মানুষের কাছে আজ বিস্মৃত তিনি; তিনি বাংলাদেশের তার সময়ের একজন প্রথিতযশা ভাস্কর্যশিল্পী ও চিত্রশিল্পী ছিলেন। প্রয়াত হয়েছেন তেতাল্লিশ বছর আগে। বরিশালের গোঁড়াচাঁদ দাস রোডে কাটে তার আজীবন। চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে তিনি প্রাচীন বাংলা ও ভারতে ভাস্কর্য নির্মাণের কিছু কিছু কৌশল প্রয়োগ করেই তৈরি করতেন ভাস্কর্য। রীতিমতো শিল্পশাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সেই শিল্পশাস্ত্রের জ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন। ভারতবর্ষের শিল্পীদের জন্য শুক্রনীতি (শিল্প আইন) ও শিল্প সম্পর্কিত সমস্ত বই-পুস্তকে কলাশিল্প নিয়ন্ত্রণের যে সব সূক্ষ্ণ ও কঠোর নিয়ম আছে- তা তার শিল্পকর্মের মধ্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান। তিনি শাস্ত্রীয় বিধান, মূতির্র ধ্যান, রূপতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলে ধারনা করা হয়। তাঁর শিল্পের বিষয়, মডেলিং, কার্ভিং ও মিশ্র পদ্ধতিতে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্যের শ্রেণিবিন্যাসে দেহকাণ্ড, পূর্ণদেহ, মুখোশ, জন্তুসদৃশ। আর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্লাস্টার অব প্যারিস, মাটি, কাঠ, পাথর ইত্যাদি। প্রকৃতি অনুসারে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্য নীরব বা অচঞ্চল, গতিময় এই দুই প্রকৃতি তার শিল্প কর্মের মধ্যে দেখা যায়। এই শিল্পীই বোধহয় পূর্ব বাংলার প্রথম যিনি শিল্পকর্ম তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্লাস্টার অব প্যারিস।
চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদারের জন্ম বরিশাল শহরের অক্সফোর্ড মিশন রোডে মিশনারীদের ম্যারি এন হাসপাতালে ১৯৩৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। পিতা বিশ্বনাথ হালদার, মা তরী হালদার। চল্লিশের দশকের শেষে অক্সফোর্ড মিশন পাঠশালা, অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুল ও পরে বরিশাল জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯৫৫ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশান পরীক্ষায় পাশ করেন। সদর রোডের তৎকালীন কাকলী হলের দেয়ালে বাংলা চলচ্চিত্রের দেয়ালচিত্র আঁকার কাজ পান। স্কুল জীবনে ধুতি পরতেন; পরে তিনি চুল বড় রাখতে শুরু করেন।
১৯৫৯ সালে ঝর্ণা হালদারের সঙ্গে বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট মিশন চার্চে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম পুলিন মিত্র যিনি পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন। আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ছুটির ঘন্টা’ চলচ্চিত্রে পুলিন মিত্র অভিনয়ও করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে পুলিন মিত্র একজন সহকারী চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জিঞ্জির’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন। সে চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন দিলীপ বিশ্বাস। দিলীপ বিশ্বাস (১৯৪৬-২০০৬) বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে একজন খ্যাতনামা গায়ক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক; তিনিও একসময়ে শিল্পী চিত্ত হালদারেরও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।
চিত্ত হালদার ১৯৬১ সালে বরিশাল শহরের কালীবাড়ি রোডে ‘চিত্রালী’ নামে হস্তশিল্প বিক্রয়কেন্দ্র খোলেন। দেশি-বিদেশী অনেক দুষ্প্রাপ্য বই তার সংগ্রহে ছিল; যেমন: শেক্সপীয়ার, নিটশে প্রমুখ। সেসময় তিনি চুরুট খেতেন, হাফপ্যান্ট-গ্যাঞ্জি পরতেন। ১৯৬৪ সালে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, শ্বেতপাথরের সে ভিত্তিপ্রস্তরটি তিনি ইংরেজিতে খোদাই করে দেন। ১৯৬৫/৬৬ সালে একটি বক্স ক্যামেরা তৈরি করেন ও ছবি তোলা শুরু করেন। এ সময় তিনি বরিশালের অনেক লেখকের গ্রন্থের রুচিসম্পন্ন, নান্দনিক ও একাধিক রঙের প্রচ্ছদ তৈরি করে দেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে চিত্ত হালদার তার সহযোগী হেলাল উদ্দিন, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান কচি ও এনায়েত হোসেন মিলনকে নিয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে বোমা তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করেন ও গোড়াচাঁদ দাস রোডের নিজ বাড়িতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ৪ এপ্রিল বাসায় বোমা বিস্ফোরণে আহত হলে দেখতে আসেন ৯নং সেক্টর কমাণ্ডার মেজর জলিল। তারপর কালীবাড়ি রোডের ধর্মরক্ষিণী সভায় বরিশালের তরুণদের প্রগতিশীল সংগঠন ‘যুবসংঘ’ এর কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মলোটভ ককটেল, হ্যান্ডগ্রেনেড, ডিনামাইট, রকেট লাঞ্চার, ট্যাংক বিধ্বংসী বোমা প্রস্তুত করেন; সেখানে তার সঙ্গে ছিলেন হেলালউদ্দিন, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান কচি, এনায়েত হোসেন মিলন, মিন্টু বসু, মাহতাব, এস. এম. ইকবাল, ডা. এস সি রায়, হারেচ খান, নজরুল ইসলাম চুন্নু, ফরিদ খান প্রমুখ। বরিশাল জিলা স্কুলের পুরনো বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নিচে একটি বোমার সফল পরীক্ষা করেন। তার তৈরি বোমা ব্যবহৃত হয়েছিল চাঁদপুর-খুলনার মুক্তিযুদ্ধে। ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২৫ এপ্রিল সড়ক-নৌপথে আক্রমণ ও ছত্রীসেনা নামিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বরিশাল শহর দখলে করে নিলে দ্বিতীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হতে পারেনি। তাকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। তার বাবা-মা দেশত্যাগে রাজি না হওয়ায় পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। রাজাকাররা তাকে খুঁজতে থাকে। পাকিস্তানী সেনারা দু’বার তার বৃদ্ধ বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় ওয়াপদা ক্যাম্পে; জিজ্ঞাসাবাদ ও নিপীড়নের পরে ছেড়ে দেয়। আগস্ট মাসে শরণার্থী হিসেবে পরিবারসহ ভারতে পৌঁছান। দমদমে জ্যাঠাতো ভাইয়ের বাড়িতে ওঠেন, সেখানেও শিল্পকর্মের কাজ করেন। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল স্বাধীন ও ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ পেয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন দেশে ফেরার জন্য। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে ফেরার সময় কলকাতায় থাকা অবস্থায় তার তৈরি শিল্পকর্মের কিছু অংশ সাথে করে নিয়ে আসেন। বরিশাল ফিরে দেখতে পান তার দোকান ও বাসা লুট হয়েছে।
দেশে ফিরেই তিনি বরিশালের কালিবাড়ি রোডে স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের নক্সা করেন এবং তার তত্ত্বাবধানেই শহীদ স্মরণেই এই মিনার নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে তৎকালীন উদয়নী ক্লাবের সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাদ সহ সে সময়কার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে এবং মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদারের নক্সায় তৈরি হয়েছিল এই শহীদ মিনার। জীবিকা নির্বাহের জন্য আয় অপ্রতুল হওয়ায় ঢাকা যান, সেখানে চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের সান্নিধ্য ও সহযোগিতা লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে জাতীয় জাদুঘরের তৎকালীন পরিচালক ড. এনামুল হকের আহ্বানে ‘মহামায়া’র, শাস্ত্রীয় পরিচয় গৌরির ১০০ রেপ্লিকা ভাস্কর্য তৈরি করে দেন। ঢাকায় ‘বাংলাদেশ এজেন্সী’, ‘মলুজ’, ‘ভোগ’, ‘তৈজস’, ‘শিষমহল’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে তার শিল্পকর্ম সরবরাহ করেন। তিনি তার মৌলিক শিল্পকর্মে যেমন লোকজ বাংলার শেকড়সন্ধান করেছেন, তেমনি ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম অবলম্বনে কাজ করেন। যেমন: আমেরিকান চিত্রশিল্পী Warner Sallman, জার্মান চিত্রশিল্পী Fridolin Leiber, ফরাসী চিত্রশিল্পী Pierre Auguste Cot ও ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী Andrea Del Sarto প্রমুখের চিত্রকর্ম অবলম্বনে চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য তৈরি করেছেন।
বরিশালের চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর চিত্ত হালদারের নেই কোন আর্ট কলেজ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী। তবে তিনি প্রাচীন বাংলা ও ভারতে ভাস্কর্য নির্মাণের কিছু কিছু কৌশল প্রয়োগ করেই তৈরি করতেন ভাস্কর্য। সে সময়ে শিল্পীরা মনগড়া কোন ভাস্কর্য তৈরি করতেন না। রীতিমতো শিল্পশাস্ত্র অধ্যয়ন অথবা সেই শিল্পশাস্ত্রের জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন। ভারতবর্ষের শিল্পীদের জন্য শুক্রনীতি (শিল্প আইন) ও শিল্প সম্পর্কিত সমস্ত বই-পুস্তকে কলাশিল্প নিয়ন্ত্রণের যে সব সূক্ষ্ণ ও কঠোর নিয়ম আছে- তা তার শিল্পকর্মের মধ্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান। তিনি শাস্ত্রীয় বিধান, মূতির্র ধ্যান, রূপতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলে ধারনা করা হয়। তাঁর শিল্পের বিষয়, মডেলিং, কার্ভিং ও মিশ্র পদ্ধতিতে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্যের শ্রেণিবিন্যাসে দেহকাণ্ড, পূর্ণদেহ, মুখোশ, জন্তুসদৃশ। আর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্লাস্টার অব প্যারিস, মাটি, কাঠ, পাথর ইত্যাদি। প্রকৃতি অনুসারে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্য নীরব বা অচঞ্চল, গতিময় এই দুই প্রকৃতি তার শিল্প কর্মের মধ্যে দেখা যায়। এই শিল্পীই বোধহয় পূর্ব বাংলার প্রথম যিনি শিল্পকর্ম তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্লাস্টার অব প্যারিস।
ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী চিত্ত হালদার গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক রূপ ও বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের জীবন তিনি তার ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে তুলে ধরেছেন। তার তৈরি মৌলিক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে কৃষক, জেলে, শ্রমিক, কলসী কাঁখে বধূ, রাখাল ছেলে ও বাঁশী পালকী ও নববধূ,বেদে নারী ও সংস্কৃতি, সাঁওতালী নারী, স্নানরতা রমনী, প্রাসধনী বা সন্ধ্যায় সাজে রমনী, মিথুন, জোড়ামুখ, নারী, মাদার মেরী, যিশুখ্রিস্ট, পূজারিণী, মহামায়া, স্বরস্বতী, ভেনাস, লিডা ও রাঁজহাস, ওমর খৈয়াম ও সাকী, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথা ঠাকুর অন্যতম।
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে জুন মাসে তাকে বরিশালে ফিরিয়ে আনা হয়। সে বছর ১৯ জুলাই লিভার সিরোসিস রোগে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাড়ির পাশের গোরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ●