জল দিতে হবে। অথচ সারাদিনের চেষ্টায় মাত্র পচিশ লিটার জল জোগাড় হ’ল! সেই জলের সামান্য খরচ করে পুরোটাই জমিয়ে রাখতে হবে। বাথরুমে জলের কী হবে কে জানে! পিঙ্কির আবার ঘন ঘন হাত ধোবার অভ্যাস। রিনি বহুক্ষণ ধরে সাবান ঘসে। কাল যে কী ঘটবে? আগে রাগ হলে শঙ্করকে চুটিয়ে গাল পাড়তেন। যাবতীয় বিপদে ওই ছিল ভরসা। আর শঙ্করও সব বিপদ ঝঞ্জাট কাঁধে তুলে মুশকিল আসান করে গলা ফাটিয়ে হাসতো। চার বছর পরে চোখের জল মুছতে মুছতে আবার শঙ্করকে গালি পাড়ছেন সরলা, ‘নিজে তো ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলে। এখন দেখ আমার হাল! মাথা খুঁড়ে পিপাসার জল পেতে হয়। তুমি কিছু একটা কর শঙ্কর, না-তো সত্যি এবার মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দেবো।‘
দরজায় টোকা পড়লো, ‘দাদী ও দাদী।’
ঘরে ঢুকেই হাত বাড়াল কালা, ‘দাদী, আণ্ডা খিলাও।’
ঠোঙা থেকে একটা ডিম সিদ্ধ বের করে কালার হাতে দিলেন সরলা।
-দাদী, আজ ভাত খাইলু না’, ডিমে একটা কামড় বসাল কালা।
-না, বাইরে ডিম স্যান্ডউইচ খেয়েছি’, সরলা চোখ মুছে বললেন।
-ঠিক করলু দাদী। মাষ্টার বলে, ‘আণ্ডা খাও তাকত বাড়াও।’ কালা ওর হাতের পেশি দেখাল।
হাসিতে ঝকমক করে উঠলো সরলার ক্লান্ত মুখ। কালার মাথায় হাত রাখলেন, ‘জল কবে আসবে রে?’
-হালত খারাপ দাদী। মা-নানি-বাপু বুলাইছে, তিন-চার রোজ আউর সুখা থাকবে।
-তাহলে উপায়?
ঠোঁট উল্টে নিজের অক্ষমতা জানালো কালা। গভীর একটা শ্বাস ফেললেন সরলা, ‘হা-ভগবান!’
সরলার পিঠে হাত রাখল কালা। হাতের ছোঁয়ায় আশ্বাস, ‘দাদী পানি কে লিয়ে ভাবিস না। মা বুলাইছে, মহাদেব সব দেবতাসে বড়া। তকলিফ হো, মহাদেব কো বোলো।’
চমকে উঠে কালার দিকে তাকালেন সরলা, ‘তোর মহাদেব কোথায় থাকে রে?’
টিভির দিকে আঙুল তুললো কালা, ‘দাদী, ভগবানের সিরিয়ালটা লাগাইলু, দেবাদিদেব’।
‘ও আমি দেখি না’ বলে খবরের চ্যানেল গুলোয় সার্ফ করতে থাকলেন। একটু পরেই শুনলেন, খুব উত্তেজিত কণ্ঠে সান্ধ্য আবহাওয়ার খবর পড়ছেন ঘোষিকা। ‘আন্দামান উপসাগরে গতকালের নিম্নচাপ শক্তি বৃদ্ধি করে আজ রাতে বঙ্গোপসাগর উপকূলে আছড়ে পড়বে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আজ গভীর রাতে প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা।’
খবরের বাকী অংশ না-শুনে টেলিভিশন বন্ধ করে লাফিয়ে উঠলেন সরলা, ‘জয় শঙ্কর মহাদেব!’
কালার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কর। মন্দিরে মহাদেবের মাথায় জল ঢেলে সব বালতি-মগ-ঘটি-গামলা ছাতে দিয়ে আসবো। এখন ভগবান ভরসা! বৃষ্টি এলে রাত্তিরে সব টাপ-টুপ ভরে যাবে, বুঝলি!’
-আর বারিষ না আইলা তো?
-আসবে আসবে, আজ রাত জেগে বৃষ্টির অপেক্ষা করবো আমি। ‘জয় শঙ্কর মহাদেব।’
বুঝে হোক কি না-বুঝে, সরলার খুশিতে ডগমগ মুখের দিকে তাকিয়ে কালা খিল খিল করে হাসতে থাকলো।
হায় পানি
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026.
প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)।
পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন