-ওঃ, কি বীভৎস। গান নেই, ক্যারল বাজে না… শুধু র্যাকুনের চিৎকার! আমি পাগল হয়ে যাবো।’ দু’কান চেপে ভনের গলা ফাটানো আর্তনাদ।
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে নিজের হাঁটুতে ঘুষি মারছে গর্টন, ‘এর পর যদি হাতি গুলো স্টেডিয়ামের গেট ভেঙে দেয়?’
একটু থেমে আমার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘জানোয়ার গুলো দেশটাকেই তো দখল করে নেবে। কেন যে মরতে এলাম?’
কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। শুধু দিমিত্রিয়স প্যানডারমেলিসের কাঠখোট্টা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ওর কথায় নেচে কেন যে অজানা দ্বীপটা দেখতে এলাম! প্রাণ নিয়ে ফিরবো কী করে?
সেদিনের মিটিং। সিন্তাগমা স্কোয়ারে গ্র্যান্ডি ব্রিটানি হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হল। গ্রীক পার্লামেন্টের ঠিক উল্টো দিকে। আন্তর্জাতিক আবহে জমে উঠেছে গল্প গান-বাজনার আসর। এক্রোপলিসের উঁচু আলোকিত থাম গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে মুখ করে একটা বিশাল সোনালি-স্ফটিক ঝাড়বাতির নীচে আমি আর এরিক পাশাপাশি বসেছি। আমাদের টেবিল ঘিরে পাঁচটি চেয়ার। আমার উল্টো দিকে মাইকেল গর্টন। তার বাঁ-পাশে অস্ট্রেলিয়ার বৃদ্ধ অধ্যাপক হিরাথ। ডান পাশে বিশাল বপু দিমিত্রিয়স প্যানডারমেলিস।
চোখ বুজে ভেড়ার ঝলসানো ঠ্যাঙে বড় মাপের একটা কামড় বসালেন অধ্যাপক দিমিত্রিয়স। বরফকুচি মেশানো মেটাক্সা ব্র্যান্ডির গবলেট দু’চুমুকে খালি করে মুখ খুললেন। গম গমে গলা। আগের কথার রেস টেনে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললেন, ‘...রাউডাস, রোডস নয় কিন্তু। যদি জীব–জন্তু দেখতে চান, রাউডাস যান। প্রাণী বৈচিত্র্যে অসাধারণ।’
বিশ্বের এক নম্বর প্রাণী বিশারদ দিমিত্রিয়স। প্রাণী বৈচিত্র নিয়ে কিছু বললেই লোকে হাঁ-করে শোনে। সামুদ্রিক সিংহের প্রজনন বিষয়ে দিমিত্রিয়সের অসামান্য অবদান। নিজের দেশে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর পুরস্কার পেয়েছেন দিমিত্রিয়স। এখন গ্রীসের দু’টো বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের–-জৈব রসায়ন আর প্রানী জিন তত্ব, উনি কর্ণধার। ইউনিভারসিটি অফ থেসালে এবছর ‘প্রানী বৈচিত্র ও মানুষ’ বিষয়ে উনিই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছেন।
গত বছর সম্মেলন হয়েছিল ফিলাডেলফিয়াতে। তার আগের বছর জার্মানির হাইডেলবার্গে। এ-বছর দিমিত্রিয়সের নেতৃত্বে এথেন্সে। পৃথিবীর একশো তিনটি দেশের চারশ প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। এত লোকের হোটেল, খাবার ব্যবস্থা সব কিছুরই নিখুঁত আয়োজন। অসামান্য দক্ষতায় যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেছেন অক্লান্ত দিমিত্রিয়স। কিছু ছিটেফোঁটা সরকারী অনুদান অবশ্য মিলেছে। আর দিমিত্রিয়সকে সাহায্য করেছেন দুই অধীনস্ত সংস্থার দশ বারো জন কর্মচারী। অবশ্য ওঁর ত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রীও গত এক মাস দিন রাত্রি এক করে খেটেছেন।
আজ সম্মেলনের চতুর্থ এবং শেষ দিন। সারা দিনের বক্তৃতা, বিতর্ক, তথ্য আদান প্রদানের পর সন্ধ্যে নামতেই গালা ডিনার। জমায়েত হয়েছেন সব দেশের প্রতিনিধি। আমরা বড় একটা টেবিল দখল করে পার্লামেন্টের দিকে মুখ করে বসেছি। নিজেদের মধ্যে কথা চলছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন দিমিত্রিয়স। মুখের ভিতর আরেক পেগ মেটাক্সা ঢেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর তিন মিনিট সময় হাতে। আপনাদের অনুমতি নিয়ে এবার আমি উঠি। প্রধানমন্ত্রী আসবেন। অভ্যর্থনা জানিয়ে ওনাকে ডিনারে নিয়ে আসবো।’
গব্লেটটা টেবিলে নামিয়ে দিমিত্রিয়স বললেন, ‘আপনারা আড্ডা চালিয়ে যান। শুনুন...যে কথা বলছিলাম, গ্রীস আর তুরস্কের মধ্যে হাজার ছয়েক দ্বীপ আছে। ক’টার খবর আমরা রাখি? স্যান্তোরিনি, কর্ফু, ক্রিট, মাইকোনাসের কথা লোকে জানে। কিন্তু পিপোরি, ক্যাসত্রস, রাউডাসের কথা কেউ বলে না।’
একটু থামলেন দিমিত্রিয়স। তারপর আবার, ‘রাউডাস সম্পর্কে আমাকে বলেছেন ফিলিপ্পস পরিচিস। রাউডাসের গভীর জঙ্গলে জলপাই গাছের ডালে ঝুলন্ত হাইড্রা নিজের চোখে দেখেছেন। ক্রিটের প্রবীণতম সর্প-বিশারদ ফিলিপ্পস। বহুবার রাউডাসে যেতে বলেছেন কিন্তু আমার যাওয়া হয় নি। আপনারা গেলে আমি খুবই খুশী হব। ভাগ্যে থাকলে নতুন জন্তুও দেখতে পাবেন। গ্রীক পুরাণের এত এত প্রাণী!’
আমার উল্টো দিকে বিজ্ঞানী গর্টন এতক্ষন চুপ করে দিমিত্রিয়সের কথা শুনছিলেন। গর্টন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী জিন-তত্ত্ব বিভাগের প্রধান। দিমিত্রিয়স উঠে যেতেই গর্টন হো হো করে হেসে উঠলেন। গলায় একটু পানীয় ঢেলে বললেন, ‘রাউডি দ্বীপে পৌরাণিক জন্তু! রাবিশ। গুল মারবার যায়গা পায় না!’
আমার ডান দিকে বসেছিলেন অধ্যাপিকা মিসেস ভন এরিক। মোটাসোটা শরীর কিন্তু কণ্ঠস্বর মিহি। মিহি গলা উঁচু পর্দায় তুলে একচোট বকে দিলেন স্বল্প পরিচিত গর্টনকে, ‘এত হাসির কি আছে? দ্বীপটার নাম রাউডাস। আশ্চর্য্য দ্বীপ। আমি যাবোই।’
ভন বৈজ্ঞানিক নন। জার্মানির এলাঙ্গেন শহরে মার্টিন লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপিকা। ওঁর গবেষণা একটু নতুন ধরনের। পৌরাণিক প্রাণী ও বাস্তবতা। যেমন, গ্রীক পুরানের সেন্টর, ঘোড়ার শরীরে মানুষের মুখ। তিন মাথায়ালা বিশাল সাপ, হাইড্রা। স্ফিংক্স, সিংহের শরীরে পাখা আর মানুষের মুখ। আধুনিক প্রাণী বিদ্যার বিচারে এদের অস্তিত্ব কি সম্ভব? দীর্ঘ সময় ধরে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন উনি।
আমি ভনের সাথে ওর গবেষণার বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা করিনি। দেখেছি জিন-তত্ত্ব আর বিবর্তনের ধারনা ওঁর একদমই স্বচ্ছ নয়। আমি ‘বকচ্ছপ’, ‘হাতিমি’ আর সহস্র মুখওয়ালা কালনাগিনীর কথা শুনিয়ে ছিলাম ওঁকে। আগামী বছর জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনে আসবার কথা ভনের।
ইতিহাসবিদ ভন আমার কাছে শকুনের পৌরাণিক গল্প শুনতে চেয়েছে। শকুন-প্রজনন সংক্রান্ত আমার গবেষণা এই সম্মেলনে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারতের মত গ্রীসেও শকুন বিলুপ্তির পথে। আমার গবেষণার কার্যকারিতা প্রমাণিত হবার পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বন দপ্তরের সহায়তায় শকুন প্রজনন কেন্দ্র চালু হয়েছে। গ্রীসের কালো শকুন আজকাল দেখা যায়না। গ্রীক বন্ধুরা বলে, এখনো কিছু নির্জন দ্বীপে নাকি কালো শকুন টিকে আছে। কালো চকচকে শরীর, মাথায় টাক আর লাল ঠোঁট। ওই পাখি দেখবার একটা সুপ্ত ইচ্ছা আমার ছিলই। ভনের কথা আমার ঐ দ্বীপে যাবার বসনা উস্কে দিল।
ভদকা-জিন-ব্র্যান্ডির ককটেল শেষ করে গর্টন আবার হাসল। জড়ানো স্বর। বলল, ‘দিমিত্রিয়স প্যানডারমেলিস! লোকটা এখনো পাগল। ওকে তো কুড়ি বছর দেখছি। বোস্টনে ওর সাথে রাগবি খেলতাম। মারকুটে খেলোয়াড় ছিল। এখনও আগের মত পেটানো শরীর। জমিয়ে আড্ডা মারতে পারে। আর বাড়িয়ে বলা ওর বরাবরের অভ্যাস। তবে ওর রাউডি দ্বীপে আমি যাবো। নতুন জীবজন্তু কিছু না-দেখলে থেসালের বক্সিং রিঙে ওর নাক ফটিয়ে দেবো।’
গর্টনের কথায় মুচকি হেসে ভন এরিক আমার দিকে মুখ ফেরালেন। ওর চোখেমুখে উত্তেজনা। বললেন, ‘ওই দ্বীপ সম্বন্ধে আমি আগেও শুনেছি। এটা মার্চ মাস। এ-সময় ওখানে একটা উৎসব হয়। সব জন্তুদের নাকি খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যায়।’
পাঁচ দিন হল এথেন্সে আছি। সম্মেলনে বক্তৃতা বিতর্ক সবই ছক বাঁধা নিয়মে চলছিল। আমার পরিকল্পনা ছিল এথেন্সে আরো কটা দিন কাটিয়ে বিশ্রাম নেবো স্যান্টোরিনি দ্বীপে। তারপর ক্রিট। ওখানে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শকুন-প্রজনন সংক্রান্ত দুটো বক্তৃতা দিয়ে দেখতে যাবো প্রাচীন মিনোয়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এথেন্সে ফিরে আসবো। প্লাকায় কিছু কেনা কাটা সেরে সক্রেটিসের কারাগার দেখে দুবাই হয়ে কলকাতা।
কিন্তু দিমিত্রিয়সের রাউডাস, গর্টনের মার্কিন উচ্চারনে রাউডি, সব প্ল্যান উল্টে দিলো।
গালা ডিনার চলবে সারা রাত। ক্ষেপে ক্ষেপে পরিবেশণ করছে জোব্বা, শিরস্ত্রাণ পরা সুঠাম দেহী গ্রীক যুবক। ভায়েলা আর বুজুকি বাজাচ্ছেন শিল্পীরা। গ্রীক সুন্দরীরা নাচের তালে তালে রঙিন পানীয় ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে। সুর মূর্ছনার সাথে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে এল ল্যাম্ব। এরপর মাইসাকা তার অনেকক্ষণ পর এল রোসটেড বিফ।
খাবার খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। মনের ভিতর একটা চাপা উত্তেজনা! হাতে সময় কম। আবার ভারতীয় দূতাবাসকে না-জানিয়ে অন্য এক জায়গায় যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া। মনটা খচ্ খচ্ করছিল। আমার সংশয় কাটাতে ভন গলা উঁচিয়ে বলল, ‘কী আর হবে, আমরা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক!’
ককটেলে আলতো একটা চুমুক দিল গর্টন। স্বরে কৌতুক। বলল, ‘সামান্য নিয়ম ভেঙেছ বলে তোমার দেশ জেলে পুড়বে? আরে তোমাকে বন্দী করলে সরকার বিরোধী দল কি আঙুল চুষবে! তুমি আরেকটু ভাবো।’
আরেকটু ভেবে আমি রাজি হয়ে গেলাম। অধ্যাপক হিরাথ রাজি হলেন না। বললেন, ‘হাইড্রা দেখতে গিয়ে জঙ্গলে মরবো নাকি! অনেক দেখেছি পাঁচ মুখো সাপ। নিউজ অফ ইটালিকাতে গতকালের সংবাদ, দেশের মন্ত্রী, তার পুত্র পুত্রবধূ মেয়ে জামাই কয়েকটা দ্বীপ বিক্রী করে বিদেশের ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় বানিয়েছে। পত্রিকা সম্পাদক মন্ত্রীর কাজের তারিফ করে লিখছে, প্রাচীন দেশের পবিত্র ভূমিতে এক পঞ্চমুখী রক্তচোষা হাইড্রার সন্ধান মিলেছে।’
হিরাথের কথায় প্রান খোলা হাসি ছড়িয়ে ভন বলল, ‘দারুণ বলেছেন। তাহলে স্যার, আপনাকে ছেড়েই আমরা রাউডি যাচ্ছি।’
‘যাত্রা শুভ হোক’ বলে হিরাথ প্রস্থান করলেন। তার একটু পরেই আমাদের সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। পরশু দিন আমরা তিন জন যাচ্ছি রাউডি দ্বীপ। মিসেস ভন বাচ্চা মেয়ের মত দু’হাত তুলে লাফাতে লাফাতে বললেন, ‘দারুন রোমাঞ্চ হচ্ছে! মন বলছে কোন পৌরাণিক জন্তু দেখতে পাবো।’
পোর্ট অফ এথেন্স থেকে রাউডির জাহাজ ছাড়েনা। ছাড়ে ক্রিট থেকে। তাই অজিয়েন্স এয়ার লাইন্সের বিমানে এথেন্স থেকে ক্রিট। বিখ্যাত ক্রেটা মারিস হোটেলে রাত্রি যাপন। ওখান থেকে বাড়ীতে ইমেল করে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম। পর দিন ক্রিটের হেরাল্কিয়ন বন্দর থেকে দিনের একমাত্র রাউডি গামী জাহাজ ‘দি হারমিস’ ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে যাত্রা শুরু করল। সারাদিন জাহাজে ভেসে চলা। ক্রিট থেকে তুরস্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জাহাজের মধ্যেই কফি শপ, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট। গর্টন আর আমি বিকেলে টেনিস খেললাম কিছুক্ষণ। তারপর স্নান সেরে বড় একটা চিকেন বার্গার গিলে সন্ধ্যে বেলাতেই সোফায় গা এলিয়ে দিলাম।
কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ কানের কাছে ভনের চিৎকার। ‘উঠে পড়, উঠে পড়। অদ্ভুত দ্বীপ। একবার তাকাও’।
ভোরের আলোয় চোখের সামনে আবছা নীল আকাশ। ভূমধ্য সাগরের উত্তাল জল রাশির ক্যানভাসে দুলছে কুয়াসার হাল্কা চাদর-মোড়া এক বিচিত্র দ্বীপ। সকালের রূপালী আলোয় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে এক পাথুরে স্থলভূমি। তিন দিকের সবুজ পাহাড় দ্বীপটাকে প্রায় বৃত্তের আকারে ঘিরে রেখেছে। পাহাড়র মাথা জুড়ে ঘন অরণ্য। নীচে ট্যানাগ্রা পোর্টের পাথুড়ে মাটি। বন্দরের সমতলে হামলে পড়ছে ফেনিল জলরাশি।
চারটে ছোট ছোট শহর নিয়ে রাউডি দ্বীপ। রাজধানী ট্যানাগ্রা। রাজধানীর চারদিকে মোটা তারের ঘন জাল। বন্দরটাও জাল দিয়ে ঘেরা। পায়ে পায়ে ডেকে নেমে এসেছি। আমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে গর্টন বলল, ‘এরকম কোথাও দেখিনি। জঙ্গলের জন্তু যাতে ঢুকতে না-পারে তাই এই ঘেরাটোপ। আমরা খাঁচায় বন্দী, জীবজন্তুরা মুক্ত। খুব মজা লাগছে। দিমিত্রিয়স খুব ভালো জায়গায় পাঠিয়েছে।’
ভন প্রতিবাদ করল, ‘জীবজন্তু কোথায় দেখছো তুমি?’
‘আসবে আসবে, অনেক জন্তু দেখতে পাবে। দ্বীপের ভিতর একবার ঢোকো না!’ বাচ্চা ছেলের মত শরীর নাচাল গর্টন।
আমাদের কথা শুনে স্থানীয় এক ভদ্রলোক পরিষ্কার ইংরাজিতে বললেন, ‘এই দ্বীপের সভ্যতা কিন্তু খুবই প্রাচীন। ইতিহাস ভুলে আমাদের মুখে শুধু বিপনন আর উন্নয়ন। অবশ্য উন্নয়নের ছোঁয়ায় ইদানিং ঝকমক করে এই দ্বীপ। এর মাঝখানটায় প্রাচীন অলিম্পিয়াডের ধাঁচে বাহারি বাতিস্তম্ভে সাজানো একটা ঝাঁ-চকচকে স্টেডিয়াম আছে। মাঠের চারদিকে হালফ্যাশনের গ্যালারি। স্টেডিয়ামের বাইরে তৈরি হয়েছে রাস্তা স্কুল কলেজ। উন্নয়নের জোয়ার বইছে গোটা দ্বীপে। হয়েছে অনেক কিছু। আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানকার হুইস্কি আর জলপাই তেলের দুনিয়া জোড়া খ্যাতি। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে রপ্তানি করে লাভ ঘরে তুলতে পারে না। বহু দক্ষ কর্মী থাকলেও এখানে কারখানা তেমন নেই। শ্রমজীবী মানুষ মুলত কৃষিজিবী।‘
ভদ্রলোকের কথা শুনতে শুনতে জাহাজ থেকে আমরা পায়ে পায়ে নেমে এলাম। উনি বলে চলেছেন, ‘আমাদের সুরক্ষার জন্য এখানকার শ্রমিকরা বন্দরটা জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছে। জঙ্গলের প্রানীরা যাতে ঢুকতে না পারে। শহরের চারদিকেও উঁচু প্রাচীর। মাঝে মাঝে লোহার গেট। উৎসবের সময় গেট গুলো খুলে দেওয়া হয়।’
জাল দিয়ে ঘেরা জনপদে মিনিট পনের হাঁটতেই হোটেল এলাকার দিকে আঙুল তুলে স্থানীয় মানুষটি অন্য পথ ধরলেন। দুটো হোটেল দেখে সস্তাটাই পছন্দ করল ভন। হোটেল ‘র্যাকুন’। এর সমুদ্রমুখী পরপর তিনটে ঘরের দখল নিলাম আমরা।
নিজের বন্ধ ঘরে ভন। লাউঞ্জে আমি আর মাইকেল গর্টন। কফি দিয়ে গেল রাউডি যুবতী। বিচিত্র সাজ পোষাক। কালো স্কার্ট, হাঁটু অবধি কালো মোজা। কালো টি-শার্টে অর্ধেক ঢাকা উদ্ধত বুক। দু’চোখের উপর-নিচে কালো ফেসপ্যাক।
গর্টন বলল, ‘এটা র্যাকুনের সাজ। র্যাকুন জানো! সর্বব্যাপী সর্বভুখ। আমিষ নিরামিষ পচা টাটকা সব খায়। সাংঘাতিক জন্তু। সারাক্ষণ উৎকট চিৎকার করে। পাহাড় জঙ্গল মাঠ ফসলের ক্ষেত বাড়ীর গ্যারাজ সর্বত্র থাকতে পারে। একবার তাড়া করলে রক্ষে নেই। অনেক বড়লোক ক্ষমতাবান আবার এদের পোষ মানায়। একবার র্যাকুনের পাল্লায় পড়েছিলাম। ভালো দৌড়াতে পারতাম, তাই রক্ষে। আচ্ছা, এখানে কোন র্যাকুন যদি মুটকি ভনকে তাড়া করে!’ বাচ্চা ছেলের মত একমুখ দুষ্টুমি নিয়ে নিজের রসিকতায় হাসতে হাসতে গর্টন ঘরে ঢুকল।
আমিও নিজের ঘরে ঢুকে গরম জলে স্নান করে পেট পুরে কেক, স্যান্ডুইচ, মাইসাকা আর কফি খেলাম। তার পরেই দু’চোখে ঝাঁপিয়ে ঘুম। কম্বল মুড়ি দিয়ে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ দরজায় কেউ আঁচর কাটছে মনে হল। দরজা খুলতেই এক সুন্দরী বিড়ালাক্ষী। সাপের মত হিলহিলে শরীরে সবুজ মিনি স্কার্ট। ফর্সা লিকলিকে পায়ে সবুজ মোজা। টেবিলে চায়ের পট নামিয়ে ঘাড় দুলিয়ে বলল, ‘বাজার করতে হলে আজই সেরে নাও। কাল থেকেই তো অ্যানিমাল ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল। সব গুলো গেট ঝপাং করে খুলে যাবে আর পাহাড় জঙ্গল থেকে পিল পিল করে বুনো জন্তু গুলো বিকট শব্দ করে নেমে আসবে।’
বেতের মত শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে রাউডি তরুণী প্রস্থান করল। মনে হল লিকলিকে সবুজ একটা লাউডগা অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় এঁকে বেঁকে বেড়িয়ে গেল আমার ঘর থেকে।
খুব সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিল গত কালকের সেই লাউডগা মেয়েটি। ঘরে খাবারের বড় একটা প্যাকেট রেখে ক্ষিপ্র গতিতে বেরিয়ে গেল। একটু পরে হোটেল মালিকের নির্দেশ মত ঘর থেকে পথে নেমে এলাম। গায়ে নরম রোদ মেখে হাল্কা শীতে দশ মিনিট হেঁটে স্টেডিয়াম। প্রধান ফটকে আমাদের টিকিট দেখাল ভন। গেট পেরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে গ্যালারিতে উঠলাম। মাথার উপর আকাশের ঘন নীল চন্দ্রাতপে ছোপ ছোপ সাদা মেঘ। পেছনে ভুমধ্য সাগর। ধুসর নীল জলের গর্জন দূর থেকেও কানে আসছে। সামনের গোলাকার মাঠে ঘাসের ঘন সবুজ কার্পেট। মাঠের চার দিকেই বাঁধানো গ্যালারি, মাথায় ছাদ। আমাদের গ্যালারিতে মানুষ কম। টি-রুমে পর্যাপ্ত খাবার। চা-কফি-হুইস্কি-জল। তার পাশে ঝকঝকে বাথরুম।
ঘড়িতে আটটা। সাইরেনের কান ফাটানো শব্দ। থামতেই তুমুল করতালি। ধীরে ধীরে কপাটগুলো খুলে গেল। দিনের আলোয় শহরের মাঠ আর ঘণ অরণ্যের বিভাজন মুছে গেল। গ্যালারি থেকে পরিষ্কার দৃশ্যমান সবুজ মাঠ। মাঝখানে টেনিস কোর্ট মাপের সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু বেদী। পূর্ব দিকের কোণে তাক লাগানো দৃশ্য।
পাহাড় থেকে নাচতে নাচতে নেমে আসছে ঝর্ণা। তার পাশে খুব বড় কয়েকটা সিডার গাছ। একটু দূরে বৃদ্ধ ওক। তার পিছনে ঝুড়ি নামিয়েছে কয়েটা প্রাচীন রবার গাছ। সব মিলিয়ে অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি নিজের খেয়ালে বড় সুন্দর করে সাজিয়েছে দেশটাকে। মনে হয় সকল দেশের সেরা।
শীত নেই। জ্যাকেটটা খুলে পাশে রাখলাম। আমরা তিনজন পাশাপাশি। মাঠের দিকে অপলক দৃষ্টি। অনেক জন্তু দেখা যাচ্ছে। তবে র্যাকুনের সংখ্যা বেশী। ওদের চিৎকার কানে আসছে।
হঠাৎ র্যাকুনের কর্কশ আওয়াজ ডুবে গেল হাতির বৃংহণে। পেট মোটা দুটো হাতি সিমেন্ট-বেদীর উপর উঠে প্রবল আক্রোশে পরস্পরকে দাঁত দিয়ে গুঁতো মারল। বাঁ’দিকের হাতিটা পিলে চমকানো গর্জন করে শুঁড় উচিয়ে সরে গেল। তারপর দ্রুত দৌড়ে এসে প্রবল শক্তিতে অন্য হাতির ঘাড়ের কাছে একটা শক্ত লম্বা দাঁত ঢুকিয়ে দিল।
আহত হাতির তীব্র আর্তনাদের মধ্যে ঘোষকের ধারা বিবরণী ভেসে আসছে, ‘অন্যায় যুদ্ধ। একটা হাতি হঠাৎ কেন হিংস্র হয়ে উঠল বুঝতে পারছি না। তবে জঙ্গলের জানোয়ার তো। হিংস্র হবেই!’
কয়েকটা বাইসন। কালো পেশীবহুল শরীর। চার পায়ে যেন সাদা মোজা। নাক কুঁচকে যুযুধান দুই হাতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাইক্রোফোনে এবার ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর। সুইডেনের জীব বিজ্ঞানি অধ্যাপক এরিকসনের মূল্যবান মতামত। ‘বাইসন খুবই যুক্তিবাদী প্রাণী। হাতিদের অন্যায় যুদ্ধ থামাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’
আহত হাতিটাকে পাহারা দিয়ে ঝর্নার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে কয়েকটা প্রকাণ্ড বাইসন। ঝর্নার পাশে সিডার গাছের উঁচু ডালে নিঃসঙ্গ একটা ঈগল দীর্ঘ সময় পাখা ঝাপটে আকাশে উড়তে লাগল। ঈগল ছাড়াও দুটো কালো শকুন উড়ছে খুব কাছ দিয়ে। এই প্রথম দেখলাম অবলুপ্তির প্রান্ত সীমায় টিকে থাকা উপকারী বিশাল দুই কালো পাখি। তার দুটো শক্ত লাল ঠোঁট। পচা গলা শব খেয়ে সাফাই করে প্রকৃতি।
হঠাৎ ভনের ভয়ার্ত চিৎকারে চোখ ফেরালাম মাঠে। অগুন্তি র্যাকুন মাঠের চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমাগত কেঁউ কেঁউ চিৎকারে তারা দু’দলে ভাগ হয়ে গেল। এরিকসনের এক ছাত্রী উত্তেজিত স্বরে দুলে দুলে ব্যাখা করল, ‘র্যাকুন গুলো দ্বিধা-বিভক্ত। একদল আক্রান্ত হাতির সমর্থক, আরেক দল আক্রমণকারীর। এটাই এদের স্বভাব। কিছু র্যাকুন এখনো পক্ষ নেয়নি। যে জিতবে তার পিছনে গলা ফাটাবে।’
একটা সিংহ, কোথায় লুকিয়ে ছিল জানিনা। হঠাৎ হাওয়ার বেগে হরিণের পালের দিকে ধাওয়া করল। প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় শুন্যে লাফ দিয়ে একটা ছুটন্ত হরিণকে ধরে ফেলল। সামনের দু’পায়ে হরিণটাকে জাপটে ধরে ওর টুঁটিতে কামড় বসাল। নিস্তেজ শিকার মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ওর পিঠে দাঁত বসিয়ে মাংস খেতে শুরু করল পশুরাজ।
একটু পরে রক্তাক্ত মুখে আকাশ ফাটানো গর্জন পশুরাজের। তারপর ধীর পদক্ষেপে খানিক এগিয়ে এক লাফে আক্রমণকারী হাতির পিঠে উঠে বসল। পশুরাজের প্রবল বিক্রম আর মেঘ ফাটা গর্জনে ভীত সন্ত্রস্ত র্যাকুন গুলো এদিক ওদিক ছুটছে। গায়ে সাদা কালো চেক, সুশৃঙ্খল জেব্রা গুলো মাঠের চারদিকে রুট মার্চে ব্যস্ত। পশু রাজের দাপটে হাতির লড়াই বন্ধ হল কিন্তু অল্প সময়ে হরিণ, শিয়াল, সাপ, বাঁদর দু’দলে ভাগ হয়ে প্রবল আস্ফালন শুরু করলো। পশুরাজের পক্ষে এক দল, আরেক দল বিপক্ষে। যারা পক্ষ নেয়নি তারা ঝর্ণার ধারে সিডার গাছের ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল দর্শকের ভুমিকায়।
এরিকসনের হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে এক অত্যুৎসাহী গবেষক ব্যখ্যা করছেন, ‘জন্তু তিন ধরণের। কারুর মজবুত শরীর, বুদ্ধি কম। কেউ চালাক কিন্তু শক্তিহীন। আবার অনেকে শক্তি-বুদ্ধি, দুটোতেই খাটো।’
সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিস প্রধান অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য থামিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘হাতে বেশী সময় নেই। আলো কমে আসছে। পশ্চিমের সমুদ্রে একটু পরেই সূর্য ডুববে। আপনারা বুঝতে পারছেন, সুরক্ষার কারণে গ্যালারির কপাট গুলো সকাল থেকে বন্ধ। এখন আমরা জন্তুদের স্টেডিয়াম থেকে তাড়িয়ে জঙ্গলে ঢোকাবো। তারপর সমস্ত গেট বন্ধ করে বিগত বছর গুলোর মত শহরে জনগনের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করবো।’
সকাল থেকে সন্ধ্যা। কখন যে এতটা সময় গড়িয়ে গেল! পুলিশের দল মাঠের মাঝখানে পটকা ছুঁড়ল। আগুনের ফুলকি আর বিকট আওয়াজ। কিছু জন্তু ভয় পেয়ে দূরে পালাল। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক, শহরের উকিল অধ্যাপক শিল্পী ছাত্র মজুর হাততালি দিয়ে উঠলো। সবার চোখের সামনে মুহুর্মুহু বোমা ফাটছে। আগুনের গোলা ছুটে আসছে মাঠের ঠিক মাঝখানে।
মাঠের দিকে তাকিয়ে গর্টন কিছু বলতে চাইছিল। ওকে থামিয়ে উত্তেজনায় দু’হাত তুলে ভনের চিৎকার, ‘দেখ দেখ সেন্টর। মেয়ের মুখ, বড় চুল, ঘোড়ার শরীর’।
ভন যতই লাফাক, আমি গোধুলির হলুদ আলোয় পরিষ্কার দেখলাম, পূর্বদিকের গেট দিয়ে সাদা কেশর উড়িয়ে ধেয়ে আসছে অতিকায় এক সাদা ঘোড়া। মাঠের ঈশান কোণে পেট মোটা হাতি গুলো শুঁড় উঁচু করে স্থির অশ্বকে ঘিরে ধরল। হাতির পিছনে বুনো শুয়োর বাঁদর শেয়াল। রাজকীয় ঘোড়াটা ডেকে উঠল ক’বার। তারপর অতি দ্রুত হ্রেস্বা হেঁকে উত্তরের দরজা দিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
‘আমরা ভাগ্যবান…’ এরিকসন কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তাঁকে থামিয়ে আবার দুমদাম পটকা ফাটাল নিরাপত্তা রক্ষীরা। ওঁদের বন্দুক থেকে আগুনের গোলা ধেয়ে এল মাঠে। কিন্তু এত কিছুর পরেও জন্তু গুলো জঙ্গলে ঢুকছে না। ভন ফিস ফিস করল, ‘দারুন সমস্যা। আমাদের খাবার তো শেষ।’
হঠাৎ নিরাপত্তা প্রধানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলছেন, ‘এখনো জঙ্গল থেকে অনেক জন্তু পিল পিল করে নেমে আসছে। পশুগুলোর বেয়াদপি আর সহ্য হচ্ছে না। ভিড়ে ঠাঁসা স্টেডিয়ামে খেলা দেখাবার সুযোগ বাঁদর হাতি র্যাকুন গুলো ছাড়তে চাইছে না। এ-বছর জানোয়ার গুলোর অস্বাভাবিক আচরণের কারণ আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না।’
কথা গুলো কানে ঢুকতেই আমাদের উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল। দক্ষিণ দিকের গ্যালারি থেকে ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে আসছে, ‘জানোয়ার জঙ্গলে না-ঢুকলে কি আমরা এখানে বসে থাকবো?’
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী এরিকসনেরর শান্ত কণ্ঠ কানে এল, ‘আমার অনুমাণ প্রাণীদের বোঝান হয়েছে, দখল করা জমি, ঝর্ণা, মিষ্টি জল, দৌড়াবার মাঠ একটুও ছাড়বে না।’
পাশের আরেকটা গ্যালারি থেকে একই প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘আমাদের স্কুল কলেজ ফ্যাক্টরি গবেষণা সব কি বন্ধ হয়ে যাবে?’
উত্তর নেই কোন। নিস্তব্ধ প্রকৃতি। আমাদের গ্যালারির উপরের সারিতে কয়েকটা সাদা ফুট ফুটে বাচ্চা কেঁদে উঠলো। অল্প আলোতেও নোট বইয়ে ভন কি সব লিখছে। হঠাৎ লেখা থামিয়ে জানতে চাইল, আমরা কোন নতুন জন্তু দেখেছি কি না। আমি এক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে বললাম, ‘দু’চোখ ভরে কালো শকুন দেখেছি। আর অগুন্তি র্যাকুনের নাচন-কোঁদন।’
ভন বলল, ‘আমার মন বলছে, নিশ্চয় কোন পৌরাণিক জন্তু দেখতে পাবো’!
-এই অন্ধকারে কী দেখবে?’ গর্টনের চড়া স্বরে বিরক্তি। বলল, ‘ধৈর্য্য ধর, আমি তোমাকে পৌরাণিক জন্তু দেখিয়ে দেব।’
-কী দেখাবে! বল কোথায়?’
ভনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে এক ঢোঁক ব্রান্ডি গলায় ঢালল মাইকেল গর্টন। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, ‘হাইড্রা দেখাবো। পাঁচ মুখ দিয়ে খাবার গিলছে সরীসৃপ। জঙ্গলে যেতে হবে না, সভ্য দেশেই দেখাবো’।
একটু হেসে আবার ভন জানতে চাইল, ‘তুমি কি নতুন কিছু দেখেছো?’
গম্ভীর গলা গর্টনের। বলল, ‘নতুন জন্তু না দেখলেও নয়া ভাবনা মাথায় ঢুকল। র্যাকুন হল বর্ধিত ইঁদুর কিম্বা ক্ষয়প্রাপ্ত ভালুক। প্রকৃতিতে এ দুটো প্রজাতির জিন মিশলো কী ভাবে?’
ওদের কথায় কান না-দিয়ে চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে আছি। অন্ধকার নেমেছে। সাগরের ফেনিল জল আছড়ে পড়ছে বন্দরের পাথুরে তটে। বন্দরের আলোয় জীবজন্তুর অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ছে। সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে নিলাম। ক্লান্ত শরীরে মোচর দিল এক পেট খিদে। কী করবো বুঝতে পারছি না।
দক্ষিন দিকের গ্যালারিতে এবার প্রবল গর্জন, ‘সারা রাত কি এখানেই বসে থাকবো? কাজকর্ম পড়াশুনা খেলাধূলা সব বন্ধ?’
ওদের কথার উত্তরে মাইক্রোফোনে পুলিশ প্রধান ঘোষণা করলেন, ‘আমার কাজ সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যতক্ষন জন্তু গুলো মাঠে চরে বেড়াবে, আপনারা গ্যালারিতে চুপ করে বসে থাকবেন। মাঝে মাঝে হেলিকপটার থেকে জল আর খাবারের প্যাকেট ফেলা হবে। আপনারা আপাতত পায়ের উপর পা তুলে পরিমিত খাবার খেয়ে জীবজন্তুর মজাদার খেলা দেখতে থাকুন।’
ঘোষণাটা শুনেই আমার মাথা বনবন করে উঠল। অসহায় অবস্থা। মোবাইল, ইন্টারনেট নেই। বাইরে খবর পাঠানো যাবে না। পকেটে পরিমিত অর্থ। অজানা দেশ, অচেনা মানুষ!
প্রবল আতঙ্কে আর্তনাদ করছে ভন। ‘ওঃ আমি পাগল হয়ে যাবো। শুধু র্যাকুনের চিৎকার। দু’দিনের মধ্যে দেশে ফিরতে না-পারলে সর্বনাশ! আমার শাস্তি অবধারিত।’
গর্টন উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে নিজের হাঁটুতে ঘুষি মারছে, ‘হাতি গুলো যদি স্টেডিয়ামের গেট ভেঙে দেয়! পশুদের হাতে মরতে হবে তো !’
গর্টন এবার আমার পিঠে ঘুষি মেরে বলল, ‘আমার দেশ হলে এতক্ষণে কমান্ডো নামিয়ে আমাদের উদ্ধার করত। তুমি একটা উপায় ভাবো, ওআইজ ইন্ডিয়ান। মুক্তির উপায়।’
হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল। ছোট বেলায় কুকুর বিড়ালকে খুব আদর করতাম। বাড়ির প্রাচীরে বসা একটা বাঁদরের হাতে কলা গুঁজে দিতাম। মা দেখে বলতেন, ‘জানোয়ার ঘাঁটিস না অত। কখন মাথায় চড়ে বসে! ওদেরকে ওদের মত থাকতে দে।’
গর্টনের পিঠে আমার হাত। বললাম, ‘দোষ তো আমাদের। জানোয়ারদের স্টেডিয়ামে ঢুকিয়ে খেলতে বলবো। টিকিট বেচে মুনাফা করবো। আর আমাদের রেফারি বাঁশি বাজালেই ওরা খেলা থামিয়ে দেবে?’
অন্ধকার আকাশে মুখ তুলে বুক ভর্তি হতাশায় গর্টন বিড়বিড় করছে। প্রবল যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, ‘এভিল দি উইন্ড, বিটার দা সি/ অ্যান্ড গ্রে দি স্কাই, গ্রে গ্রে গ্রে।’
মেঘের ফাঁক দিয়ে মুখ খুলেছে আকাশে ভাঙা চাঁদ। ম্লান আলোয় জন্তুরা দৃশ্যমান। একটানা পোকার ডাক। কান্নার শব্দের মত ওক সিডারের পত্র-মর্মর। সাগরের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠছে র্যাকুনের বন্য চিৎকার।
আমার কানের কাছে গর্টন মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে ‘জানোয়ার গুলো কি আমাদের ছিরে খাবে? মাঝে মাঝে আমার শরীর ঝাঁকিয়ে বলছে, ‘দিমিত্রিয়স আমাদের ফাঁসিয়ে দিল, বুঝলে! কিছু একটা কর।’
আমি নিরুত্তর। চাপা অন্ধকারে বুকের গভীর থেকে বড় একটা শ্বাস বেড়িয়ে এল। মনে মনে বললেম, কে কী করবে! আমরা অসহায়। বেঁচে আছি তবে জানোয়ারের হাতে বন্দী।
সবুজ গভীর বনানী, তরঙ্গায়িত পাহাড় আর উত্তাল সাগর দিয়ে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এই দেশ। শিশু কিশোর কবি দার্শনিক শ্রমিক অধ্যাপক সবাই জন্তুর হাতে বন্দী।
উদ্ধারের পথ? এখনও জানি না।