নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট

নাটোর প্রতিনিধি
নাটোর প্রতিনিধি
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সাময়িকী

উৎসব পার্বণ মানেই আমাদের বাড়তি আনন্দ। আর এই আনন্দ আরও বেড়ে যায় যখন বাড়তি কিছু যোগ হয়। বিশেষ করে আমাদের গ্রাম অঞ্চলগুলোতে কিংবা ছোট শহর এমনকি সিটি শহর গুলোতেও এখন উৎসবের বাড়তি আমেজের জন্য আয়োজন করা হয় মেলার।

বেশ কিছু বছর থেকে দেখা যায় মেলার আকর্ষণ থাকে গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী জিনিষ পত্রের পসরা। যে গেুলো হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের সমাজ থেকে। যা একটু ধরে রেখেছেন আমাদের সমাজের কিছু লোক তাও এখন উৎসব কেন্দ্রিক।

নাটোরের আলাইপুরের বাটার গলিতে দেখা মিলে এমনি কিছু মানুষ যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন খেলনা তৈরী করতে। এখান থেকে খেলনা চলে যায় দেশের বিভিন্ন জায়গাতে। ব্যাঙারী গাড়ি, ব্যাঙ বাঁশি, কাঠ গাড়ি, কাঁচের রকেট সহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা।

2 20 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 40

যেগুলো দেখলে এখন আমাদের স্মৃতিতে আঁক কেটে যায়। ফিরে যেতে হয় মুহূর্তেই সেই ছোট বেলাতে। ব্যাঙারী গাড়ি তৈরী করা হয় মাটির ছোট অংশকে পুড়িয়ে তার উপর মোট কাগজ দিয়ে বাঁশের কাঠি ব্যবহার করে বিশেষ কায়দায় তৈরী করা হয় এই গাড়িগুলো।

- বিজ্ঞাপন -

গাড়ির আর্কষণ বাড়াতে উপরের অংশের কাগজে রঙ দিয়ে হাতে আঁকানো হয় ফুল, হাতি সহ বিভিন্ন ধরনের নকশা। অনেকে এই গাড়িকে চটপটি গাড়ি নামেও ডাকে। কারণ গাড়িটি সুতা দিয়ে বেঁধে টানলে চট চট করে শব্দ হয়।

4 16 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 41

এই খেলনার হাটে প্রতি বছরে ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন সময় প্রচুর পরিমাণে ক্রেতা-বিক্রেতার আগমন ঘটলেও মহামারী করোনার কারণে এই ঈদ উপলক্ষে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা অনেক কম।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থেকে এসেছেন মো. শরিফুল ইসলাম ব্যাঙারী গাড়ি সহ সাত ধরনের গাড়ি তৈরী করে পাইকারী বিক্রি করেন। একটা ব্যাঙারী গাড়ি পাইকারী বিক্রি করেন ৮ থেকে ১০ টাকায়। যা খুচরা বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ টাকায়।

আগে এক ধরনের গাড়ি পাওয়া যেত পুরোটাই কাঠের। কাঠের লাঠি দিয়ে ঠেলতে হত আর ঘুরতো কাঠের চাকার সঙ্গে। এগুলো এখন পুরোটাই প্লাস্টিকের হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে শরিফুল জানান বানানোর ঝামেলা এবং প্লাস্টিকের সহজ লভ্যতাই এর মূল কারণ।

3 15 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 42

শরিফুল জানান, এবছর ব্যবসা ভাল না। করোনাকালীন সময়ের কারণে পাইকাররা আসতে পারেনি।যারা এই খেলনা গুলোর মৌসুমী ব্যবসা করেন তারাও এবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন তিনি।

- বিজ্ঞাপন -

লাভ কেমন হয় তা জানতে চাইলে বলেন, নিদিষ্ট করে বলা মুশকিল। আমরা পনের দিনের হিসেব করি। একবারে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা করি। পনের দিন পর সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে সেটাই আমাদের লাভ।

আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে সরকার কঠোর বিধি-নিষেধ শিথিল করার জন্য পাঁচ দিনের সুযোগে, ব্যবসা করতে এসেছি নাটোরে, লাভ লোকসান কি হবে তা বুঝতে পারছেন না বলে জানালের তিনি।

5 12 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 43

কথা হয় উত্তম কুমার মালাকারের সঙ্গে। উত্তম এসেছেন নওঁগা জেলার আএাই থেকে। রঙ বেরঙের ঘর সাজানোর প্লাস্টিকের ফুল নিয়ে বসে আছেন উত্তম। সারা বছর বিয়ের মুকুট তৈরী করলেও ঈদের আগে এই ব্যবসা করেন। বিভিন্ন ধরনের ফুল নিয়ে বসেন।

- বিজ্ঞাপন -

চিরাচরিত খেলনার পাইকারী বাজারে দেখা মিলে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরিয়া ইউনিয়নের সেকেন্দারের সঙ্গে, হাতে ঘুরাচ্ছেন ছোট কাঠির সাথে মাটির তৈরী এক টুকরো গোল চাকতি, মোটা কাগজে মোড়ানো।

কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বলেন, এটার নাম ব্যাঙ বাঁশি। হাতে ঘোরালে ব্যাঙের ডাকের মতন শব্দ হয়। এটি কিভাবে তৈরী করা হয় সে গল্প জানান সেকেন্দার, মাটির চাকতি আর বাঁশের কাঠির মধ্যে সংযোগ হিসেবে গরুর লেজ ব্যবহার করা হয় আর কাঠির মাথায় পিচ লাগানো হয়

মূলত বিশেষ শব্দটি হয় গরুর লেজ আর পিচের জন্য। এই ব্যাঙ বাঁশি সেকেন্দার বিক্রি করেন এক’শ পঞ্চাশ থেকে দু’শ টাকায় একশটি। খুচরা বাজারে একটি পাঁচ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।

খাজুরিয়ার আরেক ব্যবসায়ী মোজাহিদুর রহমান রতন প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তৈরী করেন কাঁচের রকেট এবং বেলুন বাঁশি। কাঁচের নলের মধ্যে রঙিন পানি এবং চিকচিকি ঢুকিয়ে তাপ দিয়ে অন্য মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

6 9 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 44

দেখতে আকর্ষনীয় হওয়াতে সকলের কাছে ব্যাপক চাহিদা ছিল এক সময় এই কাঁচের রকেটের এমনটি জানান রতন। কাঁচের রকেট রতনের বাড়ির মহিলা তৈরী করেন আর রতন তৈরী করেন বেলুন বাঁশি।

বেলুন বাঁশির জন্য প্রয়োজন খাগড়া বাঁশ নামের একপ্রকার বাঁশে। রতন জানান, বাড়ির পাশে তিনি এগুলো লাগিয়েছেন। চিকন চিকন বাঁশের তিন টুকরো একসঙ্গে লাগিয়ে এক মাথায় বেলুন লাগিয়ে দেন।

সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহার করেন বিভিন্ন ধরনের কাগজ বা রঙিন পলিথিন। বাঁশিতে ফুঁ দিলে বেলুন ফুলে যায়, ছেড়ে দিলে বেলুনের বাতাস বের হয়ে যায় সেই সঙ্গে বাঁশি বাজে। বিশেষ এই বাঁশি খুচরা বিক্রি করেন প্রতিটি দশ টাকা করে।

পাইকারি ক্রেতা বেলুন বাঁশি কিনছিলেন, নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের হয়বতপুর গ্রামের আব্দুল জলিল তিনি জানালেন, একটি বেলুন বাসি কেনা পড়ছে ৫ টাকা সর্বোচ্চ ১০ টাকায় বিক্রি করা হবে।এই ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তাই দিয়েই পরিচালনা করেন তার সংসার

সল্প লাভের পরও মৌসুমী এই ব্যবসায়ীদের জন্য এখনও টিকে আছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ও স্মৃতিময় শৈশবের স্মৃতি। হয়ত চলতি পথে চোখে পড়ে যায় কখনও। এক ঝটকায় ফিরে যাই আমারা ফেলে আসা জীবনে।

7 9 নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট
নাটোরে ঐতিহ্য হিসেবে এখনো টিকে আছে খেলনার হাট 45

তারপর আবার হয়ত ফিরে আসতে হয় ব্যস্ততাময় বাস্তবতায়। অথচ আমরাই পারি আমাদের হারাতে বসা এই সব ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে। ভাল থাকুক সেই সব মানুষ যারা আজও আমাদের হারানো শৈশবকে ফিরিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন উৎসবে।

আমাদের আনন্দ বাড়াতে ভূমিকা রাখা এই সব মানুষগুলোর ঈদ কাটুক আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দময়।তবে করোনাকালীন এই সময়ে কেমন কাটছে তাদের দিন ? কি ভাবে চালাচ্ছেন তাদের সংসার ? সেই খোঁজ খবর রাখার সময় কি আমাদের আছে ?

অথচ আমাদের সমাজে কোণঠাসা হয়ে থাকা এই সমস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজেদের অজান্তেই, দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন ভূমিকা। টিকিয়ে রাখছেন গ্রামীণ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আগেই সরকারি উদ্যোগে এই উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি সচেতন মহলের।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!