১.
ঢাকার ভাসানটেক সরকারী কলেজের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ (Mangal Asar)-এর প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত জুম আলোচনা সভা ১৩ জুলাই ২০২১ মঙ্গলবার রাত ৯.০০ টায় অনুষ্ঠিত হয়। চিন্তাচর্চায় আলোচ্য বিষয় ছিলো ‘ফরাসি বিপ্লব’। প্রায় দেড় ঘন্টার অধিকসময় ব্যাপ্তির স্মরণ অনুষ্ঠানে সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে মূল্যবান অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকার গভর্নমেন্ট কলেজ অব এ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স (গার্হস্থ্য অর্থনীতি) কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব রাশনা রশীদ।
২.
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ফরাসি বিপ্লব পুরো বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভুতপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার কৃষক ও শ্রমজীবীদের আন্দোলনের পথিকৃৎ এই বিপ্লব। এই আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পেছনে ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। তারই ফলাফলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে, গণতন্ত্র শব্দটি পায় নতুন মাত্রা। সেই ‘ফরাসি বিপ্লব’ নিয়ে রচিত কথামালা উপস্থাপন করেন ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য, ত্রিশাল কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহুল আদিত্য এবং সহযোগী হিসেবে ছিলেন সুমাইয়া কীরাণ। ‘ফরাসি বিপ্লব’ সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরে কথা বলেছেন মো: আল আমিন, কাজী সাচী শিপন, আসিফ খান সাগর, নুসরাত শাহ, রেদোওয়ান আহমেদসহ ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্যদের অনেকেই। আলোচনায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন শেখ আবু সাঈদ।
‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনায় ছিলেন আবদুল্লাহ আল মোহন (সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ)। আয়োজনের শুরুতেই স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব পর্বে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে আলোচনা করেন সিরাজুল কবীর সাকিব। তিনি বলেন, বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, ধ্বনিতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একজন কীর্তিমান মহান পুরুষ। মাতৃভাষার প্রতি জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা। ব্যক্তিগত জীবনে নিরহঙ্কার ও সাদামাটা এই মানুষটি বাংলাদেশের অহঙ্কার। তিনি তাঁর গোটা জীবনব্যাপী বাংলাভাষা, ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে একে একটি মজবুত ভীতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম যুক্তিপূর্ণ লেখনী উপহার দেন এবং এ মহান ভাষার বিরোধিতাকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করেন। উল্লেখ্য, ভাসানটেক সরকারী কলেজের বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরসহ “মঙ্গল আসর” এর চিন্তনসখাদের প্রতি মঙ্গলবার রাত নয়টায় জুম আলোচনায় অংশগ্রহণে সাদর আমন্ত্রণ।
৩.
‘ফরাসি বিপ্লব’ বিষয়ে মূল আলোচক হিসেবে রচিত কথামালা, প্রবন্ধ পাওয়া পয়েন্টে উপস্থাপনকালে ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য, ত্রিশাল কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহুল আদিত্য বলেন, কোনো সমাজ ব্যবস্থা যখন জরাজীর্ণ এবং গতিহীন হয়ে পড়ে, তখন সমাজের মধ্য থেকে এমন শক্তি জেগে ওঠে যে তার আঘাতে পুরাতনতন্ত্র তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙে পড়ে। ক্ষয়ধরা সমাজকে ভেঙে পুরাতন ব্যবস্থার স্থলে নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজের এই তৎক্ষণাৎ মৌলিক পরিবর্তনই হল বিপ্লব। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকেরা বিপ্লবের একটি বিশেষ অংশ দেখেন। তাদের মতে, সমাজে দুটি শ্রেণি থাকে। এক শ্রেণি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং অপর শ্রেণি শোষিত হয়। শোষিত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত অধিকারভোগী শ্রেণীর প্রথাগত রাজনৈতিক এবং আর্থিক সকল অধিকার বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করে। শ্রেণি সংগ্রামই বিপ্লবের বাহন। যেমনটি দেখা যায় ফরাসি বিপ্লবে, যেখানে অধিকারভোগী অভিজাত শ্রেণিকে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যে বিপ্লব দেখা যায়, তা কোনো আকস্মিক কারণে ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে যে ব্যবস্থা চলে আসছিল, তার সঙ্গে ফ্রান্সের বৃহত্তর জনসমষ্টির স্বার্থ যুক্ত ছিল না। শেষপর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গঠনে তৎপর হয় সাধারণ জনগণ।
৪.
বিভিন্ন তথ্যসূত্র উল্লেখ করে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে রাহুল আদিত্য জানান, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত ‘থার্ড স্টেট’ বা সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ ভাগ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ, অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষও কোনও আয়কর দিত না। অথচ যারা আয়কর দিত তারা তেমন কোনও সুযোগ ভোগ করতে পারত না। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত তাদের বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে নির্যাতন করা হত। পূর্ববর্তী রাজাদের যুদ্ধনীতি ও বিলাসব্যসনের কারণে ষোড়শ লুই-এর আমলে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়। কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর্থিক সংস্থানের কোনও বিকল্প ছিল না। সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা অর্থ সচিব নেকারের পরামর্শ চান। নেকার স্টেট জেনারেলের বৈঠক না ডেকে কর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। অথচ ১৭৫ বছর ধরে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন হয় না। নিরুপায় রাজা প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন্তু থার্ড স্টেট-এর নেতৃবৃন্দ সুযোগ বুঝে দাবি তোলেন, নির্বাচনের আগে তাঁদের সদস্য সংখ্যা অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের মোট সংখ্যার (৬০০=৩০০+৩০০) সমান করতে হবে। ১৭৮৮ সালের ডিসেম্বরে রাজা দাবি মেনে নেন। নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৭৮৯ সালের ৫ মে নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন বসবে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফলে দেখা যায় যে, অভিজাত ও যাজকদের মোট নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা হয় ৫৬১টি। অপর দিকে থার্ড স্টেট বা তৃতীয় সম্প্রদায় একাই লাভ করে ৫৭৮টি আসন। বিভিন্ন কারণে তিন ক্যাটাগরি থেকে সর্বমোট ৬১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণির প্রাধান্য স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু রাজা তৃতীয় সম্প্রদায় ছাড়াই অধিবেশনে বসেন এবং কর প্রস্তাব দেন। তৃতীয় শ্রেণির সদস্যরা সভাকক্ষে ঢুকতে না পেরে অপমানিত বোধ করেন।
১৭ জুন তাঁরা নিজেদের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দেন। ২০ জুন থার্ড স্টেটের প্রতিনিধিরা সভাস্থলের পাশে একটি টেনিস কোর্টে এক বৈঠকে মিলিত হন, যাতে যাজক এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সদস্য যোগ দেন, এবং তারা একই সাথে শপথ নেন যে যত দিন ফ্রান্সের জন্য তাঁরা একটি সংবিধান রচনা সম্পন্ন না করতে পারবেন তত দিন তাঁরা একত্রে থাকবেন। এই শপথনামা টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত। ২৩ জুন রাজা ঘোষণা করেন, থার্ড স্টেটের দাবি মেনে নেওয়া যাবে না এবং থার্ড স্টেটের প্রতিনিধিদের রাজপথ থেকে সরে যেতে বলেন, এতে প্রতিনিধিরা রাজি না হওয়ায় পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ১৩ জুলাই হাজার হাজার মানুষ প্যারিসের পৌর ভবনের সামনে জড়ো হন এবং একটি রক্ষীবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। খুব সল্প সময়ের মধ্যে রক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১২ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৪ তারিখ নির্বাচিত প্রতিনিধি, রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং বাস্তিল দুর্গের আশেপাশের মানুষ বাস্তিল অভিমুখে রওনা হয়। প্রতিনিধিরা রক্তক্ষয় এড়াতে বাস্তিল দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। লক্ষ্য ছিল বাস্তিলে অবস্থিত ৭ জন রাজবন্দিকে মুক্ত করা এবং বাস্তিলে রক্ষিত অস্ত্রসমূহ জনগণের হাতে তুলে দেওয়া এবং কামানগুলো অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়া কিন্তু দ্য লোন প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়। জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, জনতার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাস্তিল দুর্গে, বাস্তিলের রক্ষীরাও কামান দাগাতে শুরু করে, প্রায় দুশো বিপ্লবী মানুষ হতাহত হয়। এরপর চারিদিক থেকে উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল ধ্বংস করে। পতন হয় স্বৈরাচারী শাসকের, ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয় শোষিত, নির্যাতিত মানুষের জয়ের নতুন এক উপাখ্যান যার নাম “ফরাসি বিপ্লব”। ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ ছিল ঐতিহাসিক স্লোগান।
৫.
বিশ্ব কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে সহ আলোচক সুমাইয়া কীরাণ বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় দিনগুলোর অন্যতম ১৪ জুলাই। ঐতিহাসিক বাস্তিল দিবস। ফ্রান্সের জাতীয় উৎসবের দিন। শুধু তাই নয়, ফরাসি বিপ্লব ও আধুনিক ফ্রান্সের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় ফরাসি ইতিহাসের এ ঘটনাবহুল দিনটিকে। প্রতি বছরই নানান আয়োজনের মাধ্যমে ফ্রান্সে দিনটি উদযাপন করা হয়। ১৭৮৯ সালের এই দিনে ফ্রান্সের সাধারণ জনগণ বাস্তিল দুর্গ দখল করেন। এ ঘটনাকে স্মরণ করেই দিনটি পালন করা হয়। ফরাসি বিপ্লব পুরো বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভুতপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার কৃষক ও শ্রমজীবীদের আন্দোলনের পথিকৃৎ এই বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পেছনে ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। তারই ফলাফলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে, গণতন্ত্র শব্দটি পায় নতুন মাত্রা।
৬.
‘ফরাসি বিপ্লব’ সম্পর্কে মুক্ত আলোচনায় এবং প্রশ্নোত্তরে কথা বলেন মো: আল আমিন, কাজী সাচী শিপন, আসিফ খান সাগর, নুসরাত শাহ, রেদোওয়ান আহমেদসহ ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্যদের অনেকেই। তারা বলেন, ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে নতুনভাবে লিখতে ভুমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। আলোচকগণ আরো বলেন, মানুষের মনকে বেঁধে রাখা যায় না। চিন্তার জগৎ যত প্রসারিত হয় মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষা তত তীব্র হয়। রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্ট পর্যন্ত যাত্রা মানব সভ্যতার অন্যতম একটি মাইলফলক। বিশেষত যখন মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল ধর্মের প্রতাপ। মানব চিন্তার কেন্দ্রে বার বার গুরুত্ব পেয়েছিল ঈশ্বর এবং ধর্মবিশ্বাস। ইতালিতে গোড়াপত্তন করেছিল রেনেসাঁ। মানুষের ভাবনার জগৎ আলোড়িত করেছিল সেটি। রেনেসাঁ গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের চিন্তা-কেন্দ্র বিশ্বাস ভিত্তিক অপেক্ষা শিল্প সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, বতিচেল্লি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েলসহ বহু উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের সৃষ্টিকর্মগুলো সে সময়কার। মানুষের চিন্তার জগতেও নতুন ধারার স্রোত এসে মিলিত হয়েছিল। পিকো দেলা মিরানদোলা, ম্যাকিয়েভেলি, টমাস মুরের নাম শুরুতেই আসে। ফরাসি বিপ্লবের আগে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফ্রান্স আলোড়িত হয়েছে পুরনো আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে। ফ্রান্সকেন্দ্রিক সংস্কারপন্থি অভিজাত চিন্তাবিদ বস্যুয়ে, মঁতেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, কন্ডসেটের মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদ। এসেছেন প্যাসকেল, বু্যঁফ, ল্যাভয়সিয়ের মতো বিজ্ঞান সাধক। আছেন দেনিশ দিদেরো, দালেমব্যার, দোলবাশ, এলভেতিয়াস। অর্থবিজ্ঞানীর তালিকায় আছেন ভ্যাঁসা দ্য গুরনে, মার্কিস দ্য মিরাবোঁ তুর্গো, নেমুর। এ ছাড়া ১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে বহু ফরাসি এ সময় আমেরিকানদের পক্ষে লড়েছিল। তারা যখন দেশে ফিরল তখন জানল, স্বাধীনতার স্বাদ কেমন।
৭.
বিভিন্ন সহায়ক গ্রন্থের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে আলোচকগণ আরো জানান, উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব। ইতিহাসের দিকে তাকালে ফিরে যেতে হবে ১৪ জুলাই ১৭৮৯ সালে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সেদিন উত্তপ্ত শ্রমিক, কারিগর, গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষের খাদ্যের দাবিতে। এ শুধু নিছকই দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়। প্যারিসের সর্বত্র চলছিল বিক্ষোভ মিছিল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য রাজার নির্দেশে মিছিলের ওপর অশ্বারোহী বাহিনী চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্যারিসের সামরিক অধিনায়ক সসৈন্যে সরে দাঁড়ালে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ জনতার হাতে চলে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। লুট করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান। উত্তেজিত জনতা আরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল কারা দুর্গে আক্রমণ করে। উন্মত্ত জনতা কারাগারের বন্দীদের মুক্ত করে এবং কারাগারের অধিকর্তা দ্যলুনেকে হত্যা করে। ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এ খবর পেয়ে এক সহচরের কাছে এমন অভিমত প্রকাশ করেন, দ্যাট ইজ এ রিভোল্ট।’ সহচরটি প্রত্যুত্তরে বলেন, স্যার, ইট ইজ নট এ রিভোল্ট, ইট ইজ এ রেভল্যুশন। প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আপামর খেটেখাওয়া মানুষগুলো রাজার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল। ফরাসি রাজতন্ত্র ছিল নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী। রাজার ক্ষমতা বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে এবং তা দিন দিন বাড়তে থাকে। রাজা নিজেকে ঈশ্বর প্রদত্ত ডিভাইন রাইট অব মনারকির প্রতিভু বলে মনে করতেন। রাজা ষোড়শ লুই বলতেন, সার্বভৌম ক্ষমতা আমার ওপর ন্যস্ত, সব আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও আমার। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজার সমালোচনা করলে তাকে গোপন পরোয়ানার আইনে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তবে রাজা চতুর্দশ লুই-এর শাসনামলের শেষ ভাগে রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। এরপর রাজা পঞ্চদশ লুই রাজকার্য পরিচালনার পরিবর্তে বিলাস-ব্যসনেই ব্যস্ত ছিলেন। পঞ্চদশ লুই-এর পরে রাজা ষোড়শ লুই সিংহাসনে বসে প্রশাসনকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদৌ তিনি পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক ছাড়তে পারেননি। বিশ্বাস ভিত্তিক চিন্তাধারার জগৎ থেকে প্রগতির পথে কোনো ফরাসি রাজশাসকই আগ্রহ দেখাননি। পাশাপাশি ছিল রাজপ্রাসাদে রাজাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, অমিতব্যয়িতা এবং অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সব মিলিয়ে ফরাসি জনগণকে বিপ্লবমুখী করে তুলেছিলেন ষোড়শ লুই। এ ছাড়া ছিল শাসন বিভাগের বিশৃঙ্খলা ও রাজ কর্মচারীদের অত্যাচার। দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল শাসন ও বিচার ব্যবস্থা। তা ছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি রাজশক্তি হ্রাস পেয়েছিল। বিশেষ করে সাত বছরব্যাপী যুদ্ধে ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত ও ইংরেজদের কাছে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ফরাসিদের ব্যবসা বাণিজ্য অবনতির ফলে রাজকোষও শূন্য হয়ে পড়েছিল। তবে এসবকেই ইন্ধন জুগিয়েছিল ফ্রান্সের সমাজে শ্রেণি ব্যবধান। অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় প্রথম শ্রেণিভুক্ত ছিল। মধ্যবিত্ত ও জনসাধারণ ছিল সুবিধা বঞ্চিত ও অধিকার বঞ্চিত শ্রেণি। যাজক সম্প্রদায়ের বিশেষ রাজনৈতিক, বিচার এবং রাজস্ব সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল। যাজকদের নিজস্ব প্রাসাদ, দুর্গ ও গির্জা ছিল। ফরাসি সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল অভিজাতরা। তারা সংখ্যায় নগণ্য হলেও সমাজে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। অভিজাতদের শ্রেণিগত সুযোগ-সুবিধা, ভোগ-বিলাস এবং কৃষকদের ওপর শোষণ ও নিষ্পেষণ প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি-সংঘাতের ক্ষেত্র গড়ে তুলেছিল। বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত ছিল তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রবল প্রতিদ্বদ্বী ও বিরোধী করে তোলে। কৃষক ও শ্রমিকরা ছিল সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের। রাজস্বের ব্যয়ভার কৃষককেই বহন করতে হতো। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমানুপতিক হারে আয় বৃদ্ধি না হওয়ায় তাদের আর্থিক সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। ফলে কৃষক ও শ্রমিকরা ক্রমেই বিপ্লবমুখী হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যের কারণে শ্রেণিগত বিদ্বেষের সূচনা। ত্রুটিপূর্ণ করনীতি ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। সর্বশেষ আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ ফ্রান্সের আর্থিক কাঠামোর ওপর উল্লেখযোগ্য আঘাত হানে। তবে শুধু মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কখনো বিপ্লব ঘটে না। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই চেতনা রোমান ক্যাথলিক চার্চের চিরাচরিত ক্ষমতা, রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা এবং অভিজাতদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী সমালোচনার প্রসার।
৮.
আলোচনায় সভাপতির বক্তব্য প্রদানকালে শেখ আবু সাঈদ বলেন, ১৭৮৯ সালের হিসাবে ফ্রান্সের ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে থাকত। তার মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ছিল কৃষক। অথচ চাষযোগ্য জমির অধিকাংশ ছিল গির্জা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে- প্রায় ৩০ শতাংশ। যদিও তারা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ২ ভাগ। এ ছাড়া বিপ্লবের সময়টাতে ফ্রান্সে প্রায় ১০ লাখের মতো ভুমিদাস ছিল। মাঝেই মাঝেই দেখা দিত অজন্মা। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, ফ্রান্সে ৯ দশমাংশ লোক অনাহারে মারা যায়, আর এক দশমাংশ মরে অতি ভোজনের ফলে। এ ছাড়া ছিল কর বা খাজনার জন্য নির্যাতন। সাধারণ মানুষকে রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভুস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর দিতে হতো। আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সব মিলিয়ে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। শেখ আবু সাঈদ আরো জানান, ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভার্সালিসে নারী সম্মেলন। ১৭৮৯ সালের ১ থেকে ৫ অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় ৭ হাজার নারী ভার্সালিসে বিভিন্ন দাবিতে সম্মেলন করেন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা বিদ্রোহীদের আন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এতে বিপ্লবের গতি অনেক বেগবান হয়। রাতারাতি এ আন্দোলন রাজপরিবারকে কোণঠাসা করে ফেলে।
৯.
আলোচনা অনুষ্ঠানে সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে মূল্যবান অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকার গভর্নমেন্ট কলেজ অব এ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স (গার্হস্থ্য অর্থনীতি) কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব রাশনা রশীদ। তিনি ‘মঙ্গল আসর’-এর নানবিধ সৃজনী কার্যক্রম ও স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করায় সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা জানান। ‘ফরাসি বিপ্লব’ নিয়ে তথ্যবহুল চমৎকার উপস্থাপনের জন্য প্রবন্ধকার ও আলোচকদেরও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে নতুনভাবে লিখতে ভুমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব। আলোচনাকালে তিনি সকলকেই করোনাকালে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। এই অতিমারী করোনাকালে ‘মঙ্গল আসর’-এর উদ্যোগে অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা অনুষ্ঠান এবং ভাববিনিময় শিক্ষার্থীদের মনকে সজীব রাখবে যেমন তেমনই তাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সক্রিয় ভুমিকা রাখার ইতিবাচক দিকের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি।
১০.
‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনাকালে আবদুল্লাহ আল মোহন (সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ) বলেন- ফরাসি বিপ্লব এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। বিশেষত রাজতন্ত্রের পতন ও বিশ্বাসভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র শব্দটি অর্থবহ হয়ে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের পর। ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ইউরোপ তো বটেই, সারা পৃথিবীর মোড় ঘুরে যায় ফরাসি বিপ্লবের ফলাফলে। এখন বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুফল ভোগ করছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র শব্দটি অর্থবহ হয়ে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের পর। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রতিভু থেকে সাধারণ নাগরিক লুইতে পরিণত করার পর, জাতি শব্দটি তার সার্বভৌমিক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। বিপ্লবের পর একটি মাত্র নির্দিষ্ট আইন ও বিচার ব্যবস্থার পুরো ফ্রান্সকে নিয়ে আসা হয়। ফরাসি বিপ্লবের যুগান্তকারী ঘটনাটি ইউরোপে এক অবিশ্বাস্য ওলটপালট ঘটিয়েছিল। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সূচনা ঘটায়। জাতি সম্পর্কে, গণতন্ত্র সম্পর্কে ফরাসি বিপ্লব নিয়ে আসে এক নতুন ধারণা। তাছাড়া এ সময় থেকেই ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠল এক আন্দোলন, এক যুদ্ধ, যা নিছক রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিপ্লবের পর নাগরিকদের নিজ নিজ পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, সব সরকারি পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ এবং নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে জোরদার করেছিল। এর পাশাপাশি ফ্রান্সে কার্যকর করা হলো রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। বিপ্লবী সরকার কর্তৃক নাগরিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। ফরাসি বিপ্লব আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সেটি হলো মেট্রিক পদ্ধতি চালু। ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ৮শ’ ভিন্ন রকমের পরিমাপ-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল যা কৃষক, কুটির শিল্পী, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন লেনদেনকে ব্যাহত করত। বিশেষত উঠতি বুর্জোয়া এবং ব্যবসায়ীদের জন্য এ ছিল এক চরম দুর্ভোগ, তাদের আকাক্সিক্ষত অখ- বৃহৎ জাতীয় বাজার গড়ে তোলার পথে বাধা। ১৭৯০ সালের ৮ মে সংবিধান সভায় পরিমাপ ব্যবস্থার ঐক্যসাধন সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় এবং ১৭৯৩ সালের ১ আগস্ট এ পদ্ধতি সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়। ১৭৯৫ সালের ৭ এপ্রিল থেকে তা সমগ্র ফ্রান্সে প্রচলিত হয় এবং পরে পুরো ইউরোপ এবং গোটা বিশ্বে এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে।
১১.
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ও প্রভাব নিয়ে আলোচনাকালে জনাব আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, ফরাসি বিপ্লব হঠাৎ করে ঘটেনি, তার পেছনে একটি প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ছিল। সে দেশে তখন রাজতন্ত্রের দুঃশাসন চলছে। সঙ্গে ছিল পুরোহিত তন্ত্রের অত্যাচার। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, তারা স্বাধীনতা চাইছিল রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের হাত থেকে। কিন্তু এই বোধ তাদের ভেতরে ছিল যে, কেবল ওই দুই শত্রুর পতনেই মুক্তি আসবে না, যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে সেটাকেও দূর করা চাই, তার জন্য দরকার সাম্য, সাম্য না থাকলে মৈত্রী আসবে না এবং সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা যদি মৈত্রীর না হয়ে হয় শত্রুতার, তাহলে তো সেই সমাজ মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত হবে না। সেখানে তৈরি হবে না সামাজিক শক্তির। বিপ্লবীরা তাই একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রীর। ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভুমি দার্শনিকদের দ্বারা সৃষ্ট না হলেও বুর্জোয়া শ্রেণির উপর দার্শনিকদের রচনার বিশেষ প্রভাব ছিল, যা প্রচলিত ব্যবস্থার সমালোচনা করে ফরাসি বিপ্লব ঘটাতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্সে বুরবো রাজাদের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অসন্তোষ তৈরি হয় তাকে কাজে লাগিয়ে ফরাসি দার্শনিকরা জনসাধারণের মনোজগতে পরিবর্তন বা বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভলতেয়ার, মন্তেস্কু, রুশো, দিদেরো প্রমুখ দার্শনিকরা তাঁদের রচনার দ্বারা ফরাসি জনসাধারণকে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলেন। এর ফলে যে বৈপ্লবিক ভাব তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলেছিল। যে ক’জন দার্শনিকের চিন্তাধারা ফরাসি বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল, রুশো ছিলেন তাদেরই অন্যতম একজন। ফরাসি এই দার্শনিককে বলা হয় আলোকিত যুগের অন্যতম প্রবক্তা। দার্শনিক রুশো’র ‘আত্মা কলুষিত হতে শুরু করলেই মন আকারে সরু হতে থাকে’ বিখ্যাত উক্তিটি উল্লেখ করে তিনি জানান রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারিগর মনে করা হয়। রুশো তার লেখনির মাধ্যমে ফরাসি মননে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন।তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন,‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত করে’ (Man is born free but everywhere he is in chains)। দার্শনিকদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিকদের মন্তেস্কু এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন মন্তেস্কু। পেশায় আইনজীবী মন্তেস্কু ছিলেন ‘নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক এবং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা। তিনি তার বিখ্যাত ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ (The Spirit of Laws)-এ রাজার দৈবস্বত্ব নীতির সমালোচনা করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলেন। মন্তেস্কুর আর-একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘দ্য পার্সিয়ান লেটারস’ (The Persian Letters)। এই গ্রন্থে তিনি বিপ্লব-পূর্ব ফরাসি সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্স তথা ইউরোপের আর একজন বিখ্যাত দার্শনিক হলেন ভলতেয়ার। তার আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল চার্চ ও রাষ্ট্র। তিনি চার্চের দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচার সম্পর্কে উল্লেখ করে ফরাসি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেন। ভলতেয়ারের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল কাদিদ’ (Candide) ও ‘লেতর ফিলজফিক’ (Lettres Philosophiques)। এই গ্রন্থ দুটিতে তিনি ধর্মীয় রীতিনীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
১২.
জনাব আবদুল্লাহ আল মোহন বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে জানান, ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ১৪ জুলাই ১৭৮৯ ধরা হলেও তা ধাপে ধাপে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়েছে। বাস্তিলের পতন, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকারের ঘোষণা ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে বিপ্লব এগিয়ে গেল প্রজাতন্ত্র ঘোষণার স্তরে। ১৭৯১ সালের ১০ আগস্ট প্যারিসের সংগ্রামী জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয়। বিপদ টের পেয়ে রাজা-রানী আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন। বন্দি রাজা বাধ্য হলেন সংবিধানকে স্বীকৃতি দিতে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটে, স্থাপিত হয় প্রজাতন্ত্র। এটাকে ধরা হয় বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর হিসাবে। জনাব আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, আগেও উল্লেখ করেছি ফরাসি বিপ্লবের যুগান্তকারী ঘটনাটি ইউরোপে এক অবিশ্বাস্য ওলটপালট ঘটিয়েছিল। এ সময় থেকেই ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠল এক আন্দোলন, এক যুদ্ধ, যা নিছক রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বলা দরকার যে আংশিক হলেও, জনগণের এক বিরাট অংশকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়ে বিপ্লব গণতন্ত্রকে প্রয়োগ করে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জোরদার করে। ফরাসি বিপ্লবের ধারণা অনুযায়ী গণতন্ত্র হল এমন এক জমানা যেখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলির পেছনে থাকবে জাতীয় স্বার্থ এবং যেখানে নাগরিকের অধিকার থাকে সুরক্ষিত। বিপ্লবের পর নাগরিকদের নিজ নিজ পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, সমস্ত সরকারি পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ এবং নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে জোরদার করেছিল। ফরাসি বিপ্লব এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল যা থেকে ফ্রান্স তো বটেই ক্রমে ইউরোপ এবং সারা পৃথিবী লাভবান হয়েছে। আজকের পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ, জাতীয় তথা জনগণের সার্বভৌমত্বের ভাবাদর্শটির জন্য ফরাসি বিপ্লবের কাছে ঋণী। এর পাশাপাশি ফ্রান্সে কার্যকর করা হল রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। বিপ্লবী সরকার কর্তৃক নাগরিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হল। ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চ ও এর যাজক-পাদ্রীদের দৌরাত্ম্যে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। জোর করে ধর্মান্তর করানোর ঘটনাও ঘটত। ১৭৯১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নিয়ম করা হল, নাগরিকদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গির্জার কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না, থাকবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। যেসব নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় যেগুলিতে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সুপরিস্ফুট। সব মিলিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ফরাসী বিপ্লবের সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রভাব হলো- ১. নতুন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব ২. গণতন্ত্রের উদ্ভব ৩. জাতীয়তাবাদী আদর্শের জাগরণ ৪. জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ৫. শিল্প বিপ্লব ৬. সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ৭. বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ৮. উদারতাবাদ ৯. ব্যক্তি বিশেষের উপর প্রভাব ১০. আমলা শ্রেণীর উত্থান ১১. সামাজিক জীবন ১২. মানবতাবাদ / মানবাধিকার ইত্যাদি। সুতরাং বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্ব বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে অপরিসীম।
১৩.
সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে এবং আগামী ২০ জুলাই মঙ্গলবার রাত ৯টায় ‘মঙ্গল আসর’-এ হুমায়ুন আহমেদ, তাজউদ্দীন আহমেদ এবং অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর জীবনী-কর্ম নিয়ে আলোচনায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে চিন্তাচর্চার আয়োজন শেষ হয়।
‘মঙ্গল আসর’-এর পক্ষে-
আবদুল্লাহ আল মোহন / সিরাজুল কবীর সাকিব
১৪ জুলাই ২০২১